গোপালচন্দ্র ভট্রাচার্য ছিলেন একজন ভারতীয় প্রকৃতি বিজ্ঞানী। সামাজীক কীটপতঙ্গ এবং ব্যাকটেরিয়ার রুপান্তর (আকার বা গঠনের পরিবর্তনের) এ গভীর অনুসন্ধানের জন্য তিনি কীটবিদ এবং প্রকৃতিবীদ হিসাবে পরিচিতি পান। তিনি ” বাংলার কীটপতঙ্গ” বইটির জন্য রবীন্দ্র পুরস্কারে ভূষিত হন ১৯৭৫ সালে। এবং ১৯৬৮ সালে আনন্দ পুরস্কার পান।
জানা যায় তাঁর কাজের ক্ষেত্র ছিল কীটবিজ্ঞান ও উদ্ভিদবিজ্ঞান।
গোপাল চন্দ্র আমাদের দেশের ফরিদপুরের লনসি গ্রামে জন্ম গ্রহন করেন। তার পরিবার ছিল গরীব কুলীন ব্রাহ্মণ। তার বাবার নাম আম্বিকা চরন ভট্টাচার্য। তিনি পুরহিত হিসেবে গ্রামের মানুষের সাহায্য সহযোগিতা পেতেন মাঝে মধ্যে স্থানীয় জমিদারের কাচারিতে কাজ করতেন। গোপাল চন্দের মা, শশীমুখী দেবী ছিলেন গৃহিনী।তাঁর বয়স যখন পাঁচ তখন তার বাবা মারা যান। শৈশব জীবনে তার নানা দুঃখ-কষ্টের ভেতর কাটে। চার ভাই-বোনের ভেতর তিনিই ছিলেন সবার বড়। উচ্চ মধ্যমিক স্কুলের পর তিনি ১৯১৩ সালে আই.এ ভর্তী হন কিন্তু অর্থ সংকটের কারনে পড়ালেখা শেষ না করেই একটি স্কুলে শিক্ষকতার চাকরি নেন।
শিক্ষকতা করতে করতেই সাহিত্যে দিকে ঝুকে পরেন, লিখেন জারি গান ও পালা গান । এই সময়ে তিনি নানা বিষয়ের উপর হাতে লেখা একটি ম্যাগাজিনও প্রকাশ করেন।কিছু দিনের মধ্যেই তিনি প্রকৃতির রহস্য তাকে মুগ্ধ করে। স্কুলের বাগানে ফুল এবং ফল এর সংকরায়নের পরীক্ষা নিরীক্ষা করতে থাকেন ।
রাতের অন্ধকারে,জঙ্গলে যে আগুন জ্বলতে দেখা যায় তা তার রহস্য উৎঘাটন করে দেখেন এটি আসলে জৈব আলো। সেদিন অন্ধকার রাতে দুই বন্ধু মিলে গেলেন সেই পাঁচির মার ভিটায়। সেদিনও বৃষ্টি হচ্ছে হাতে হারিকেন, ছাতা এবং ম্যাচ। ঝোপ ঝাড়া পেড়িয়ে পৌছলেন ভিটার কাছে। হারিকেনটা একটু কমিয়ে অল্প কিছুক্ষন অপেক্ষা করতেই দেখলেন অস্পষ্ট আলো। সাহস করে আর একটু কাছে যেতেই দপ করে জ্বলে উঠল। কিছুটা লাফা লাফি করে এবার যেন স্থির হলো। আরও একটা সাহস করে সামনে এগুতেই দেখলেন আগুনের কুন্ডলী কিন্তু আশ্চার্য ব্যাপার আগুনের কোন শিখা নেই। কয়লা পুরলে যেমন আগুন হয় তেমন জ্বল জ্বল করছে। আলোটার তীব্রতা নেই কিছুটা নীলাভ। এই আলোতে চারপাশের কিছু অংশের ঘাস লতা পাতা ভালই দেখা যাচ্ছে। আরো কাছে যেতেই দেখলেন পুরনো একটা গাছের গুড়ি থেকে আলো নির্গত হচ্ছে। গুড়ির কাছেই একটা কচু গাছ এর পাতা এ দিক ও দিক দুল খাচ্ছে। এই পাতাটার জন্যই দেখা যাচ্ছিল আলোটা একবার নিবছে আবার জ্বলছে। তিনি গাছের গোড়া থেকে কিছুটা অংশ সংগ্রহ করে নিয়ে আসলেন এবং দুই তিন দিন রাতে এগুলি থেকেও আলো ছড়াত।
ঘটনার পর পঁচা গাছপালার আশ্চর্য আলো বিকিরণ করার ক্ষমতা শিরোনামে একটা প্রবন্ধ লেখেন। ১৩২৬ বঙ্গাব্দ ‘প্রবাসীতে‘ পৌষ সংখ্যায় প্রবন্ধটি প্রকাশিত হয়। লেখাটি চোখে পড়ে বিজ্ঞানী জগদীশ চন্দ্র বসুর। বিপ্লবী শ্রীপুলিনবিহারীকে বললেন গোপালচন্দ্র ভট্টাচার্যকে যেন তার কাছে নিয়ে আসেন। বসু বিজ্ঞান মন্দির তখন নতুন চালু হয়েছে। ১৯২১ সালে জগদীশ চন্দ্রের সাথে গোপাল ভট্টাচার্যের সাক্ষাত হয়। সেখানে তাকে ছোট পদে নিযুক্ত করা হয়। প্রথমে ছোট ছোট কাজ করতে দিলেন যন্ত্রপাতি মেরামত, স্কেচ করা ইত্যাদি। আবশ্য খুব দ্রুতই তিনি তার নিজস্ব প্রজেক্টে কাজ শুরু করেন। এর পর থেকে তিনি বসুর বিজ্ঞান মন্দিরে গবেষণার সুযোগ পান।
বিজ্ঞান মন্দিরে কাজ কর্ম সম্পর্কে বেশ কিছু দিন একটু ধারনা করার পর জগদীশ চন্দ্র বসুর দুজন সহকর্মীর সাথে কাজ করার সুযোগ পান। তিনি তাদের কাজে সাহায্য করেন। কাজের ফলাফল প্রকাশ করার সময় ছবি দিতে হতো। গোপালচন্দ্র সেই ছবি আঁকতেন। এভাবে দুই বছর কাটার পর জগদীশ চন্দ্র বসু তাকে পারসপেকটিভ ড্রইং শিখবার জন্য গভর্নমেন্ট আর্ট স্কুলে স্পেশাল ছাত্র হিসেবে ভর্তি করেদেন। তিনি দক্ষ ফটোগ্রাফারও হয়ে উঠেন এবং নগেন্দ্রনাথ দাস এর সঙ্গে ফটোগ্রাফিক কাজে জুটে গেলেন।
তার পর জগদীশ চন্দ্রের বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি রক্ষনাবেক্ষনের জন্য ক্লাইভ ইন্জিনিয়ারিং এ ছয়মাস শিক্ষা লাভ করেন। বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি নিয়ে কাজ করার মধ্য দিয়ে মাইক্রোস্কোপ নিয়ে কাজ শুরু করেন। বিচিত্র আকৃতি,প্রকৃতির প্রোটোজোয়া দেখে তিনি মুগ্ধ হন। উদ্ভিদ নিয়ে শুরু করলেও খুব কম সময়ে প্রোটোজোয়ায় এসে পরেন।
তার প্রথম গবেষনা পত্রটি প্রকাশিত ১৯৩২ সালে গাছের কান্ডের স্থায়িত্ব নিয়ে। তারই ধারাবিহিকতায় জৈব আলো এবং উদ্ভিদ বিদ্যার উপর নিবন্ধ প্রকাশ পায়। ক্রমশ তার মনোযোগ কীটতত্বের দিকে ধাবিত হয়।
কীটতত্বের দিকে ধাবিত হওয়ার অন্য একটি কারনও আছে। একদিন কলমির ডাঁটার সেকশন কেটে পরিক্ষা করতে করতে দেখলেন সেই ডাঁটায় নতুন ধরনের কিছু কোষ উৎপন্ন হয়। কয়েক বার পরীক্ষাটা করে জগদীশ চন্দ্র বসুকে জানালেন। বসু প্রথমে তাকে একটি পেপার তৈরি করতে বললেন কিন্তু পেপার তৈরি হলেও কিছু হয়নি বলে তিনি সেটা বাতিল করে দিলেন। এতে তিনি কিছুটা দমে গেলেন। তার কাজ নিয়ে বিশেষজ্ঞের মতামত নেয়ার জন্য কিছুটা মরিয়া হয়ে উঠলেন। না উদ্ভিদ না এবার কীটপতঙ্গ নিয়ে কাজ করবেন।
একদিন এক জলায় একটি মাকড়শাকে মাছ শিকার করতে দেখে ছবি তুলে ফেলেন। বসু দেখে খুব খুশি হয়ে তার সম্পর্কে পুঙ্খানুপুঙ্থ তথ্য অনুসন্ধান করে থিসিস তৈরি করতে বলেন।। এটিই প্রথম থিসিস যা ট্রানজাকশন (বুস ইনস্টিটিউটের মুখপত্র) এ প্রকাশ হয়। তার পর প্রাণী বিদ্যা ও কীটতত্ব এর উপর কয়েকটি পেপার লেখেন। বাংলার “পিপীলিকা অনুকারী মাকড়সা” প্রবন্ধে এক প্রজাতীর লাল পিঁপড়ে অনুকারী মাকড়সার নামকরন করেন “Propostira ranii” ( “রানী” গোপাল চন্দ্রের এক মাত্র কন্যার নাম)।
পিঁপড়া,মাকড়সা,ব্যাঙ্গাচি এবং ফড়িং এর উপর অনেক ছবি তোলেন। “আমেরিকার জাদুঘরের প্রকৃত ইতিহাস” সহ সব মিলিয়ে ২২টির মতো নিবন্ধ ইংরেজীতে প্রাকাশ পায়।
১৯৫১ সালে ইন্ডিয়ার সামাজীক পতঙ্গের উপরে নিবন্ধ পাঠের জন্য প্যারিসে অনুষ্ঠিত আর্ন্তজাতিক সভায় আমন্ত্রন করা হয়। কিন্তু দুঃখের ব্যাপার হলো সেখানে তার একাডেমিক শিক্ষাগত যোগ্যতার কারনে তার সাথে পক্ষপাতিত্ব করা হয় এবং উপস্থিত বিজ্ঞানিরা তার মতো সাধারন একজনের সাথে আলোচনা করতে অস্বীকার করে।
১৯৪০ সালের আগেই গোপাল চন্দ্র চট্টোপাধ্যায় প্রকৃতিবিজ্ঞানী হাসেবে নিজেক প্রতিষ্ঠত করেন। কলকাতার বসু ইনস্টিটিউডের কার্যাবলি নিয়ে একটি নিবন্ধ প্রকাশ করেন। সামাজীক পতঙ্গ যেমন পিঁপড়া, মৌমাছি ইত্যাদির রানী, কর্মীরা কি ভাবে জন্মায়, তাদের প্রজনন বেড়ে উঠা ইত্যাদি গভীর পর্যবেক্ষকৃত আর্টিকেল লেখেন। তার পরীক্ষন মূলত ভারতীয় কীটপতঙ্গের উপর। তিনি অনেক ধৈর্য ধরে কাঁচের জারের ভেতরে পিঁপড়ার বাসা তৈরি করে তাদের উপর নজর রাখেন। মুকুল, কচিপাতা ইত্যাদি নানান রকমের খাবার সরবরাহ করে তাদের কর্মকান্ড পর্যবেক্ষন করেছেন। তার এই গবেষনায় প্রাপ্ত ফলাফল ১৯৪০ সালে জার্নালে প্রকাশ করেন কিন্তু বিশ্বযুদ্ধের কারনে সেই ম্যাগাজিন তেমন প্রচার পায়নি।
তিনি দেখেছেন কিভাবে প্রানী হাতিয়ার ব্যবহার করেন। বোলতা ছোট ছোট পাথর দিয়ে তাদের ঘরের দরজা বন্ধ করে। earwigs নিজের ডিমকে রক্ষা করতে শত্রুর সামনের দুই হাত ব্যবহার করে মাটির ঢেলা ছুড়ে মারে। ঢেলা শেষ হয়ে গেলে খুব দ্রুত গতিতে মাটির বল তৈরি করে নেয়। প্রজননের সময় ছাড়া এমন আচরন আর কখনো দেখা যায়না। এই পর্যবেক্ষনটি করেন ১৯৪০ সালে। এই ব্যাপারে বাংলাতেই একটি নিবন্ধ লেখেন যার কারনে তা খুব বেশি প্রচারিত হয় নি।
১৯৪৮ সালে তিনি সত্যেন্দ্রনাথ বসুর সাথে মিলে ” বাঙ্গালী বিজ্ঞান পরিষদ” নামে একটি বিজ্ঞান গবেষনা সমিতি গঠন করেন।
পুলিন বিহারির মতো কয়েক জন বন্ধু মিলে বিজ্ঞানকে জনপ্রিয় করার জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করেন। ১৯৫০ সালে বাঙ্গালী বিজ্ঞান পরিষদের ম্যাগাজিন” বিজ্ঞান জানো” এর অফিসিয়াল সম্পাদক নিযুক্ত হন। ১৯৭৭ সালে তিনি এই ম্যাগাজিনের প্রধান উপদেষ্টা নিযুক্ত হন। বাংলা বিশ্বকোষ, ভারতকোষ সহ অনেক সংগঠনের সদস্য হিসেবে দ্বায়িত্ব পালন করেন।
বিজ্ঞানকে জনপ্রিয় করার জন্যও তিনি কাজ করেন। বিশেষ করে “Kara dekha (করে দেখা)” নামে তিন খন্ডের বই প্রকাশ করেন। তার কর্মজীবনে তিনি প্রায় ১০০০ এর মতো বিজ্ঞান বিষয়ে আর্টিকেল লেখেন যার বেশির ভাগই বাংলায় এবং তা প্রচুর জনপ্রিয়তাও পায়।
১৯৬৫ সালে অফিসিয়াল কাজ থেকে আবসর নেন কিন্তু কীটপতঙ্গ নিয়ে কাজ করা এবং লেখা লেখি অব্যহত রাখেন।
তার মৃত্যুর তিন মাস আগে কালকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তাকে সম্মানস্বরুপ বিজ্ঞানে ডক্টরেট ডিগ্রী প্রদান করেন। এই বছরই তিনি বার্ধক্যজনিত কারনে পরোলোকগমন করেন।
List of works
Adhunik Avishkar(Modern Inventions)
Banglar Makarsha (Spiders of Bengal, 1949)
Banglar Kita-patanga (Insects of Bengal, 1975)
Kare Dekha (Do and see)
Acharya Jagdish Chandra Bose(Biography) 1963.
Mane Pare (Reminiscences) 1977.
Pashu Pakhi Jibjantu(Plants and animals)
Bigyaner Akasmik Aviskar (Accidental Discoveries of Science).
Translation works on The Atom Bomb, Space Journey.
Awards and citations
1951 – Invited to conduct the Indian delegation at the International Union for the Study of Social Insects
1968 – Ananda Purashkar
1974 – Felicitation at Bose Institute of Science.
1974 – Acharya Satyendranath Bose Award
1975 – Rabindra Puraskar
1979 – Jubilee Medal on the Diamond Jubilee Celebration Of The Bose Institute.
1980 – Honorary D.Sc degree by Calcutta University.