প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর স্বপ্নের-প্রকল্প ‘কাশী-বিশ্বনাথ করিডোর’ উদ্বোধনের প্রস্তুতি পুরোদমে চলছে বারাণসীতে। বিগত ৩ বছর ধরে প্রায় ৮০ শতাংশেরও বেশি সম্প্রসারণের কাজ ইতিমধ্যে সম্পন্ন হয়েছে। প্রায় আড়াই বছর আগে করিডোরের ভিত্তিপ্রস্তর নির্মাণের জন্য প্রায় ৮০০ কোটি টাকা বরাদ্দ করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী নিজেই। করিডোরের কাজ সম্পূর্ণ সম্পন্ন হলে, প্রায় ১ লক্ষের বেশি ভক্ত নির্দ্বিধায় মন্দির প্রাঙ্গনে একত্রিত হতে পারবেন। এই মুহূর্তে নমোর বারাণসী সফরের সময়-সূচি প্রায় নিশ্চিত। ডিসেম্বর মাসের ১৩ ও ১৪ তারিখ ২ দিনের জন্য প্রধানমন্ত্রী তাঁর নির্বাচনী এলাকায় এসে ‘কাশি-বিশ্বনাথ করিডোরের’ উদ্বোধন করবেন বলে মনে করা হচ্ছে। অনুষ্ঠানের পাশাপাশি প্রায় এক মাসব্যাপী আরও বেশ কিছু কর্মসূচির পরিকল্পনাও করা হয়েছে।
বারাণসীর প্রাচুর্য এবং বিরোধীদের মুখে কুলুপ
এই করিডরটি প্রায় ৫.৩ লক্ষ বর্গফুট এলাকা জুড়ে নির্মিত এবং এই নির্মাণের জন্য আশেপাশের অনেক বাড়ি-ঘর থেকে বড় বড় ইমারত অধিগ্রহণ করা হয়েছিল। বিভিন্ন এলাকায় প্রায় ২৯৬টি ভবন অধিগ্রহণ করা হয়, যার মধ্যে রয়েছে ২২৭টি ব্যক্তিগত সম্পত্তি এবং ৩১টি সেবাদারসের ভবন। এছাড়াও, ১৩টি মন্দির-সহ পৌর নিগমের ৫টি ভূ-সম্পত্তি এবং বিভিন্ন ট্রাস্টের ২১টি সম্পত্তি-ও অধিগ্রহণ করা হয়।
এই ‘অধিগ্রহণের’ বিরোধিতা করেছিল সমাজবাদী পার্টি ও কংগ্রেসের মতো বিরোধী দলগুলি। বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়ায় সরব হয় তারা। রাজনৈতিক বিশ্লেকদের মতে, অল্পদিনই সোচ্চার হয়েছিল তারা। তারপরে বেনারসের উন্নয়নে চুপ হয়ে যেতে বাধ্য হয়। বিরোধীদলগুলোর এরপরের নীরাবতায় কৌশলগত জয়ের হিসাব কষছে বিজেপি। কাশী-বিশ্বনাথ মন্দিরের সরকারি অধিগ্রহণ কয়েক দশক আগে কংগ্রেস আমলেই হয়েছিল। পরবর্তীকালে বহুজন সমাজবাদী পার্টি এবং সপা সরকার তৎকালীন সময়ে মন্দির থেকে রাজস্ব সরকারি কোষাগারে স্থানান্তরিত করে নিজেদের জন্য প্রশংসা অর্জন করেছিল। কিন্তু বিজেপি সরকার অবশ্য ‘কাশী-বিশ্বনাথ’ করিডর নির্মাণের ক্ষেত্রে তাদের ছাড়িয়ে গিয়েছে।
লখনউয়ের প্রবীণ সাংবাদিক ডাঃ যোগেশ মিশ্রের মতে, ‘উত্তরপ্রদেশে বিজেপির ৩টি প্রধান ক্ষমতা কেন্দ্র রয়েছে। অযোধ্যা, কাশী, মথুরা। অযোধ্যার পর বিজেপি খুব বুদ্ধিদীপ্তভাবে কাশী মন্দিরের সমস্যাটির সমাধান করেছে। মথুরা এবং কাশীতে মন্দির এবং মসজিদগুলির ভৌগোলিক অবস্থানে জটিল সমস্যা রয়েছে। তাই, কাশী বিশ্বনাথ করিডর তৈরি করে বারাণসীতে মন্দিরটিকে একটি দুর্দান্ত রূপ দিয়েছে বিজেপি। ধর্মীয় রাজনীতিতে সংখ্যাগরিষ্ঠকে চটিয়ে বিজেপির হাত শক্তিশালী করতে চাইছে না কোনও বিরোধী দলই। কারণ, দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠের সমর্থনে দু’বার সরকার গঠন করেছেন নরেন্দ্র মোদী। উত্তরপ্রদেশও জিতেছেন এবং যোগী আদিত্যনাথের হাতে শাসনভার তুলে দিয়েছেন। উত্তর প্রদেশকে আবার জয় করার জন্য একটি কৌশলগত পদক্ষেপ কাশী বিশ্বনাথ করিডরের উদ্বোধন। বিজেপি এই তাস এতটাই বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে খেলেছে যে, বিরোধীদের চুপ থাকা ছাড়া আর কোন উপায় নেই। আজ মসজিদগুলি বিশাল মন্দির দ্বারা খর্বিত হয়েছে এবং শুধুমাত্র করিডরের জাঁকজমক রয়েছে সমগ্র আলোচনার মূল বিষয়।”
দক্ষ কর্মকর্তা, বিচক্ষণ আইনজীবী এবং কর্পোরেট
অনেক আগেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল যে প্রধানমন্ত্রীর এই স্বপ্নের প্রকল্পটি 2022 সালের বিধানসভা নির্বাচনের আগে নতুন করে তৈরি করতে হবে। ২০২৪ সালের আগে অযোধ্যা মন্দিরের উদ্বোধন হওয়ার কথা ছিল। তাই, কাশী বিশ্বনাথ করিডর নির্মাণের মতো জটিল কাজটি সম্পাদন করার জন্য, তাৎক্ষণিকভাবে প্রয়োজন ছিল দক্ষ এবং পরিশ্রমী অফিসারদের একটি ‘দল’ নির্বাচন করা।
বারাণসীর প্রাক্তন বিভাগীয় কমিশনার, নীতিন রমেশ গোকর্ণ, করিডর নির্মাণ শুরুর বিষয়ে তার আগের অভিজ্ঞতা থেকে উপকৃত হয়েছেন। কিন্তু প্রকল্পের কাজের আসল গতি তখনই দ্রুত হয়েছিল যখন আঞ্চলিক পরিষেবার প্রাক্তন দক্ষ অফিসার বিশাল সিংকে সরকার ট্রাস্টের সি.ই.ও-র অতিরিক্ত দায়িত্ব দেওয়া হয়। একই সময়ে, আই.এ.এস দীপক আগরওয়াল বারাণসী বিভাগের নতুন কমিশনার হিসাবে নিযুক্ত হয়েছেন। এই দুই কর্মকর্তার পারস্পরিক সমন্বয়ের কারণে করিডর বিস্তারের কাজ সুশৃঙ্খলভাবে শেষ করা হয়। স্থানীয় পর্যায়ে সকল প্রতিবন্ধকতাকেও দূর করা হয়। আবার এদিকে, করিডরের উন্নয়নে আইনি বাধা মোকাবেলার জন্য আইনজীবীরা স্থানীয় আদালতের এবং উচ্চ আদালতের দ্বারস্থ হন।
বিশাল সিং, গত বছর সি.ই.ও হিসাবে তার মেয়াদ শেষ করার সময়, অধিগ্রহণের ৯০ শতাংশেরও বেশি কাজ সম্পন্ন হয়েছিল। পর্যায়ক্রমে ভাঙনের ও সম্প্রসারণের কাজও চলছিল পুরোদমে। গত বছর, বিভাগীয় কমিশনার দীপক কুমার নিশ্চিত করেছিলেন যে করিডরটি নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সম্পন্ন হয়েছে। কোভিড -১৯ এর প্রথম এবং দ্বিতীয় তরঙ্গের কোনো প্রভাব পড়েনি করিডর নির্মাণের কাজে। এদিকে, নতুন সি.ই.ও সুনীল কুমার ভার্মাও অবশিষ্ট কাজের পর্যালোচনায় কোনো খামতি রাখেননি।
করিডর নির্মাণকারী আহমেদাবাদের কোম্পানির মত অনুযায়ী নির্মাণ কার্য চারটি পর্যায়ে সম্পন্ন হয়েছিল। শুরুতে প্রথম ও তৃতীয় ধাপ চালু করা হয়। প্রথম ধাপে মন্দির ও এর আশেপাশের এলাকা সম্প্রসারণ করা হয়, তৃতীয় ধাপে গঙ্গা নদীর তীর থেকে সম্প্রসারণ শুরু হয়। এতে নেপালি মন্দির এবং ললিতা ঘাটের মধ্যে এক কিলোমিটার প্রসারণ এবং জলসেন ঘাট, মণিকর্ণিকা ঘাট এবং সিন্ধিয়া ঘাট পর্যন্ত এলাকা অন্তর্ভুক্ত ছিল।এখন, ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় দ্বিতীয় এবং চতুর্থ পর্যায় নির্মাণের জন্য ভবনগুলি অধিগ্রহনের কাজ শুরু হয়।
বিরোধীদের নীরবতার বিষয়ে, আখড়া গোস্বামী তুলসীদাসের মহন্ত ডাঃ বিশ্বম্ভর নাথ মিশ্র বলেছেন, “যদিও আমরা রাজনৈতিকভাবে অনুপ্রাণিত মানুষ নই, আমরা বিরোধীদের বাধ্যতা বুঝতে পারি কারণ তাদের প্রতিবাদ করার কোনও কারণ ছিল না। প্রকৃতপক্ষে, বিরোধী দল একটি অনুশীলনকারী হিন্দু এবং নব্য-হিন্দুত্বের মধ্যে পার্থক্য বুঝতে ব্যর্থ হয়। করিডর নির্মাণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে না পারলেও সম্প্রসারণ ইস্যুতে ঐক্যমতের দাবি জানাতে পারলেন না কেন? সম্ভবত, এটা বললে ভুল হবে না যে একভাবে বিরোধী দলও এই পদক্ষেপের সমর্থনে নীরব অনুমোদন দিয়েছে।
প্রবেশদ্বারগুলির নতুন নাম
কমপ্লেক্স নির্মাণের আগে, মন্দিরের প্রবেশদ্বারগুলির নামকরণ করা হয়েছিল স্থানীয় পাড়া এবং এলাকার নামানুসারে। এতদিন চক-বিশ্বনাথ মন্দির সড়কে যে গেটগুলো পড়ত সেগুলোকে ভিআইপি গেট, ছত্তদ্বার গেট ও জ্ঞানভাপি গেট বলা হতো। একইভাবে, গোদৌলিয়া চক থেকে রাস্তাটিকে ধুন্ডিরাজ ফটক বলা হতো। এছাড়াও দশশ্বমেধ ঘাট, ললিতা ঘাট এবং কালিকা গলি থেকে মন্দিরে প্রবেশের পথকে সরস্বতী ফটক এবং মণিকর্ণিকা ঘাট থেকে প্রবেশ পথকে নীলকন্ঠ ফটক বলা হত। এখন যেহেতু এসব জায়গার বেশির ভাগই আর নেই, সেহেতু নতুন প্রবেশপথে নতুন নাম দেওয়া হবে।
মাকরানা ও চুনার পাথর দিয়ে তৈরি এই কমপ্লেক্সের চার দিকেই ৩৪ ফুট উচ্চতার চারটি নতুন প্রবেশ পথ তৈরি করা হয়েছে। একটি পথ ললিতা ঘাট থেকে শুরু হয় যেখান থেকে মন্দিরের চূড়া দেখা যায়। মন্দির চৌকির অংশটি এখন অর্ধচন্দ্রাকার-আকৃতিতে চক এবং গঙ্গা ঘাটের মধ্যে মোট ২৪টি ভবন তৈরি করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে মন্দির কমপ্লেক্স, মন্দির চত্বর, রিফ্রেশমেন্ট সেন্টার, গেস্ট হাউস, যাত্রী সুবিধা কেন্দ্র, জাদুঘর, আধ্যাত্মিক বই-কেন্দ্র এবং মুমুক্ষু-ভবন।
কাশী বিশ্বনাথ করিডরের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের জন্য চমৎকার পরিকল্পনা করা হয়েছে। দেব দীপাবলির মতো একটি উৎসব গঙ্গার ঘাট এবং অন্যান্য বিশিষ্ট স্থানে দু’দিন ধরে পালিত হবে। করিডরের জাঁকজমক দেখতে পাবেন সারাদেশের মানুষ। এই উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের পরে, বারাণসীতে এক মাস ধরে বেশ কয়েকটি অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হবে। এইভাবে, আগামী এক মাসের জন্য, ভারতীয় জনতা পার্টি এই বারাণসী সফর থেকে রাজনৈতিক সুবিধা নেওয়ার যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। যদিও পূর্বাঞ্চলের বেশিরভাগ গ্রামীণ এলাকায় ‘কাশী বিশ্বনাথ করিডর’ বিষয়টি বিজেপিকে কতটা বিরোধীদের চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন করতে পারবে, সেটাই দেখার বিষয়।