চন্দ্রপূজন ও বঙ্গের বিলুপ্ত এক ব্রতকথা পর্ব – ২

গঙ্গা গঙ্গা ইন্দ্র চন্দ্র বাসুকি

তিন কুল ভরে দাও ধনে জনে সুখী।।


লৌকিক ব্রতের কালের প্রভাবে অদল বদল হয়ে গিয়েছে। এখন যে ব্রতগুলি খাঁটি অবস্থায় প্রাপ্ত হয় , তার পরিমাণ যথেষ্ট সল্প এবং দু চারটি ব্যতীত অধিকাংশেরই খন্ড অসম্পূর্ণ। প্রাচীন বঙ্গে এত রকমের ব্রতপূজা ছিল, যে আজ পর্যন্ত কতক কতক সংগ্রহ করা সম্ভব হয়েছে, তবে অস্তঃপুরের জীবনযাত্রার বদলের কারণে এসকল ব্রত করবার এবং ব্রতগুলির অনুষ্ঠান ঠিকঠাক মনে রাখার চেষ্টাও ক্রমে চলে গিয়েছে। বর্তমানে যা অবস্থা চলছে , তাতে সমাজ খাঁটি, নকল, সম্পূর্ন , অসম্পূর্ণ সব চেহারাই না জেনে শুনে গ্রহণ করি। ব্রতের ছড়া গুলিও উল্টে পাল্টে গেছে। পঙক্তি পরিবর্তন , নিজেদের মতো করে নতুন ভাষা ব্যবহার, এক ব্রতের ছড়া অন্য ব্রতে ঢুকে সে একবারে তালগোল পাকিয়ে গেছে। 


এব্যতীত নানা গ্রামের নানা অনুষ্ঠান , এক রকমের ব্রত এখানে এক তো অন্যত্র আরেক। এমন সব নানা জঙ্গলের মধ্যে ব্রতের খাঁটি চেহারা কেবল একটি স্থান বা দেশ নয় সারা পৃথিবীর সনাতনী ব্রতের চেহারা নিয়ে কথা বলতে হয়। এই এখন যেমন চন্দ্র ব্রত নিয়ে বলছি। চন্দ্র ব্রত বা চাঁদকে কেন্দ্র করে পুজো, ব্রত যেমন – করবা চৌথ, পূর্ণিমাই নারায়ণ পুজো , পূর্ণিমা ধরে লক্ষ্মী পুজো, শুক্ল পঞ্চমীতে সরস্বতী পুজো, গ্রহ দোষ ইত্যাদি কাটাতে পূর্ণিমা বা চতুর্থীতে চন্দ্র পুজো , গুরুপূর্নিমা, রাখী বা ঝুলন পূর্ণিমা , রাসপূর্ণিমা, দোলপূর্ণিমা, বুদ্ধপূর্ণিমা….অমাবস্যা অমাবস্যায় কালীপূজাদি….চান্দ্রমাসকে কেন্দ্র করে সনাতনের যত উৎসব , কর্ম। 


দোল পূর্ণিমা অর্থাৎ চৈতন্যদেবের আবির্ভাব তিথির ঠিক পরের দিনটি গৌরাব্দের প্রথম দিন। সেদিন থেকে শুরু হয় বিষ্ণু মাস। গৌরাব্দের ১২টি মাসের নাম রাখা হয়েছে নারায়ণের ১২টি নাম অনুসারে। বিষ্ণু মাসের পর আসে মধুসূদন। তারপর যথাক্রমে ত্রিবিক্রম, বামন, শ্রীধর, ঋষিকেশ, পদ্মনাভ, দামোদর, কেশব, নারায়ণ, মাধব এবং গোবিন্দ মাস। আর থাকে পুরুষোত্তম নামের অধিমাস। গৌরাব্দের বৈষ্ণব পঞ্জিকা আসলে চান্দ্র এবং সৌর বর্ষগণনা পদ্ধতির মিশ্রণ। কিন্তু সৌরমাস ও চান্দ্রমাসের দৈর্ঘ্য এক নয়। সেই হিসেবকে মেলানোর জন্য গৌরাব্দের প্রতি তিন বছরে যোগ করা হয় একটি অতিরিক্ত মাস। সেটিই পুরুষোত্তম মাস। 

বৌদ্ধদের পবিত্র উৎসবগুলো প্রধানত পূর্ণিমাকেন্দ্রিক। বৈশাখ মাসের পূর্ণিমা রাতে বুদ্ধ পূর্ণিমা অনুষ্ঠিত হয়। এই রাতে সিদ্ধার্থ গৌতম জন্মলাভ, বুদ্ধত্বলাভ ও মহাপরিনির্বাণ লাভ করেন। তাই, এ দিনটিকে ‘বুদ্ধ দিবস’ হিসেবেও উদ্‌যাপন করা হয়। এছাড়া, বৌদ্ধদের পঞ্জিকানুসারে পালনীয় সন ‘বুদ্ধাব্দ’ এর নতুন বছরের সূচনা হয়, সেটিও চান্দ্রমাসের হিসাবে।

আষাঢ়ী পূর্ণিমায় সিদ্ধার্থ মায়ের গর্ভে আসেন। এছাড়া, যৌবনকালে আষাঢ় মাসের আরেক পূর্ণিমায় তিনি স্ত্রী-পুত্র-রাজ্য সংসার সবকিছুর মায়া ত্যাগ করে গৃহত্যাগ করেন।

মধু পূর্ণিমায় বুদ্ধ তার শিষ্যদের দুটি দলের মধ্যকার বিরোধ মীমাংসা করতে না পেরে অভিমানবশত এক গভীর অরণ্যে আশ্রয় নেন। সেখানে, একটি হাতি তার সেবা করেন। হাতিকে সেবা করতে দেখে বনের একটি বানরও বুদ্ধের সেবায় নিয়োজিত হয়। বানরটি বুদ্ধকে ভাদ্র মাসের পূর্ণিমা রাতে মধু পরিবেশন করে আপ্যায়ন করে।

বৌদ্ধ ভিক্ষুগণ তিন মাস বর্ষাবাসযাপনের পর কার্তিক মাসের পূর্ণিমা তিথিতে প্রবারণা পূর্ণিমা পালন করে থাকেন। এই তিথির সন্ধ্যায় আকাশে হাজারো ফানুস ওড়ানো হয়। এই পূর্ণিমার এক মাসের মধ্যে বৌদ্ধবিশ্বাসানুযায়ী শ্রেষ্ঠতম দানোৎসব তথা কঠিন চীবর দান উদ্‌যাপন করা হয়।

মাঘ মাসের এক পূর্ণিমা তিথিতে বুদ্ধ তার মহাপরিনির্বাণের ইচ্ছা ব্যক্ত করেন। এতে ভক্তরা ক্রন্দন শুরু করলে তিনি তাদেরকে ধর্মোপদেশ দান করেন।

গৃহত্যাগের পর বহুদিন পর্যন্ত সিদ্ধার্থের সাথে তাঁর বাবা-মা, স্ত্রী-পুত্র কারো সাথে সাক্ষাৎ হয় নি। অবশেষ বহুদিন পর সিদ্ধার্থের সংবাদ জানতে পেরে পিতা তাকে দেখবার জন্যে ব্যকুল হয়ে পড়েন। প্রথমে সাড়া না দিলেও পরে পিতার ব্যাপক অনুরোধের হেতু বুদ্ধ তাদের সাথে ফালগুনী পূর্ণিমায় দেখা করতে আসেন এবং তাদেরকে বিভিন্ন দীক্ষা দান করেন।

আশ্বিনী পূর্ণিমায় বৌদ্ধ ভিক্ষুগণ আষাঢ়ী পূর্ণিমায় শুরু হওয়া বর্ষাবাস যাপন সম্পন্ন করেন।

যাক, গত পর্বের ব্রতকথার বাকিটুকু বলি … তো সেই ধর্ম নাম্নী ব্রাহ্মণ যিনি দুঃখের কারণ সন্ধানে ধর্মের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেছিলেন, তিনি নানা জনের দুঃখের প্রশ্নের সম্মুখীন হয়ে, গ্রন্থি হাতে মহানদীর দুঃখী কুম্ভীরের পৃষ্ঠে সমুদ্র উত্তীর্ণ হয়ে পূর্ব মুখে চললেন।ঈশ্বরের সন্ধানে – 

দুর্গম কানন বহু গিরি উত্তরিল।

কিন্তু ধর্মের সন্ধান পেলেন না।  অনাহারে ক্লেশে চলন শক্তি নেই আর। তবুও ঈশ্বর ব্রাহ্মণকে দর্শন দিলেন না । ধর্মের সন্ধান না পেয়ে ধর্ম নাম্নী ব্রাহ্মণ মৃত্যু বরণ করতে গেলেন। 

এমতাবস্থায় ভক্তের ভগবানের পাষান গলে গেল। 

” দ্বিজের দেখিয়া হেন উদাস লক্ষণ।

দয়াযুক্ত হল তবে গোবিন্দের মন।।”

ধর্ম এসে ধর্ম নাম্নী দ্বিজকে স্বরূপ দর্শন করালেন। দ্বিজ ধর্ম দ্বিজরূপী ঈশ্বর ধর্মকে প্রশ্ন করলেন , ” জন্মাবধি দুঃখ পাই কিসের কারণ?”

তখন ধর্ম ব্রাহ্মণকে বললেন –

“ধান্য- পূর্ণিমার ব্রত কর দ্বিজমণি।

কুবের সমান ধনে তুমি হবে ধনী।।

এই ব্রত করে ইন্দ্র হল দেবরাজ।

ব্রত কর দ্বিজ করিও না ব্যাজ।।

পৌষের পূর্ণিমা অদ্য হল উপস্থিত।

ধন আকাঙ্ক্ষিয়া দ্বিজ কর সেই ব্রত।।”

পূজার যত নিয়ম আচার, পূজার যত শুদ্ধ বিচার সকলই ধর্ম ব্রাহ্মণকে বললেন। সন্ধ্যা হয়ে এলে, আকাশে সোনার থালার মতো উজ্জ্বল চন্দ্র প্রকাশিত হল। ব্রাহ্মণ নির্দেশ মতো পূজায় বসলেন। 

“গনেশাদি পঞ্চদেব অগ্রেতে পূজিয়া ।

করিল চন্দ্রের পূজা পাদ্য অর্ঘ্য দিয়া।।

নৈবেদ্য , ধূপ, দীপ, পুষ্প ইত্যাদি ষোড়শ কলা উপাচারে ব্রাহ্মণ চন্দ্রের উপাসনা করলেন। ব্রাহ্মণের ভক্তি দেখে চন্দ্র তখন ঘটে উদয় হলেন। চন্দ্রদেবের দর্শন পেয়ে ব্রাহ্মণ গলবস্ত্র হয়ে চন্দ্রদেবের স্তব করলেন। সেই স্তবেই ব্রতকথার মূল মাহাত্ম্য অর্থাৎ চন্দ্রদেবের মাহাত্ম্য প্রকাশ পেয়েছে – 

” নমো নমো নিশাপতি দরিদ্রের ধন।।

ষোড়শ কলাতে তুমি ত্রিজগত জনে।

ষোড়শে করেছে তৃপ্ত অমৃত সেচনে।।

তমোরাশি নাশি দীপ্ত কর ভূমন্ডল।

প্রসন্ন চকর চিত্ত ভুবন ধবল।।

উদিত হইলে তুমি আনন্দ সবার।

অস্তাচলে গেলে তুমি মহা অন্ধকার।।

যুবতি সাধবা তুষ্টা তব আগমনে।

চোর দস্যু ক্ষুণ্নচিত্ত তোমার কিরণে।।

কুমুদ কহলার আদি হয় প্রস্ফুটিত।

নানাবিধ শস্য হেতু তোমরা অমৃত ।।

অধম জানিয়া কৃপা আমাকে করিবে।

দারিদ্র সাগর হতে সদা নিস্তারিবে।।”

আত্মপরিচয় ব্রাহ্মণ চন্দ্রকে বললেন – 

” অন্ন বিনা আমি সদা দুঃখিত সংসারে।।

কিবা অপরাধে মম এ দুঃখ ঘটেছে।”

তখন বৃদ্ধ দ্বিজরূপী ধর্ম বললেন,  ” ব্রতভঙ্গ অপরাধে দুঃখিত সর্বথা।”

কোনো ব্রত আরম্ভ করেই তুমি সম্পূর্ণ কর নি। ব্রত আরম্ভের পর , সুফল ও ধন লাভ করে বার বার গৃহে ফিরে গেছ।  ” অনেক সম্পদলাভে কুমতি হইল। 

একেবারে পঞ্চোৎসবে চিত্ত মিলে গেল।।”

ব্রাহ্মণীও সেই মহানন্দে মত্ত হয়ে গেল।

“ভার্যাসহ সে ব্রত তুমি না করিলে।

পুত্র কন্যা দার সহ ভোজনে বসিলে।।”

সেইজন্য তোমার দুঃখের অন্ত নেই। অর্থাৎ , ” ব্রতের ফলে গেল দুঃখ ভাবিও না আর।” অর্থাৎ , তোমাকে এই ব্রত করে যেতে হবে।

ব্রাহ্মণ তখন হস্তে বাঁধা গ্রন্থি গুনে কাঠুরিয়া, কোঠারিয়া, বরজ, সুরভি, হস্তী, আম্রতরু এবং কুম্ভীরের দুঃখের কারণ জানতে চাইলেন। তখন ধর্ম বললেন- 

” ইন্দ্রের অপ্সরাগণে ব্রত করেছিল।

স্নান হেতু সরোবর নিকটেতে গেল।।

শীত নিবারণ হেতু অগ্নি জ্বালিবারে।

চাহে কাষ্ঠ যাবে কষ্ট অগ্নির সঞ্চারে ।।

কিন্তু কাষ্ঠ নাহি দিল কাষ্ঠকার দুষ্ট।

বৃথা হল মনোরথ পুরিল না ইষ্ট।।

কোঠারিয়া বরজে না দেয় চূর্ণ পান।

দুগ্ধবতী গাভী না করিল দুগ্ধদান।।

পূজার কারণে বৃক্ষ ফল নাহি দিল।

ব্রতীগণ অলঙ্কার করী হরে নিল।।

কুম্ভীর আগ্রহ করে নিতে ব্রতীপ্রাণ ।

সে হেতু দুঃখেতে কাল কাটায় এখন।।”

শুদ্ধচিত্তে বার বৎসর যে এই ব্রত করবে তারই মুক্তিলাভ ঘটবে। এই বলে #ধর্মদ্বিজ আপন মায়া প্রকাশ করে অন্তরিত হলেন। নিজ দোষে ব্রাহ্মণ কিন্তু কিছুই দেখতে পেলেন না। সেজন্য ব্রাহ্মণ তখন আকুল নয়নে রোদন শুরু করলেন। তখন ব্রতকথার কথক বলছেন- 

ওরে মন মূঢ়মতি   বলি কর অবগতি,

           কি গতি হইবে অন্তকালে।

কালের কুটিল গতি ,   কে বুঝিবে তার স্থিতি,

           তব গতি নাহি দেখি ফলে।।

দিন গেল ভাবি দারা,    দারা পুত্র কেবা তারা,

            তব ধারা কেহ নহে তারা।।

তারা ভাবে একা তারা,       তুই কেন তারা তারা,

             ভে’বে এবে হলি এই ধারা।।

যদি নিত্য ভাব তারা,          অনিত্য হইবে তারা

             নিত্য তারা করহ স্মরণ।

আশিব নাশিবে তারা,         মুদি নয়নের তারা,

              তারাপদ ভাব ওরে মন।।”

ব্রাহ্মণের ব্যাকুল ক্রন্দন দেখে দয়াময় সদয় হলেন। তখন দৈববাণী হোল – তুমি গৃহে প্রত্যাবর্তন করে ব্রত কর। তবেই তোমার দারিদ্র্যতা দূর হবে। ব্রাহ্মণ ধর্মের কথা মতো ফিরে গেলেন আপন গৃহে। প্রত্যাবর্তনের পথে সেই যে সপ্তপ্রাণীর সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়েছিল, তাঁদের সকলকে দুঃখের কারণ অবগত করে বললেন – তোমরা ভক্তি ভরে ব্রতীগণের সেবা করো ,তোমাদের মঙ্গল হবে। একথা শুনে কুম্ভীর তার উদরস্থ অন্ততঃ রতন উদ্গিরণ করে ব্রাহ্মণকে দান করল। ব্রাহ্মণ কুম্ভীরের দেওয়া গ্রন্থি খুলে ফেললেন। অমৃত বৃক্ষ এ কথা শুনে ব্রাহ্মণের সঙ্গী হল। হস্তী ব্রাহ্মণকে পৃষ্ঠে সওয়ার করল। সুরভী গাভী ব্রাহ্মণকে দুগ্ধ দানের উদ্দেশ্যে তার সঙ্গে চলল। বরজ ব্রাহ্মণকে তাম্বুল দানের একইভাবে উদ্দেশ্যে সঙ্গী হল। কোঠারিয়া , কাঠুরিয়ার দল ব্রাহ্মণের সঙ্গে তাঁর গৃহে চলল ব্রত পালনের উদ্দেশ্যে। 

বহুকাল বাদে ধর্ম নাম্নী ব্রাহ্মণ ধর্মের আদেশানুসারে আপন গৃহে ফিরে গেলেন। সেখানে ব্রাহ্মণী ও অন্যান্য সকল সঙ্গীকে নিয়ে ব্রত পালন করতে লাগলেন। ক্রমে সকলের দুঃখ দূর হল , অর্থ, মান ,যশ, খ্যাতি হল। 

কেশবকান্ত এ কাহিনী যুধিষ্ঠিরকে শ্রবণ করিয়ে বললেন – এতক্ষণ আমি তোমাকে ব্রত ভঙ্গের পাপের কথা বললাম।

” ব্রত ভঙ্গ করিবেন না সজ্ঞানে” 

সেই ধর্ম নাম্নী ব্রাহ্মণ যত দিন জীবিত ছিলেন ততদিন দারা পুত্র সহযোগে  ব্রত পালন করেছিলেন এবং খাদ্য ,বস্ত্র , বাসস্থানের অভাব তাঁদের আর হয় নাই। অতএব – 

” এক মনে ব্রত যেবা জন্মাবধি করে।

ভক্তিভাবে ব্রত কথা শুনে কর্ণ ভরে।।

সকল আপদনাশ তাহার নিশ্চয় ।

চন্দ্রের প্রসাদে সদা ধন পূর্ণ হয়।।”

ঘরের মাঝে বন্দী থেকে, নিজের অহংভাব  না তো  কর্ম ঠিক করে সম্পাদন করে নাতো জীবনের আস্বাদ নেওয়া যায় , নাতো ব্রহ্মময়ী কৃপা করেন, নাতো প্রকৃতি মায়ের অপার সৃষ্টিকে ভোগ করা যায়। গৃহে , দেহে, রিপুতে নিজেকে বেঁধে রাখলে তুমি, বাইরের অপার জোৎস্নালোক বাইরে পড়ে ক্রন্দন করতে লাগল , প্রবেশ পথ পেলে না কোন দিকে চন্দ্রালোক। পূর্ণিমার গভীর ইঙ্গিত ভরা মিলন রাত্রি যদি তোমার আত্মার সঙ্গে পরমাত্মার মিলন ঘটানোর অবসরই না পায়, তবে দিনের সংসারের জাঁতা কলে পিষ্ট হয়ে রাতের পরিপূর্ণ হৃদয়, মনের বিরতিকে পেলে কই ? মন সব কথা শেষ করে তো চেয়ে দেখলে না, এপারের এই অপরিপূর্ণ চাঁদের আলোকে ওপারের যে পরিপূর্ণতা তার দিকে ! পূর্ণিমার অভিসার সাজ ধরলে কোথায় মন , নিজের সমস্ত অপরিপূর্ণতার বাসক , সজ্জার মাঝে কোথায় জাগলো সে সারা রাত, ঘুমের ওপারে যে রয়েছে তার মিলন প্রতীক্ষায় ?

গীতায় বলা হয়েছে- 

যদা তে মোহকলিলং বুদ্ধির্ব্যতিতরিষ্যতি ।
তদা গন্তাসি নির্বেদং শ্রোতব্যস্য শ্রুতস্য চ ॥

পরমেশ্বর ভগবানে অর্পিত নিষ্কাম কর্ম অভ্যাস করতে করতে য্খন তোমার বুদ্ধি মোহরূপ গভীর অরণ্যকে সম্পূর্ণরূপে অতিক্রম করবে, তখন তুমি যা কিছু শুনেছ এবং যা কিছু শ্রবণীয়, সেই সবের প্রতি সম্পূর্ণরূপে নিরপেক্ষ হতে পারবে।

চন্দ্র যখন উদ্ভাসিত হয় নদীর উপর , আলোর সেতু আপনি এসে লাগে এই মৃত্যুলোকের আঁধার ঘাটে। সেই তরল আলোকের সেতু যেন হাওয়ায় ভাসে, জলে ভাসে – সেই পথ ধরে সাধক যাঁরা সত্যই পূর্ণিমায় জাগেন, তাঁদের মন যায় পরিপূর্ণতার দিকে। তারার ওপারে ওই যে নিমেষ হারা নয়ন তারার কালো , আলোয় হারিয়ে ফেলেন যাঁরা আপনাকে, তাঁদেরই প্রাণ পাখি জানে যথার্থ পূর্ণিমার খবর। পঞ্জিকা , জ্যোতির্বিজ্ঞান , ভূগোল এসবে পূর্ণিমা আসে ঘন্টা , সময় , তিথি , পল ইত্যাদি মিলিয়ে, যায়ও ঠিক নিয়ম মিলিয়ে। কিন্তু পূর্ণিমার যে পূর্ণিমা সে কারো দিকে আসে না – আলোর কাছে, বাতাসের কাছে- তার কথা শুধিয়ে চলতে হয়। তরল আলোকের সেতু , তারই উপর দিয়ে চলার পথ। সে পথে জীবিতের পায়ের ভর সয় না , এমন সেতু গভীর জলের মাঝে টলমল করছে তারি উপর অভিসার- সেই তো কবির ভাষায় শুক্লাভিসার।

ধবল বিভূষণ অম্বর ধরই

ধবলিম কৌমুদি মিলি তনু চলই। 

জল , স্থল, আকাশ ধবল সাজ পরলে, তার মধ্যে দিয়ে চলো মিলন – পিয়াসী।

প্রজহাতি যদা কামান্ সর্বান্ পার্থ মনোগতান্ ।

আত্মন্যেবাত্মনা তুষ্টঃ স্থিতপ্রজ্ঞস্তদোচ্যতে ॥

হে পার্থ ! জীব যখন মানসিক জল্পনা-কল্পনা থেকে উদ্ভূত সমস্ত মনোগত কাম পরিত্যাগ করে এবং তার মন যখন এভাবে পবিত্র হয়ে আত্মাতেই পূর্ণ পরিতৃপ্তি লাভ করে, তখনই তাকে স্থিতপ্রজ্ঞ বলা হয়। সাদা ফুলের মালা পরে- কর্পূর-চন্দনের শুভ্র পরিমলে সুরভিত হয়ে শুভ্রতার অবগুণ্ঠন টেনে চাঁদনীর স্রোতে গা ভাসিয়ে আলো- করা নদী বয়ে – সেই কালোর দিকে অভিসারে , যে কালো আলোর আলো। রূপ সে পরিপূর্ণ হল অরূপকে পেয়ে, খন্ডতা পড়লে অখণ্ড সুন্দর সাজ – আকারের আবরণ নিরাকারের ছন্দ পেলে!

ক্রমশঃ

©দুর্গেশনন্দিনী
তথ্যঃ চন্দ্র পূজার এক লৌকিক কাহিনী
(প্রবন্ধটি ঋতম্ বাংলায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.