মানুষের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতাও কি ক্রমশ বিবর্তন ঘটাচ্ছে! না হলে এমন কী ভাবে হয়! ‘হিউম্যান ইমিউনোডেফিসিয়েন্সি ভাইরাস’ বা এইচআইভি সংক্রমিত এক তরুণীর শরীর থেকে হঠাৎই গায়েব ভাইরাস। ২০১৩ সালে এড্স ধরা পড়েছিল তরুণীর। তাঁর স্বামীরও এড্স ছিল। তিনি মারা যান। কিন্তু ভাইরাসকে ‘হারিয়ে’ দিয়েছেন তরুণী। বিস্মিত চিকিৎসকেরা। তাঁদের দাবি, প্রাকৃতিক ভাবে কারও এইচআইভি-মুক্ত হওয়ার ঘটনা বিশ্বে এই প্রথম।
আর্জেন্টিনার এসপেরানজ়া শহরের বাসিন্দা ৩০ বছর বয়সি এইচআইভি আক্রান্ত তরুণী আর পাঁচজন সংক্রমিতের মতো ছিলেন না। চিকিৎসকদের পরিভাষায় ‘এলিট কন্ট্রোলার’ ছিলেন তরুণী। অর্থাৎ কি না, তিনি সংক্রমিত হওয়ার বহু বছর পড়ে এইচআইভি-র উপস্থিতি ধরা পড়ে শরীরে। অসুখ ধরা পড়ার পরে ওষুধ খেতে শুরু করেন তিনি। তার পরে আচমকাই এই ঘটনা। এক সময়ে তিনি ওষুধ খাওয়া বন্ধ করে দেন। কিন্তু অসুখ আর ফিরে আসেনি। যেটা সাধারণত হয় না। সম্প্রতি এই সংক্রান্ত একটি রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে আমেরিকান জার্নাল ‘অ্যানালস অব ইন্টারনাল মেডিসিন’-এ।
মানব শরীরে যে কোনও ভাইরাস সংক্রমণের পরে দেখা যায়, ভাইরাসটি শরীরে প্রতিলিপি গঠন করতে থাকে। এই আর্জেন্তিনীয় তরুণীর ক্ষেত্রে দেখা গিয়েছে, তাঁর ডিএনএ-তে ভাইরাসের উপস্থিতির কোনও ছাপ নেই। অর্থাৎ ‘প্রোভাইরাস’ গঠন হয়নি। ‘প্রোভাইরাস’ হল— যখন ভাইরাসের জেনেটিক মেটেরিয়াল মানব কোষের (হোস্ট সেল) ডিএনএ-র মধ্যে ঢুকে যায় এবং মানব কোষের জিনোমের সঙ্গেই প্রতিলিপি গঠন করতে থাকে। এ ক্ষেত্রে গবেষকেরা বহু ‘তল্লাশির’ পরেও ভাইরাসের অস্তিত্ব খুঁজে পাননি তরুণীর দেহে। তাঁরা বলছেন, এটিকে বলে ‘স্টেরিলাইজ়িং কিওর’। অর্থাৎ, ওই তরুণীর শরীরের ভাইরাসের কোনও প্রতিলিপি নেই।
কিন্তু কী ভাবে এই ঘটনা ঘটল? বিজ্ঞানীরা বলছেন— ‘রহস্য’। এর আগেই দু’জন এইচআইভি রোগীর সুস্থ হয়ে ওঠার নজির রয়েছে। কিন্তু তাঁদের রক্তের ক্যানসার ছিল। সে জন্য তাঁদের দীর্ঘ চিকিৎসা চলেছিল। স্টেম সেল প্রতিস্থাপণও করা হয়েছিল। তার পরে এক সময়ে তাঁরা এইচআইভি-মুক্ত হন। কিন্তু এ ক্ষেত্রে এ সব কিছুই হয়নি। সবটাই ঘটেছে প্রকৃতির নিয়মে। এবং কী ভাবে হল, তার কোনও উত্তর নেই চিকিৎসকদের কাছে। একটি বিষয়েই শুধু তাঁরা দ্বিধাহীন। তা হল— ‘‘এই রোগ থেকে সেরে ওঠা সম্ভব।’’
বস্টনের ‘রেগন ইনস্টিটিউট’-এর বিশেষজ্ঞ শু ইউ এবং বুয়েনেস আইরেসের ‘ইনস্টিটিউট অব বায়োমেডিক্যাল রিসার্চ ইন রেট্রোভাইরাস অ্যান্ড এড্স’-এর নাতালিয়া লুফের বলেন, ‘‘ওই ‘এলিট কন্ট্রোলার’-এর রক্ত ও কলাকোষে ব্যাপক তদন্তের পরেও ভাইরাসটি খুঁজে পাওয়া যায়নি। এতে মনে হচ্ছে, প্রাকৃতিক ভাবেই ওই রোগী সুস্থ হয়ে উঠেছেন।’’ বিশেষজ্ঞদের পর্যবেক্ষণ, ‘‘এই ভাবে প্রাকৃতিক নিয়মে শরীর থেকে ভাইরাসের অবলুপ্তির ঘটনা বিরল। কিন্তু এমনটা হওয়াও যে সম্ভব, তা এই প্রথম জানা গেল।’’
এড্স মহামারি শুরুর পর থেকে এ পর্যন্ত ৮ কোটি মানুষ এইচআইভি সংক্রমিত হয়েছেন। ৩ কোটি ৬৩ লক্ষ মানুষ মারা গিয়েছেন। ২০২০ সালের পরিসংখ্যান বলছে, ওই বছর গোটা বিশ্বে অন্তত ৩ কোটি ৭৭ লক্ষ মানুষ এইচআইভি নিয়ে জীবিত ছিলেন। এইচআইভি সংক্রমিত কেউ দীর্ঘদিন বিনা চিকিৎসায় থাকলে তা এড্স (অ্যাকোয়ার্ড ইমিউনোডেফিসিয়েন্স সিন্ড্রোম)-এ পরিণত হয়। এ পর্যন্ত এইচআইভি-র কোনও চিকিৎসা নেই। এত দিন জানা ছিল, একবার কেউ সংক্রমিত হলে, সারা জীবন এই ভাইরাস নিয়েই বাঁচতে হবে তাঁকে। দশকের পর দশক গবেষণার পরেও পথ খুঁজে পাননি চিকিৎসকেরা। এ অবস্থায় এমন এক জন এইচআইভি-জয়ীর খবর পেয়ে উচ্ছ্বসিত চিকিৎসক-বিশেষজ্ঞ মহল।