কিছুকাল আগে অক্ষয় কুমার দত্তর দু’শ বছর পূর্ণ হয়েছে। বিজ্ঞানমনস্ক এই তপস্বী তৈরি করেছিলেন অজস্র বাংলা পরিভাষা। ধর্মান্ধতার সঙ্গে আপস করেননি কখনও। পুরাতত্ত্ব থেকে গণিত, জ্যোতির্বিজ্ঞান থেকে ভাষাতত্ত্ব, বহুসংস্কৃতির পুরোধা ছিলেন তিনি। বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান চর্চাকে পথ দেখিয়েছিল এই পরিভাষা। শুক্রবার থেকে শুরু হচ্ছে বিশ্ব ঐতিহ্য সপ্তাহ। ঘটাটোপের আড়ালে বালি-তে অক্ষয় কুমার দত্তর স্মৃতিবিজড়িত বাড়ি এখন ধ্বংসের মুখে।
অক্ষয়কুমার দত্ত বিজ্ঞান, গণিত, ভূগোলের ক্ষেত্রে অসংখ্য পারিভাষিক শব্দ তৈরি করেছিলেন তিনি। যেমন, দূরবীক্ষণ, অণুবীক্ষণ, চুম্বক, জ্যোতির্বিদ্যা, দাহ্য পদার্থ, জড়, তড়িৎ, পরিমিতি, ধ্রুবতারা, অঙ্গার, বাষ্প, বজ্র, জোয়ার, রামধনু, সৌরজগৎ, মাধ্যাকর্ষণ, গ্রহণ, সুমেরু, কুমেরু, মানমন্দির, জ্বালামুখী, আগ্নেয়গিরি। এগুলি নমুনা মাত্র। তালিকাটি দীর্ঘ। তাঁর গোটা জীবনটাই কীর্তিতে ভরা।
তাঁর স্মৃতিবিজড়িত বাড়ির হাল কী দেখতে গেলাম বালি-তে। জিটি রোডের ধারে বিশাল অঞ্চল পাঁচিল দিয়ে ঘেরা। সংলগ্ন রাস্তা দিয়ে কয়েক মিনিট হাঁটলেই গঙ্গা। স্থানীয় দুই প্রবীন ব্যক্তি বাঁধানো ঘাটে বসে গল্প করছিলেন। তাঁদের একজন বললেন, “ছেলেবেলায় গিয়েছি ওই পোড়ো বাড়িতে। পরে কে বা কারা বাড়ির জানলা দরজা পর্যন্ত খুলে নিয়ে গিয়েছে। বহু যুগ হল কেউ ঢোকেনা। আপনিও কিছুতেই যাবেন না। যে জঙ্গল বাড়িটা ঘিরে রেখেছে সেখানে প্রচুর বিষধর সাপ। ঢুকলে প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে ঢুকবেন। প্রবেশপথ এই রাস্তার ধারে নয়। ওপাশে মূল রাস্তার ওপর।“
বালির দেওয়ানগাজিতে ভগ্নপ্রায় দোতলা ইটের পাঁজর বেরোনো সেই বাড়ি ঘিরে গজিয়ে উঠেছে আগাছার জঙ্গল। দেওয়াল ফুঁড়ে বেরিয়ে এসেছে গাছের শিকড়, লোহার বিম। এক ঝলক দেখে ‘হানাবাড়ি’ বলে মনে হয়। বেশ কয়েক বিঘা জমির একধারে পরিত্যক্ত বাড়ি। টিন আর বাঁশ দিয়ে ঘেরা। বাকি অংশে একটি কারখানা। ম্যানেজার শৈলেন রায় বাড়ির ছবি তোলার অনুমতি দেননি।
অক্ষয়কুমার দত্তর বাড়ি সংরক্ষণে আপনাদের কারখানার আপত্তি আছে? এই প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “মালিক আমাদের এই জমি ব্যবহার করতে দিয়েছেন। মালিকের নাম সুরজিৎ দত্ত।“ তাঁর ফোন নম্বর দিতে অস্বীকার করেন শৈলেনবাবু। তবে মালিকের সঙ্গে ফোনে কথা বলার পর শৈলেনবাবু এই প্রতিবেদককে বলেন, “অক্ষয়কুমারের বাড়ি নিয়ে আমরা কেউ কিছু বলতে পারব না। বাড়িটা তৈরি হয়েছে ওনার মৃত্যুর পর।“
গবেষক রাণা চক্রবর্তী জানিয়েছেন, “কলকাতা থেকে দূরে কোথাও চলে যেতে চাইছিলেন অক্ষয়কুমার। বালিতে জায়গা দেখে বাড়ি করে থাকতে শুরু করলেন। লাগোয়া জমিতে তৈরি করলেন ‘শোভনোদ্যান’ – উদ্ভিদবিদ্যা চর্চার ক্ষেত্র। ৩৮ রকমের বৃক্ষ, ১৫ রকমের ফুল বা সুদৃশ্য নানা গাছ, ১৬ রকমের মশলাজাতীয় গাছের কথা পাওয়া যায় নানা জনের বিবরণে।
অক্ষয়কুমার রচিত তিন খণ্ড ‘চারুপাঠ’ ছাত্রমহলে ব্যাপক জনপ্রিয় ছিল। তাই বিদ্যাসাগর এই উদ্যানের নাম দিয়েছিলেন ‘চারুপাঠ চতুর্থ ভাগ’। বাড়ির ভিতরেও তৈরি করেছিলেন একটি ভূতাত্ত্বিক সংগ্রহশালা। সেখানে ছিল বিভিন্ন যুগের প্রস্তরখণ্ডের নমুনা, ফসিল। শরীর সঙ্গ দিত না, তবু কলকাতা জাদুঘরে বা শিবপুর বোটানিক্যাল উদ্যানে যেতেন নিয়মিত। জাদুঘরে লাঠি নিয়ে প্রবেশ নিষিদ্ধ ছিল বলে সঙ্গীর কাঁধে ভর রেখে চলতে হত। সঙ্গীর হাতে থাকত বই। সেখানে ছাপা ছবির সঙ্গে মিলিয়ে নিতেন প্রদর্শনীর বিষয়বস্তু।
বালির বাড়িতেই একা, নিঃসঙ্গ জীবন কাটিয়েছেন ‘ধর্ম্মনীতি’র লেখক। পুত্র-কন্যাদের সঙ্গে দূরত্ব ছিল। অম্বিকাচরণ চট্টোপাধ্যায় ও রামচন্দ্র রায় তাঁর দেখাশোনা করতেন। ১৮৮৬-র ২৮শে মে, ছেষট্টি বছর বয়সে যখন প্রয়াত হন, তখন তাঁর পৌত্র সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের চার বছর বয়স। এই সত্যেন্দ্রনাথই পরে বাংলা কবিতায় ‘ছন্দের জাদুকর’ বলে খ্যাত। পিতামহকে ‘হোমশিখা’ কাব্যগ্রন্থ উৎসর্গ করে লিখেছিলেন ‘বঙ্গীয় গদ্যের গৌরবস্থল/ আমার পূজ্যপাদ পিতামহ…’।“
বাড়িটি সংরক্ষণের জন্য পশ্চিমবঙ্গ সরকারের কাছে আবেদন করেছেন বাংলাদেশের গবেষক মুহম্মদ সাইফুল ইসলাম। অক্ষয়কুমার দত্তের জন্মদ্বিশতবর্ষ উপলক্ষে এশিয়াটিক সোসাইটি আয়োজিত এক আলোচনাসভায় বাংলাদেশ থেকে আমন্ত্রিত হয়ে এসেছিলেন সাইফুল। দীর্ঘ কুড়ি বছর ধরে অক্ষয়-গবেষণায় নিবিষ্ট রয়েছেন। এর মধ্যেই তিনি অক্ষয়কুমার দত্তের শ্রেষ্ঠ প্রবন্ধ (২০০৫), বিজ্ঞানবুদ্ধি চর্চার অগ্রপথিক অক্ষয়কুমার দত্ত ও বাঙালি সমাজ (২০০৬), অক্ষয়কুমার দত্ত ও উনিশ শতকের বাঙলা (২০০৯) নামে কয়েকটি গ্রন্থও প্রকাশ করেন। তাঁর অক্লান্ত পরিশ্রম ও গভীর পর্যবেক্ষণে উঠে এসেছে অক্ষয়কুমার দত্তের এক অসামান্য মানসপরিচয়, যেখানে তিনি একাধারে বাংলা গদ্যের নির্মাতা, দার্শনিক, চিন্তানায়ক, বাঙালির প্রথম সমাজবিজ্ঞানী ও বাংলায় বিজ্ঞানসাধনার পথিকৃৎ। আজও তাঁর মুক্তচিন্তার গুরুত্ব সমান ভাবে প্রযোজ্য বলে মনে করেন সাইফুল। শিবনারায়ণ রায়, অম্লান দত্ত, শঙ্খ ঘোষ, অশোক মিত্র, জ্যোতিভূষণ চাকী প্রমুখের সংস্পর্শে ও উৎসাহে সাইফুল ইসলাম পশ্চিমবঙ্গে দীর্ঘদিন গবেষণা করেছেন।
বাড়িটিকে ২০০৬ সালের মে মাসে ‘হেরিটেজ’ তকমা দেয় রাজ্য হেরিটেজ কমিশন। ওই সময়ে রাজ্য সরকারের তরফে বাড়ির সীমানা পাঁচিলের বাইরে একটি বোর্ড ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছিল। অভিযোগ, বোর্ড লাগানোই সার। তার পরে আর কোনও দিন ওই বাড়ির সংস্কারে প্রশাসনকে উদ্যোগী হতে দেখা যায়নি। এর পর বালির কয়েক জন বাসিন্দা ফের ওই বাড়িটির সংস্কারের জন্য প্রশাসনের কাছে আবেদন-নিবেদন শুরু করেন। তাতেও কাজ এগোচ্ছে না।
ওই বাড়িতেই জীবনের শেষ তিরিশটি বছর কাটিয়েছেন ঊনবিংশ শতকে বাংলার নবজাগরণের অন্যতম প্রবর্তক এবং বাংলায় বিজ্ঞান ভাবনার পথিকৃৎ অক্ষয়কুমার দত্ত। ১৮৮৬ সালের ১৮শে মে ৬৬ বছর বয়সে বালিতেই মারা যান অক্ষয়বাবু।
দীর্ঘদিনের অবহেলা ও সংস্কারের অভাবে প্রায় ভেঙে পড়ার অবস্থায় ‘শোভনোদ্যান’ নামের সেই বাড়ি।
অক্ষয়বাবুকে নিয়ে লেখা বিভিন্ন বই থেকে জানা যায়, বালি ও কলকাতায় আয়োজিত তাঁর স্মরণসভায় পরিকল্পনা করা হয়েছিল, আধুনিক বিজ্ঞানের ধারণাকে সহজ বাংলায় প্রকাশ করা ওই লেখকের একটি স্মৃতিফলক স্থাপন করা হবে। পরে অবশ্য কিছুই হয়নি। রাজ্য হেরিটেজ কমিশনের চেয়ারম্যান, শিল্পী শুভাপ্রসন্ন ভট্টাচার্য বেশ কিছুকাল আগে সংবাদমাধ্যমে জানিয়েছিলেন, ‘‘বিষয়টি আমাদের নজরে এসেছে। আলোচনাও করেছি ওই বাড়ি নিয়ে। অক্ষয়কুমার দত্ত অত্যন্ত গুণী মানুষ ছিলেন। তিনি বাঙালির গর্ব। সেই হিসেবে চেষ্টা করছি যদি কিছু করা যায়।’’
ক‘দিন আগে এই প্রতিবেদক তাঁকে এ ব্যাপারে প্রশ্ন করেন “বাড়িটা বাঁচানোর আর উপায় আছে?” শুভাপ্রসন্নবাবু বলেন, “হ্যাঁ। বিষয়টা বিস্তারিত জানি। অক্ষয় কুমার দত্তর ওই বাড়ি বাঁচানোটা আমাদের কর্তব্য। উনি যে যুগান্তকারী কাজ করেছিলেন, তা অবিস্মরণীয়। বাড়িটা দখল করে রাখা হয়েছে। হেরিটেজ কমিটির কিছু সদস্য ভীষণভাবে চান এই স্মৃতি রক্ষা পাক। তাঁরা দেখে এসে সচিত্র রিপোর্ট দিয়েছেন। আশা করি কিছু একটা করতে পারব।”
শুভাপ্রসন্নবাবুর আগের আশ্বাস রয়ে গিয়েছে তাঁর মুখের কথাতেই। এবারের আশ্বাস কতটা কার্যকরী হয়, সময়ই তার উত্তর দেবে।