মেদিনীপুর কলেজ। ক্লাস চলছে। রাশভারী এক অধ্যাপক ক্লাস নিচ্ছেন। পড়ানোর পাশাপাশি মাঝেমাঝে ব্ল্যাকবোর্ডের দিকে ঘুরে চক দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টগুলি লিখছেন। ক্লাসের শেষ বেঞ্চে বসেছেন দুই তরুণ। তাদের বিন্দুমাত্র উৎসাহ নেই ক্লাসে। চাপা কণ্ঠে তারা কিসব আলোচনা করে চলেছে। মনসংযোগ হারাল অধ্যাপকের।
- No Talk Please !
অধ্যাপকের তাড়া খেয়ে মিনিটখানেকের জন্যে চুপ থাকলেন ওই দুই তরুন। অধ্যাপক পুনরায় পড়ানোয় মেতে উঠলেন। নিজেদের মধ্যে পুনরায় আলাপচারিতায় মেতে উঠলেন দুই যুবক। আবার মনসংযোগ হারাল অধ্যাপকের।
- The two boys sitting in the last bench ! Can you please be silent ?
অধ্যাপকের ধমকে মাথা নিচু করলেন দুই যুবক। আবার পড়ানো শুরু করলেন অধ্যাপক। অধ্যাপক ব্ল্যাকবোর্ডের দিকে ঘুরে কিছু একটা লিখতে লাগলেন, এই সুযোগে সবার অজ্ঞাতে ক্লাসরুমের পিছনের দরজা দিয়ে ক্লাস থেকে বেরিয়ে গেলেন দুজনে।
ব্ল্যাকবোর্ডের লেখা শেষ হতেই সামনের দিকে তাকালেন অধ্যাপক। কিছুক্ষণের মধ্যেই অধ্যাপকের দৃষ্টি পড়ল শেষ বেঞ্চের দিকে। দেখলেন শেষ বেঞ্চের দুই যুবক আর ক্লাসে নেই। এবার মেজাজ হারালেন অধ্যাপক। উপস্থিতির রেজিস্টার খুললেন। রাগত স্বরে বলে উঠলেন –
- I mark them absent !
ক্ষনিকের বিরতি দিয়ে আবার বললেন –
- That boy from Dacca ! I dont understand what he is running after !
ক্লাসের বাকি ছাত্ররা পরস্পরের মুখ চাওয়া চাওয়ি করলেন। অধ্যাপক আবার পড়ানো শুরু করলেন। ক্লাস চলতে লাগল। এদিকে ওই দুই যুবক ক্লাসের বাইরে এসে কলেজ প্রাঙ্গণের গাছের তলায় বেঞ্চিতে এসে বসলেন দেখতে দেখতে জড়ো হলেন আরও কিছু যুবক। সকলেই ওই কলেজের ছাত্র। কিন্তু ওই জটলাতেও আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু হল ঢাকার সেই যুবক।
- দাদা আজকের দিনে এই গোটা মেদিনীপুর জেলাটাই খুব পিছিয়ে আছে। আপনার ঢাকা জেলার মত এখানকার জেলার লোকদের প্রাণ নেই।
- বল কি তোমরা! ভুলে গেলে এই জেলা বীরেন শাসমলের। কত আন্দোলন, কত ত্যাগ স্বীকার করেছে এখানকার লোকেরা সেই একুশ সাল থেকে।
- তা ঠিক। কিন্তু এখনকার ছাত্র ও যুবসমাজের সেই মনোভাব আর নেই। সবাই ভয়কাতর।
- কিন্তু মেদিনীপুরের মাটি সত্যেন বসুর মাটি। তাঁকে কি এই মাটির ছেলেরা ভুলতে পারে ?
- দাদা সত্যেন বসুর নামই জানেনা আজকালকার ছেলেমেয়েরা।
- এই নাম কেউ ভুলতে পারে না। তরুণদের রক্তে লেখা আছে এই নাম। সকলে তন্দ্রামুক্ত হোক। তাহলে দেখতে পাবে অজস্র সত্যেন বসু এই মাটিতে আবার জন্ম নিয়েছেন।
তরুণরা একে অপরের সাথে দৃষ্টি বিনিময় করলেন। কারও কারও চোখ চকচক করে উঠল।
- দাদা আপনি আমাদের সাহায্য করুন এই কাজে।
- আমি সর্বতোভাবে চেষ্টা করব তোমাদের জাগানোর। মেদিনীপুরের মাটির রক্তে বিপ্লব আছে। তোমাদের শুধু জেগে উঠতে হবে।
কথাবার্তা শেষ হল আরও মিনিট দশেক পর। যে যার ক্লাসে চলে গেলেন।
ঢাকা থেকে মেদিনীপুর কলেজে পড়তে আসা এই ছেলেটি সকলের থেকে আলাদা। চোখে উন্মুক্ত স্বচ্ছ দৃষ্টি। বুকে দুর্দমনীয় সাহস। পেশীবহুল স্বাস্থ্য আর প্রাণপ্রাচুর্যে ভরা মুখ। তিনি একধারে দার্শনিক, অন্যদিকে সাহিত্যিক। মাসিক “প্রবাসী” পত্রিকায় তাঁর লেখা গল্প ইতিমধ্যেই বিশেষ খ্যাতি লাভ করেছে। সাহিত্য বড় প্রিয় ছিল তাঁর। পড়তে ভালবাসতেন আশৈশব। রবীন্দ্রনাথের অন্ধ অনুরাগী।রবিঠাকুরের অজস্র কবিতা-গান ছিল মুখস্থ।তাঁর মত রবীন্দ্রানুরাগী আজকের দিনেও বিরল।
কিন্তু এইসব কিছুর উপরে ছিল তাঁর সাংগঠনিক দক্ষতা। মেদিনীপুরের অগ্নিযুগের যে নতুন অধ্যায়ের সৃষ্টি করেছিল তাঁর মূলে ছিলেন তিনি। তিনি ছিলেন মেদিনীপুরের বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স শাখার প্রতিষ্ঠাতা। একক প্রচেষ্টায় অসামান্য দক্ষতায় তিনি গড়ে তুলেছিলেন মেদিনীপুরের বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স শাখা।
শাসকের অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর সাহসই হোক বা বিপ্লবী আদর্শের গ্রামভিত্তিক প্রচার, মেদিনীপুর বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স কিছুদিনের মধ্যেই হয়ে উঠল বাংলায় অগ্রগণ্য। অবস্থা এমন হয়েছিল যে মেদিনীপুর বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্সের ছেলেদের তখন আটকে রাখা দায়। সকলের চাই অ্যাকশন।
যে যুবকের হাতের ছোঁয়ায় মেদিনীপুরের ঘুমন্ত দৈত্য সেদিন জেগে উঠেছিল তাঁর নাম দীনেশচন্দ্র গুপ্ত। বাড়ির সকলের আদরের ‘নসু’। অগ্রজদের কাছে দীনেশ এবং অনুজদের কাছে দীনেশদা।
বিপ্লবী দীনেশ গুপ্ত জন্মেছিলেন ১৯১১ সালের ৬ই ডিসেম্বর বর্তমান বাংলাদেশের ময়মনসিংহের নেত্রকোনা গ্রামে।তাদের আদি বাড়ি ছিল ঢাকার যশলং গ্রামে | তাঁর পিতার নাম ছিল সতীশচন্দ্র গুপ্ত। আর মা ছিলেন বিনোদিনী দেবী। ছোটবেলায় দীনেশ গুপ্তের ডাকনাম ছিল ‘নসু’। যখন তিনি ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলের সপ্তম শ্রেণীর ছাত্র, তখনই যোগ দেন বিপ্লবী দলে। পড়াশোনায় তাঁর বিশেষ মন ছিল না। পাঠ্যক্রমের বাইরের বই পড়তেই বেশী ভালবাসতেন। বাবা সতীশচন্দ্র গুপ্ত ছিলেন পোস্টমাস্টার। বিপ্লবী দলে যোগ দেওয়ার কথা জানার পর বাবা তাকে প্রচন্ড মারতেন। কিন্তু দীনেশ বলতেন আমি যে পথে চলেছি স্বয়ং ঈশ্বরও আমাকে সেই পথ থেকে সরিয়ে দিতে পারবে না। হার মেনেছিলেন বাবা। দীনেশের বাবার ভয় ছিল ছেলের বিপ্লবী কাজকর্মের জন্যে তার পোস্টমাস্টারের চাকরি চলে যাবে। দীনেশ রোজ সকালে ঘুম থেকে উঠতেন ভোর চারটেয়। তারপর ব্যায়াম ও কুস্তি লড়তেন। সাড়ে ছয়টায় বাড়ি ফিরে পড়তে বসতেন। রাতে বিপ্লবী কাজকর্ম করে ফিরতেন অনেক রাতে। বাবা তাকে এরপর মেদিনীপুরে পাঠিয়ে দেন। সেখানে দীনেশের দাদা জ্যোতিষচন্দ্র গুপ্ত থাকতেন। দীনেশের দাদা জ্যোতিষ গুপ্ত ছিলেন মেদিনীপুর আদালতের স্বনামধন্য আইনজীবী। সেখানেই দীনেশ প্রতিষ্ঠা করেন বেঙ্গল ভলেন্টিয়ার্সের মেদিনীপুর শাখা। এরপর তিনি ঢাকা ফিরে আসেন। ১৯২৮ সালে তিনি ঢাকা কলেজ থেকে আইএসসি পরীক্ষা দেন। কিন্তু পড়াশুনার চেয়ে বিপ্লবী দলের কাজকর্মের উপর বেশি গুরুত্ব দেওয়ার কারণে তিনি আইএসসি’তে পরীক্ষা দিয়ে কৃতকার্য হতে পারেননি। দীনেশ ছিল ভীষণ জেদি আর প্রতিবাদী। একবার উয়ারিতে দুই যুবক কিছু মেয়েকে কটূক্তি করেছিল। দীনেশ দেখতে পেয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন ছেলেদুটির উপর। মেরে একজনকে মাথা ফাটিয়ে দিয়েছিলেন। এতটাই নির্ভীক ছিল দীনেশ। মেদিনীপুরে বেঙ্গল ভলেন্টিয়ার্স শাখা তৈরী করার পর দলে বলেছিলেন “আমাকে কাজের মত কাজ দিন। আমি ছোটোখাটো কাজ করার ছেলে নই।”
সেই কাজটাই ছিল ১৯৩০ সালের ৮ ডিসেম্বর ‘রাইটার্স বিল্ডিং’ আক্রমণ এবং কারা বিভাগের সর্বময় কর্তা ইন্সপেক্টর জেনারেল কর্নেল সিম্পসন হত্যা। ওই অভিযানের পর আহত অবস্থায় গ্রেফতার হন দীনেশ ও বিনয়। আত্মহত্যা করেন বাদল। ডাক্তার ও নার্সদের আপ্রাণ চেষ্টায় দীনেশ ক্রমশ সুস্থ হয়ে উঠেন। চিকিৎসার পর তাঁকে হাসপাতাল থেকে ‘কনডেমড’ সেলে নেয়া হয়। দীনেশের বিচারের জন্য আলীপুরের সেশন জজ মি. গ্রালিকের সভাপতিত্বে ব্রিটিশ সরকার এক ট্রাইবুন্যাল গঠন করে। দীনেশের ফাঁসির আদেশ দেওয়া হয়। অবশেষে ইংরেজ সরকার ১৯৩১ সালের ৭ জুলাই, ১৯ বছর ৭ মাস বয়সী দীনেশের ফাঁসি কার্যকর করে।
আলিপুর জেলে বসে বাড়ির লোকদের উদ্দেশ্যে বহু চিঠি লেখেন দীনেশ। যার মধ্যে ৯২ টি চিঠি পাওয়া যায়। সেই চিঠি যা মানুষের জীবনদর্শন বদলিয়ে দিতে পারে। নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু দীনেশের সেই চিঠি পড়ে বলেছিলেন,” এগুলো শুধু চিঠি নয়, এগুলো মূল্যবান জীবনদর্শন।” দীনেশ সময়ের থেকে বহুকাল এগিয়েছিলেন ওই চিঠিগুলো তার প্রমাণ। চিঠিগুলিতে ধরা রয়েছে উনিশের যুবকের চিন্তার ব্যাপ্তি, জীবনদর্শনের গভীরতা।
বৌদিকে যেমন লিখছেন, “যে দেশে মানুষকে স্পর্শ করিলে মানুষের ধর্ম নষ্ট হয়, সে দেশের ধর্ম আজই গঙ্গার জলে বিসর্জন দিয়ে নিশ্চিন্ত হওয়া উচিত”, ভাই-কে তেমনই দিশা দেখাচ্ছেন জীবনবোধের, “যুগ যুগ ধরিয়া এই যাওয়া আসাই বিশ্বকে সজীব করিয়া রাখিয়াছে, তাহার বুকের প্রাণ স্পন্দনকে থামিতে দেয় নাই।” আর সান্ত্বনার পরশ দিতে চাইছেন শোকাচ্ছন্ন মা-কে, “তাঁহার বিচার চলিতেছে। তাঁহার বিচারের উপর অবিশ্বাস করিও না, সন্তুষ্ট চিত্তে সে বিচার মাথা পাতিয়া নিতে চেষ্টা কর।”
দীনেশের জীবন শুধুমাত্র সিম্পসন হত্যার মধ্যে দিয়েই শেষ হয় না। দীনেশের হত্যার বদলা নিয়েছিলেন বাংলার বিপ্লবীরা। দীনেশের মৃত্যুদণ্ডের আদেশকারী গার্লিককে হত্যা করেছিলেন বিপ্লবী কানাইলাল ভট্টাচার্য। দীনেশের হাতে গড়া মেদিনীপুর বেঙ্গল ভলেন্টিয়ার্সের বিপ্লবীরাই জেলাশাসক পেডি, ডগলাস, বার্জ হত্যা করেছিলেন। পেডিকে হত্যা করেছিলেন বিমল দাশগুপ্ত ও জ্যোতিজীবন ঘোষ। ডগলাসকে হত্যা করেছিলেন প্রদ্যোতকুমার ভট্টাচার্য ও প্রভাংশুশেখর পাল। বার্জকে হত্যা করেছিলেন অনাথবন্ধু পাঁজা ও মৃগেন্দ্রনাথ দত্ত। আক্রমণ করা হয়েছিল ভিলিয়ার্সকেও। যদিও বিপ্লবী বিমল দাশগুপ্তের সেই চেষ্টা সামান্যের জন্যে ব্যর্থ হয়।
দীনেশ চন্দ্র গুপ্ত। জন্ম: ৬ ডিসেম্বর, ১৯১১।
প্রয়াত ব্যক্তিদের মৃত্যুকাল লেখাই রীতি। এই লেখায় যা অনুসরণ করার কোন প্রয়োজন দেখছি না। উনি মৃত্যুঞ্জয়ী। কী এসে যায় শারীরিক পূর্ণচ্ছেদে, অমরত্বের আশ্বাস যখন বিস্তৃত স্থান-কাল-পাত্রের সীমানা ছাড়িয়ে?
জয় দীনেশ।