‘হরবরই’ বা ‘রয়্যাল’ বলে ডাকতাম। ইংরেজিতে Star Gooseberry. এ এক মজার ফল। হরবরই মানে ‘হর’ অর্থাৎ ‘শিব’ এবং ‘বরই’ অর্থাৎ কুল-সদৃশ টক ফল। সুতরাং দাঁড়ালো শিব-কুল। ছোটো থেকে শুনেছি, ‘কুল’ বা বরই বাগদেবীর আশীর্বাদ ধন্য ফল, তাই তার নাম ‘ভারতী-কুল’ ‘সর-বরই’, কারণ দেবী সরস্বতীর অপর নাম ‘ভারতী’।
ছোটোবেলায় দেখেছি, ‘খেতে চাই’ বললে কেউ তুলতে বারণ করে নি কখনও। পাখির আধ-খাওয়া ফল মাটিতে পড়ে থাকতো রাশি রাশি। বিনতি মাসি এই পুরুষ্টু পতিত-ফল কুড়িয়ে নিয়েই তো তেলসি-আচার বানাতেন। বলতেন, এই পাকা ফল খেতেই ভালো, আচারও হয় মোক্ষম। গ্রামগঞ্জ, নগরোপান্তের গৃহস্থ হয়তো ছোটোদের জন্যই বরাদ্দ রাখতেন এই গাছ। আর এত টক-টেঁশো ফল দামাল বাচ্চা ছাড়া কে-ই বা চেয়ে খাবে! গাছের জন্য বেশি জায়গা ব্যয় হয় না, ছায়াচ্ছন্ন স্থানেও খানিকটা ফল দেয়; পাতার বিটপের সৌন্দর্য তো অসাধারণ! গাছ-কাকি কেবল সাবধান করে দিতেন, ডালাপালা ভাঙ্গিসনে যেনো!
এই গাছ অনেকটা গুল্ম-সদৃশ বৃক্ষ ও গুল্মের মাঝামাঝি। কাড়াকাড়ি করে ফল পাড়তে গেলে দুই একটা ডাল ভেঙে আসে। আর ডাল ভাঙা মানে ছোটো-বড়, পুষ্ট-অপুষ্ট বহু ফল এবং সেই সঙ্গে কিছু ফুলও নষ্ট হয়। গৃহস্থের আপত্তি কেবল ওখানেই। বলতেন, তোদের জন্যই তো রেখেছি, হাভাতে-পনা করিস নে! একবার আধভাঙা ডাল দড়ি দিয়ে শক্ত করে বেঁধে দিয়েছিলাম, পরে দেখি জুড়ে গেছে ডাল।
আমলকি গোত্রের (Family:Euphorbiaceae) এই ফলে যথেষ্ট ভিটামিন-সি থাকে। ছোটোবেলায় বারোমাসে বারো ফল তো কুড়িয়ে বাড়িয়েই খেয়েছি। বারোমেসে মরশুমি ফল না খেলে নাকি মানুষ রসাতলে যায়! ‘রসাতল মানে কী?’ মঙ্কার বাবা বললেন, পাতালপুরী। বললেন, ফল না খেলে স্বর্গলাভ হয় না। ছোটোবেলায় আরও জেনেছি, মরশুমি ফল না খেলে নাকি রূপযৌবন বাড়ে না! তাই স্বর্গে দেবতা-গন্ধর্ব হওয়াও চলে না। মঙ্কাদের বাড়িতে ছিল একটি ‘বিচ্ছু’ রয়্যাল গাছ আর একটা বড় চালতা। যে ফল অসম্ভব রকম টক, ছোটোবেলায় তা খেয়ে আমরাও মুখ বেজার করে ফেলতাম, সেগুলি আমাদের কাছে ছিল, ‘বিচ্ছু’ পদবাচ্য; বলতাম ‘বাঘের জিভে লাগলে বাঘ পালায়’। আমরা তো টিঙ্কুদের আঁটিসারা ওই ছোটো গুটিআম মোটেই মুখে তুলতাম না। কিন্তু যেদিন কাটা পড়লো গাছটা, টিঙ্কুদের ছোটোকাকুর বাড়ি তৈরি হবে বলে, সেদিন মনটা প্রচণ্ড খারাপ হয়ে গেলো। ডায়েরিতে লিখে রেখেছিলাম, “আজ টিঙ্কুদের বিচ্ছু আমটিকে হত্যা করা হল।” চোখের জল বাঁধ মানে নি। এইরকম অনেক হরবরই ফল অনেক খেয়েছি, যা ‘বিচ্ছু পদবাচ্য’। তবে দুই একটি এমন ‘টাইপ’ পেয়েছিলাম, যা বেশ একটু টকমিষ্টি ভাব। তারার মতো ছোটো সাইজের এই ছেলে-ভোলানো ফলটি তখন স্কুলের ছেলেদের জামার পকেটে দু চারটি অবশ্যই পাওয়া যেতো। ফলের টাইপ ‘বেরি’, বিজ্ঞান-সম্মত নাম Phyllanthus acidus. এখন আর মুখে নিতে পারি না, জিভ ‘টকে যায়’। কিন্তু মনে পড়ে ছোটোবেলার স্মৃতিকথা। একটি অনুগল্প লিখেছিলাম তখন এই রয়্যাল ফলকে মনে রেখেই।
“অঢেল রয়্যাল, ভর্তি বাগান। দুটো রয়্যাল, হচ্ছে বাড়ি। একটা রয়্যাল, অনেক বাড়ি। অনেক বাড়ি। অনেক বাড়ি। ……..”
রয়্যাল একদিন আমাদের পাড়া থেকে সত্যিই হারিয়ে গেলো।
[প্রস্তুত ছবি ও ভিডিওর জন্য বিধানচন্দ্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফল গবেষণা কেন্দ্রের কাছে ঋণী। কৃতজ্ঞতা ICAR-AICRP on Fruits, BCKV, Mohanpur centre, Mondouri]
কল্যাণ চক্রবর্তী।