বালুঘাটা এড়াইল বেনিয়ার বালা।
কালীঘাটে এল ডিঙ্গা অবসান বেলা।
মহাকালীর চরণ পূজেন সদাগর।
তাহার মেলান বয়ে যায় মাইনগর।।
নাচনগাছা , বৈষ্ণবঘাটা বাম দিকে থুইয়া।
দক্ষিণেতে বারাসাত গ্রাম এড়াইয়া ।।
ডাইনে অনেক গ্রাম রাখে সাধুবালা।
ছত্রভোগে উত্তরিল অবসান বেলা।।
উজানি নগরের বিত্তশালী বণিক ধনপতি দত্তের সন্তান শ্রীমন্ত সদাগর ভাগীরথীর পথে চলেছেন সিংহল বাণিজ্যের নিমিত্ত যাত্রা করেছেন… সেই বিবরণ দিয়েছেন কবিকঙ্কণ মুকুন্দরাম চক্রবর্তী তাঁর #চন্ডীমঙ্গল কাব্যে। কাব্য রচনার সময়কাল ১৫৯৪ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৬০৬ খ্রিস্টাব্দ। রচনায় গ্রাম গুলির নাম উল্লেখ করতে গিয়ে একটি বিশেষ গ্রামের নাম তিনি নিয়েছেন , হ্যাঁ #বৈষ্ণবঘাটা। প্রাচীন সাহিত্যের বহু তথ্যে এই বৈষ্ণবঘাটা গ্রামের নাম পাই।
হ্যাঁ বর্তমান দক্ষিণ কলকাতার একটি উল্লেখ্য অঞ্চল হল বৈষ্ণবঘাটা । আমি সেই অঞ্চলের কথাই বলছি। কালীঘাটকে উত্তরে রেখে আদিগঙ্গার সমুদ্রগামী ধারা গড়িয়ার নিকট যেখানে দক্ষিণমুখী হয়েছে তারই উত্তর পারে বৈষ্ণবঘাটার অবস্থান। আজকে দক্ষিণ কলকাতার অন্তর্গত গড়িয়ার একটি বৃহৎ অংশ বৈষ্ণবঘাটা মৌজার মধ্যে পড়ে। বৈষ্ণবঘাটা একটি প্রাচীন ও বর্ধিষ্ণু গ্রাম ছিল।
শ্রীচৈতন্যদেব শান্তিপুর থেকে পুরী যাত্রার পথে তাঁর শিষ্য সমভিব্যহারে এই গ্রামে যাত্রা বিরতি করেছিলেন। সেই হতে এই স্থানের নাম হয় বৈষ্ণবঘাটা। কবিরাজ গোস্বামীর #চৈতন্যচরিতামৃত এবং বৃন্দাবন দাসের #শ্রীচৈতন্যভাগবত গ্রন্থে চৈতন্যদেবের ভাগীরথী তীরবর্তী স্থলপথ ধরে নীলাচলের পথে #আটিসারা গ্রাম হয়ে #ছত্রভোগ বন্দর পৌঁছানোর কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এই আটিসারা গ্রামই বারুইপুরের নিকট বর্তমান #আটঘরা গ্রাম।চৈতন্যদেব বারুইপুরের কাছে আটিসারাতে অনন্ত পন্ডিতের আতিথ্য গ্রহণ করেন। মথুরাপুর থানা অঞ্চলে ছিল ছত্রভোগ বন্দর।
গঙ্গা শিবপুর থেকে ব্যাতাইতলার মধ্যেকার অঞ্চল এবং কালীঘাট, বারুইপুর, মগরা, গোচরণ, জয়নগর, দক্ষিণ বিষ্ণুপুর, ছত্রভোগ, বড়াশী, খাড়ি, কাশীনগর ও কাকদ্বীপের উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে দক্ষিণ-পশ্চিম সাগরদ্বীপে। সম্ভবত সাগরদ্বীপে প্রাচীন বীর বাঙালি সম্প্রদায় গঙ্গারিডিদের রাজধানী গঙ্গে বন্দরের অবস্থান ছিল। গঙ্গা এখানে প্রবেশ করে ধবলাট ও মনসা দ্বীপের মধ্য দিয়ে সমুদ্রে গিয়ে মিশত। এই আদি খাতটিকেই বলা হয় #আদিগঙ্গা।
আদিগঙ্গা তীরস্থ ছত্রভোগ প্রাচীনকালে প্রসিদ্ধ বাণিজ্য বন্দর ছিল। চীনা পরিব্রাজক হিউ-এন্ সাঙ্ এসেছিলেন এই ছত্রভোগে (৪র্থ শতক)। বড়াশীর কাছে প্রসিদ্ধ তীর্থস্থান #চক্রতীর্থ । এখানে বহু প্রাচীন #নন্দার_মেলা হয়। ছত্রভোগের পর গঙ্গা #শতমুখী ধারায় প্রবাহিত হয়েছিল। তাই এখানে এসে ভগীরথ শতমুখী গঙ্গার আসল ধারাকে চিনতে পারেননি। তখন গঙ্গা হস্তস্থিত চক্র দেখিয়ে তাঁর স্থান নির্দেশ করেন।
গঙ্গারিডি বা গঙ্গারিদাই জাতির মানুষের আবাসস্থল ছিল এই অঞ্চল। ২৪টি পরগনা সরাসরি গুপ্ত সাম্রাজ্যের অংশ ছিল না। গৌড় রাজ শশাঙ্ক এই অঞ্চলে শাসন কায়েম করতে পারেনি। পাল বংশের রাজা ধর্মপালের রাজ্যভুক্ত হয়েছিল বলে মনে করা হয়। তবে সেন যুগের বহু দেবদেবীর মূর্তি জেলার বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আবিস্কৃত হয়েছে।
কলকাতার শিয়ালদহের কাছে পুকুর খুঁড়ে প্রায় ৩০ ফুট নিচে সুন্দরী গাছের অনেক গুড়ি পাওয়া গিয়েছিল। মাতলার কাছে ১০-১২ ফুট মাটি খুঁড়ে একসময় দেখা গিয়েছে যে, একাধিক সুন্দরী গাছ কঙ্কালের মতো সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এ থেকে বোঝা যায়, বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন প্রাকৃতিক কারণে এ অঞ্চলের মাটি বসে গিয়েছে; সেজন্য ঘরবাড়ি, মন্দির, মূর্তি, রাজপ্রাসাদ ইত্যাদি কোন চিহ্ন এখানে দীর্ঘস্থায়ী হয়নি, তার অধিকাংশই মাটির তলায় সমাধিস্থ।
“মনসামঙ্গল” কাব্যে ২৪টি পরগনা জেলার অনেক জায়গার নামের উল্লেখ পাওয়া যায়। চাঁদ সওদাগর চম্পকনগরী থেকে যাত্রা শুরু করে তাঁর তরী ভাসিয়েছিলেন ভাগীরথীর প্রবাহে।তিনি কুমারহট্ট, ভাটপাড়া, কাকিনাড়া,মূলাজোড়, গারুলিয়া,ইছাপুর, দিগঙ্গা-চনক (ব্যারাকপুর),খড়দহ, চিৎপুর, কলিকাতা,কালীঘাট ইত্যাদি জায়গা পার হয়েছিলেন।তিনি চম্পকনগরী থেকে যাত্রা শুরু করে বারুইপুরেপৌছেছিলেন।
জানা যায়, গৌড় থেকে মাহিনগর (পাঠান সুলতানদের রাজকর্মচারী মহীপতি বসুর নামানুসারে এই গ্রামের নাম) পর্যন্ত ভাগীরথী গঙ্গার প্রবাহ ছিল।
গঙ্গার প্রাচীন প্রবাহ কালীঘাট দিয়ে পূর্ব-দক্ষিণ অভিমুখে বৈষ্ণবঘাটা, গড়িয়া, রাজপুর সোনারপুর, হরিনাভি, কোদালিয়া, চাংড়িপোতা, মালঞ্চ, মাহিনগর, শাসন, বারুইপুর, ময়দা, দক্ষিণ বারাসাত, জয়নগর মজিলপুর প্রভৃতি অঞ্চল দিয়ে বঙ্গোপসাগরে মিলিত হত৷ সাগর অভিমুখি গঙ্গাপ্রবাহপথের এই গ্রামগুলি ধর্মার্থীদের কাছে পবিত্র ছিল এবং সেজন্য দাক্ষিণাত্য বৈদিক ব্রাহ্মণরা এখানে বহুকাল আগে থেকে বসবাস শুরু করেছিলেন।
“চৈতন্যচরিতামৃত” গ্রন্থ ছাড়াও ২৪টি পরগনা জেলার অনেক জায়গার নামের উল্লেখ পাওয়া যায়।“মনসামঙ্গল” কাব্যে ও “চৈতন্যচরিতামৃত” গ্রন্থে পাওয়া বিভিন্ন জায়গার নাম ও বিবরণ তুলনা করলে দেখে যায় ২৪টি পরগনা জেলার উক্ত জায়গাগুলির অস্তিত্ব ছিল। চাঁদসদাগর বারুইপুরে পৌছে আদি গঙ্গা তীরবর্তী মনসামন্দির লুঠ করেন।
ষোড়শ শতাব্দীর মধ্যভাগে এই অঞ্চলের নদীপথে পর্তুগিজ জলদস্যুদের একচ্ছত্র আধিপত্য ছিল। পরবর্তী ১০০ বছর তাদের আধিপত্য বজায় ছিল উত্তর ২৪টি পরগনা ও দক্ষিণ ২৪টি পরগনার বসিরহাট অঞ্চলে। এই সময় পর্তুগিজ জলদস্যুদের (“হার্মাদ”) অত্যাচারে সুন্দরবনের অনেক সমৃদ্ধশালী জনপদ জনশূন্য হয়ে যায়। এখানকার নদীপথে যেতে যেতে অনেক জায়গায় জীর্ণ বাড়িঘরের, এক-আধটা মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ দেখা যায়।
১৭ শতাব্দীর শুরুতে প্রতাপাদিত্য, যিনি বারো ভুঁইয়াদের অন্যতম ছিলেন, যশোর,খুলনা, বরিশালসহ গোটা ২৪টি পরগনা জেলার অধিপতি ছিলেন। যশোররাজ প্রতাপাদিত্য পর্তুগিজ জলদস্যুদের সঙ্গে বারবার সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছিলেন। তিনি সাগরদ্বীপ, সরসুনা ,জগদ্দল প্রভৃতি অঞ্চলে দুর্গ বানিয়ে এদের আটকাবার চেষ্টা করেন। ১৮৯০ সালে সুন্দরবন সফরকারী এক ইংরেজ সাহেব রাজা প্রতাপাদিত্যের রাজপুরীর #ধ্বংসাবশেষ দেখতে পান; যা সেসময় ‘The Statesman’ পত্রিকায় ‘The Ruined City of the Sunderbans’ নামে প্রকাশিত হয়েছিল।
গড়িয়া পদ্মশ্রী সিনেমা হল, সেখানে ডান দিকে যে পুকুর সেটি বহু প্রাচীন এবং তার ঐতিহাসিক গুরুত্বও অসীম। এই পুকুরকে পূর্বে #গড়িয়া_পুকুর বলা হত। জনশ্রুতি আছে , যে ওই পুকুরের পাড়েই মহাপ্রভু তাঁবু খাটিয়ে অবস্থান করেছিলেন। তারপর গ্রামের ভিতর দিয়ে রথতলায় এসে ভাগীরথীতে স্নান করেছিলেন।
বৈষ্ণবঘাটা মৌজাটি #খাসপুর পরগনার অধীন ছিল। এই পরগনা উত্তর পশ্চিম দিকে অনেকটা বিস্তৃত ছিল। কালীঘাট কালীমন্দির এই পরগনার অন্তর্গত ছিল। তারপর এটি চব্বিশ পরগনার অন্তর্গত হয়। এখন তো কলকাতা হয়ে গেছে। সে বৈষ্ণবঘাটা শহুরে হাওয়ায় উড়ে গেছে।
ক্রমশঃ….
দুর্গেশনন্দিনী
তথ্যঃ বৃহত্তর গড়িয়ার ইতিহাস