‘নিঃস্ব’ মমতার ‘ফিরিয়ে দাও’আকুতি নিজস্ব ভুলেরই স্বীকৃতি

ছবি বিশ্বাস অভিনীত ‘সবার ওপরে চলচ্চিত্রের সেই দৃশ্যটির কথা স্মরণ করুন। আদালতে নির্দোষ প্রমাণিত হয়েছেন। মুক্তি পেয়েছেন টানা ১৪ বছর জেলবাসের পর। কিন্তু সে মুক্তি আনন্দ এনে দেয়নি। দু’চোখে অশ্রুধারা বইছে তার। আর দু হাতের তালুতে পেতে ভিক্ষে চাইছেন আদালতের কাছে— “দাও দাও ! ফিরিয়ে দাও আমার জীবনের ১৪টা বছর। ফিরিয়ে দাও। ফিরিয়ে দাও।”
পরিপ্রেক্ষিতটা পৃথক।তবু যেন অনেক বছর পরে গত ২১ জুলাই শহিদ দিবসের মঞ্চে মুখ্যমন্ত্রী তথা তৃণমূল সুপ্রিমো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কণ্ঠে শোনা গেল সেই একই আকুতি—‘ফিরিয়ে দাও।ফিরিয়ে দাও ! ফিরিয়ে দাও!’যদিও তিনি ফেরাতে বলেছেন ‘১৫ লক্ষ টাকা ব্ল্যাকমানি’, কিন্তু সেদিনের সভায় উপস্থিত সমঝদার জনগণ ঠিকই বুঝেছেন— আসলে তিনি ফেরাতে চেয়েছেন, নিজের ভুলে গত আট বছর ধরে যা যা তিনি হারিয়েছেন। সেগুলি কী? সেগুলি হলো : নিজের সততার প্রতিমূর্তির ইমেজ। নিজের হাতেই উপড়ে ফেলা দলীয় শৃঙ্খলা। নিজের হাতে রোপণ করা দুর্নীতির বাসা। আর প্রায় হারাতে বসা রাজ্যপাট। কারণ ২০১৯-এর লোকসভা ভোটের ফলাফলে মমতা রাজনৈতিক নির্ভরতা এবং বিশ্বাসযোগ্যতা যখন প্রায় তলানিতে এসে পৌঁছেছে, তখন তিনি নিজের দলীয় কর্মীদের ‘কাটমানি’ দুর্নীতিতে অভিযুক্ত করে নিজেই ফেঁসে গিয়েছেন। বুঝে গেছেন, দাবার চালটা ভুল হয়ে গেছে। তাই কাটমানি ইস্যুর অভিমুখ ঘোরাতে ব্ল্যাকমানি ফেরতের দাবি, যে ব্ল্যাকমানি নিয়ে বিরোধীরা ভোটের আগেই জলঘোলা করার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছে। দেশব্যাপী বিরোধীরা ব্ল্যাকমানি ইস্যুতে নির্বাক হয়ে গেলেও, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ফেনিজেকে বাঁচানোর তাগিদেই জেলায় জেলায় বিক্ষোভ কর্মসুচির কথাও ঘোষণা করে দিয়েছেন হাস্যকর ভাবে। বুদ্ধিটা প্রশান্ত কিশোরের কিনা তা জানা যায়নি। তবে এটা বলা যেতেই পারে— যদি এই পরামর্শটা প্রশান্ত কিশোরের হয় তাহলে তিনি নির্ঘাত মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে বাঁচাতে আসেননি। ৫০০ কোটি টাকা পকেটস্থ করে ডোবাতেই এসেছেন। ব্ল্যাকমানির প্রসঙ্গ তুলে কাটমানির প্রসঙ্গকে যে কোনোভাবেই ধামাচাপা দেওয়া যাবে না, তা মমতা না বুঝলেও রাজ্যবাসী বোঝেন, কারণ তারাই প্রত্যক্ষ ভূক্তভোগী। সেই তারাই যখন কাটমানি ফেরতের দাবিতে গ্রামে গ্রামে দাবি তুলছেন তখন ২১ জুলাইয়ের মঞ্চে মমতা সাফাই গাইছেন— ‘সরকারের নানা প্রকল্পের ছোটো ছোটো কাজগুলোর সুবিধা যাতে মানুষ পায়, তার জন্য বলেছিলাম, দেখবেন কেউ যেন ভাগ (কাটমানি) না বসায়। একটা মহৎ উদ্দেশ্যে বলেছিলাম। আর সেটাকে বিকৃত করে বিজেপি নেতারা বাড়ি বাড়ি গিয়ে বলছেন, টাকা ফিরিয়ে দাও। ধর্মতলার ছড়ানো ছেটানো হাল্কা মনোভাবের ভিড়ের চেহারা স্পষ্ট করে দিয়েছে। মমতার বক্তব্য মানুষ গ্রহণ করেননি। ফলে মমতার বক্তব্য চলাকালীনই যখন মানুষ পা বাড়িয়েছেন চিড়িয়াখানা নয়তো বাড়ির পথে, তখন মাইকে মিথ্যে প্রচার করতে হয়েছে যে চিড়িয়াখানা খুলবে দেরিতে। এমনকী মঞ্চে দাঁড়িয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে বার বার বলতে হয়েছে—‘রেড রোডে মানুষের ভিড় দেখে মনে হচ্ছিল যেন একটা ব্রিগেডের সভা হচ্ছে। আসলে ওই ভিড়টা ছিল চিড়িয়াখানা অভিমুখী।
মমতা অভিযোগ করেছেন উজালা গ্যাস নিয়ে নাকি এরাজ্যে বিজেপি কাটমানি নিয়েছে। এল পি জি, পেট্রোল পাম্প নিয়ে কাটমানি তোলা হয়েছে। জুজুর ভয় দেখিয়েছেন— “কি দেব নাকি সব তথ্য বের করে!’ বার কিন্তু করেননি। মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দিচ্ছেন কেন— এ প্রশ্ন উঠেছে সেদিন জনসমাবেশেই।
দলত্যাগের হিড়িকেও রীতিমতো তটস্থ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, সেটাও তাঁর বক্তব্যে পরিষ্কার। আরও পরিষ্কার, তিনি আর ই ডি-র জোরালো পদক্ষেপেও ভয় পাচ্ছেন, হয়তো নিজেও গ্রেপ্তার হয়ে যাবেন এবার। তাই ভয় কাটাতে হুংকার দিয়েছেন তিল তিল করে তৃণমূল গড়েছি। আমাকে ইডি বা সিবিআই অ্যারেস্ট করলেও তৃণমূল ছেড়ে কোথাও যাব।
আসল কথা হলো— ২১ জুলাইয়ের মঞ্চ থেকে তৃণমূল নেত্রীর বক্তব্যে একটা কথা বেশ স্পষ্ট হয়ে গেল— ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনের ফলাফল দেখে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বুক ধড়পড়ানি শুরু হয়ে গেছে। ফলে মুখে যতই বলুন না কেন— ‘ইঞ্চিতে ইঞ্চিতে বুঝে নেব’, আসলে তিনি নিজস্ব রাজনৈতিক বিচারবোধ হারিয়ে ফেলছেন দ্রুত। যা বলছেন সবই বুমেরাং হয়ে যাচ্ছে দেখে সংশোধন করার চেষ্টা করছেন। কিন্তু সংশোধনীটাও জনগণ খাচ্ছেন না। সেটাও বুমেরাং হয়ে যাচ্ছে। ফলত মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এখন ডুবে রয়েছেন এক কোমর পাঁকে। ভুল রাজনীতির পাঁক। অতি উচ্চাশার পাঁক। দেশবিরোধী রাজনৈতিক পদক্ষেপের পাঁক। নিজস্ব পরিবারের প্রকাশ্য অবক্ষয়ের পাঁক। আর পাপ। নিজস্ব কর্মীদের ওপর বিশ্বাস হারানোর পাপ। জনগণের ওপর নির্ভরতা হারানোর পাপ। ঘন ঘন মিথ্যা দিয়ে সত্যকে ঢাকার অপচেষ্টার পাপ।
রাজ্য-রাজনীতির হালচাল নিয়ে চর্চাকারীরা ২১ জুলাইয়ের আগেই সোশ্যাল মিডিয়ায় দেওয়ালে দেওয়ালে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন মমতা ভুল বকবেন এবং প্রশান্ত কিশোরের মতামতকে গুরুত্ব দেবেন না। একজন তো প্রকাশ্যে লিখেছিলেন— “উনি কি কারও কথা শোনেন যে প্রশান্ত কিশোরের কথা শুনবেন? ২১ জুলাইয়ে মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্য তার প্রত্যক্ষ প্রমাণ।রাজ্যবাসীর ওপর, দলীয় কর্মীদের ওপর, নেতৃবৃন্দের ওপর, প্রশাসনের ওপর, পুলিশের ওপর, বিরোধীদের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে এবং উপুর্যপরি বেআইনিভাবে কেন্দ্রের সঙ্গে সংঘাতে গিয়ে তিনি নিজস্ব মস্তিষ্কের ওপরই নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলছেন। পরবর্তী রাজ্য বিধানসভার নির্বাচন যত এগিয়ে আসবে, ততই এই নিয়ন্ত্রণের রাশ ক্রমশ কমতে থাকবে। দলের নেতা-নেত্রীরা তা বুঝে গেছেন। ফলে গেরুয়া শিবিরের দিকে পা বাড়িয়ে বসে সবাই। ছোটো নেতা, মেজো নেতা,বড়ো নেতা— সকলেই। এখন বিজেপির ওপর নির্ভর করবে ডুবন্ত জাহাজের ইঁদুর বাহিনীর কতটা অংশ ঠাই পাবে গেরুয়া শিবিরে।
সুজিত রায়

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.