বুর্জ খলিফা, বর্তমান পৃথিবীর উচ্চতম বহুতল যা রয়েছে আরব আমিরশাহী-র দুবাই শহরে। কলকাতার একটা পূজা কমিটি বহুতলটির আদলে মন্ডপ তৈরি করার পর থেকেই বাঙ্গালিদের মধ্যে ভবনটি নিয়ে উৎসাহের শেষ নেই। কিন্তু জানেন কি পৃথিবীর উচ্চতম এই বহুতলে রয়েছে আরব জাতির বিরাট মুর্খামির নিদর্শন ?
কয়েক বছর আগে সোশ্যাল মিডিয়াতে একটা ভিডিও ভাইরাল হয়েছিল, যেখানে দেখা যাচ্ছিল প্রায় শত শত মল-বোঝাই ট্রাক দুবাইর বাইরে যাচ্ছে। পরে জানা যায় ট্রাক গুলো বুর্জ খলিফা থেকে মল নিয়ে শহরের বাইরে ফেলতে যাচ্ছিল যা প্রায় প্রত্যেক দিনই তাদের করতে হয়। কারণ বুর্জ খলিফা নিকাশী ব্যবস্থা-বিহীন একটা বহুতল। ঠিক পড়েছেন, বুর্জ খলিফা নিকাশী ব্যবস্থা বিহীন এবং এই বহুতলের সঙ্গে শহরের নিকাশি ব্যবস্থা যুক্ত নয়।
শুনতে অবাক লাগলেও কথাটা শতভাগ সঠিক। পেট্রোডলারে ফুলে ফেঁপে ওঠা, সাধারণ জ্ঞানহীন আরবদের চুরান্ত মুর্খামির ফলে, বুর্জ খলিফাকে শহরের নিকাষী ব্যবস্থার সঙ্গে যুক্তই করা হয়নি।
যদিও এটা নতুন কিছু নয়, কারণ প্রথাগত ভাবেই আরবরা শিক্ষা বিমুখ জাতি। বিংশ শতকে আরব উপদ্বীপে খনিজ তেলের ভান্ডার আবিস্কার হওয়ার পর থেকে বর্বর এবং যাযাবর জাতিটার হাতে প্রচুর টাকা আসে। সেই টাকা তারা আমোদ প্রমোদের সামগ্রী, অত্যাধুনিক যুদ্ধাস্ত্র, ক্রীতদাস এমন কি যৌনদাসী কিনে খরচ করলেও, বিশ্বমানের ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার তৈরি করার কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয় তৈরি করতে খরচ করেনি। খরচ করেনি একটাও আইটি হাব তৈরির জন্য। আধুনিক ইলেক্ট্রনিক্স ও বৈদ্যুতিন যন্ত্রাংশ বা প্রাণদায়ি ওষুধ বা অটোমোবাইল বা কৃষিকার্যে ব্যবহৃত যন্ত্রাংশ প্রভৃতি তৈরির কোন সংস্থা তারা স্থাপন করার জন্য ঐ টাকা খরচ করেনি। কথায় বলে, “অর্থবলে অন্ধ, জ্ঞানহীন ধনী গর্ধব-সম” ওরা হয়েতো ঐ প্রবাদকে সঠিক প্রমাণের চেষ্টায় আছে। যাইহোক সে সব অন্য আলোচনা। মূল বিষয় ফিরে আসা যাক।
বুর্জ খলিফা নিকাশী ব্যবস্থা-বিহীন একটা বহুতল, জেনে নিশ্চই অবাক হচ্ছেন, এর কারণ জানলে আরও অবাক হবেন।
আসলে আমীরশাহির আরবরা একবিংশ শতকের প্রথমে তাদের বাণিজ্য নগরী দুবাইকে বিদেশি ও দেশীয় মানুষদের কাছে আকর্শনীয় করে তোলার জন্য বেশ কিছু সংস্কার করে, যার মধ্যে অন্যতম সেখানের শুল্ক বা ট্যাক্স ব্যবস্থার পরিবর্তন। এই পরিবর্তনের মাধ্যমে ঐ শহরের ইনকাম ও সেলট্যাক্স সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করে দেওয়া হয়। যার ফলে ট্যুরিজম ও অন্য সীমিত কিছু পন্থাই ওদের রোজগারের উৎস হয়ে দাঁড়ায়। দুবাইকে আকর্শনীয় করতে গিয়ে, এয়ার এমিরেটসের উন্নয়ন, বুর্জ খলিফা তৈরি সহ বিভিন্ন কন্সট্রাকশন প্রোজেক্টের পরিকল্পনা করা হয়। এই পরিকল্পনা গুলোকে সফল করার লক্ষ্যে কয়েক বিলিয়ন ডলার তারা বিদেশ থেকে ধার করতে বাধ্য হয়। কারণ সংস্কার করে নিজেদের রোজগারের রাস্তা কমিয়ে দিয়েছিল তারা। এই ধারের ফলে এক সময় তাদের দেশে ৭৭%-র বেশি ফিসকাল ডেপ্ট হয়ে যায়। ঠিক ঐ সময়ই গদের উপর বিষফোঁড়া হয়ে ওঠে ২০০৮ সালের বিশ্বজোড়া মহামন্দা বা গ্লোবাল রিসেশন। এমতাবস্থায় আরবরা বিভিন্ন প্রজেক্ট থেকে কস্ট কাটিং-র জন্য কিছু অপ্রয়োজনীয় অংশ বাদ দেবে বলে ভাবনা চিন্তা ভাবনা শুরু করে। ঠিক সেই সময়ই একদল বুদ্ধিমান আরব অর্থনীতি ও প্রযুক্তিবিদ সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয়, বুর্জ খলিফাকে শহরের নিকাশি ব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত করা হবে না। কারণ নিকাশি ব্যবস্থার জন্য খরচ হবে নো রিটার্ন ইনভেস্টমেন্ট। তাই ঠিক করা হয় বুর্জ খলিফাতে থাকা মানুষদের বর্জ্র্য ওখানেই সেফটি ট্যাঙ্ক বানিয়ে জমিয়ে রাখা হবে এবং সময় মতন ট্রাকে করে সেগুলো নির্দিষ্ট স্থানে ফেলে আসা হবে। বুর্জ খলিফার নির্মাণ সংস্থা সমস্যাটা বোঝাতে চাইলেও তারা বুঝতে চায়নি। এখানে সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছিল আরবদের ভুল হিসেব নিকেষ, অদূরদর্শিতা এবং অর্থ বলে অন্ধ হয়ে গিয়ে নিজেদের সবজান্তা মনে করার ভাবনা।
উদ্বোধন হওয়ার পর গোটা বিশ্ব থেকে দলে দলে মানুষ আসতে এবং থাকতে শুরু করে বুর্জ খলিফায়। একটি সংস্থার দেওয়া পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বহুতলটিতে একসঙ্গে প্রায় ৩৫ হাজার মানুষ থাকতে পারে। ঐ ৩৫ হাজার মানুষের শৌচকর্মের ফলে প্রত্যেক দিন প্রায় ৭ টন বর্জ্র্য সৃষ্টি হয়। শৌচাগারে ব্যবহৃত জলের সঙ্গে মিশ্রিত হয়ে যার পরিমাণ হয়ে যায় প্রায় ১২১৫ টনের মতন। কস্ট কাটিঙের হিসেব নিকেষ করার সময় এই বিষয়টা আরবরা সম্পূর্ণ ভাবে এড়িয়ে যায়, কারণ তারা মনে করেছিল ইহা অপ্রয়োজনীয় ও আর্থিক ভাবে অলাভজনক।
টাকা থাকলেই যে বুদ্ধিমান, দুরদর্শী এবং আধুনিক মনস্ক হওয়া যায়না, নিকাশি ব্যবস্থা বিহীন বিশ্বের উচ্চতম বহুতল নির্মাণ তার অন্যতম উদাহরণ। তাই অর্থ বলে বলিয়ান মুর্খের, বুদ্ধিমান সাজার প্রচেষ্টার ফলে বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ট ইঞ্জিনিয়ারিং প্রোজেক্ট হওয়ার পরেও, পৃথিবীর উচ্চতম বহুতল হওয়ার পরেও কলঙ্ক যুক্ত চাঁদ হয়েই রয়ে গেছে মধ্যযুগের মতন নিকাশি ব্যবস্থা বিহীন বুর্জ খলিফা।
লেখক : অনিক বোস
https://inhabitat.com/the-incredible-story-of-how-the-burj-khalifas-poop-is-trucked-out-of-town/