পশ্চিমবঙ্গের যে কোন গ্রামের মতই অখ্যাত হুগলী জেলার হরিপাল থানায় অবস্থিত এই কৈকালা গ্রাম । অধুনা বিখ্যাত সিঙ্গুরের পথে পড়ে এই গ্রাম । আপাত বৈচিত্র্যহীন এই কৈকালায়ই জন্মেছিলেন বিনায়ক দামোদর সাভারকরেরও আগে “ হিন্দুত্ব” শব্দ উদ্ভাবনকারী , ঐ নামের পুস্তকের রচয়িতা চন্দ্রনাথ বসু (১৮৪৪-১৯১০) ।তাঁর পিতার নাম সীতানাথ বসু। ১৮৯২ খ্রিষ্টাব্দেই তিনি ‘হিন্দুত্ব’ শব্দটি উদ্ভাবন করে রচনা করেন “ হিন্দুত্ব” নামের সাধারণ্যে অপরিচিত কিন্তু বিখ্যাত পুস্তকটি ।তাছাড়া তিনি বাংলায় ‘অর্থনৈতিক জাতীয়তাবাদের’ও অন্যতম পথপ্রবর্তক।এ বিষয়ে তিনি পত্র-পত্রিকায় বেশ কিছু প্রবন্ধও লিখেছেন ।
সাধারণভাবে ‘হিন্দুত্ব’ শব্দটি উদ্ভাবনের জন্য বীর সাভারকরকেই কৃতিত্ব দেওয়া হয় — যদিও ভুলভাবে । অন্য বেশীরভাগ ক্ষেত্রের মতো এক্ষেত্রেও হিন্দু বাঙ্গালীই প্রথম কৃতিত্বের অধিকারী, আধুনিক ‘হিন্দুত্বের’ ধারণারও প্রথম জন্ম হয়েছিল এই বাংলায় । “হিন্দুত্ব” ভাষ্যেরও (Narrative) আদি জন্মস্থান এই বাঙলা ।বাংলাকে একদল মানুষ সুচতুরভাবে তথাকথিত ‘ধর্মনিরপেক্ষতার’ আবাসভূমি আর উত্তরভারত ও মহারাষ্ট্রকে “ হিন্দুত্বের” বিচরণভুমি হিসেবে চিত্রিত করে থাকেন। অথচ ‘হিন্দুত্বের’ স্রষ্টা এবং আদি বিচরণভুমি এই বাঙলা। সাভারকর ‘হিন্দুত্ব’ গ্রন্থটি লেখেন ১৯২৩ খ্রিষ্টাব্দে— চন্দ্রনাথ বসুর ‘হিন্দুত্ব’ পুস্তকটি লেখার প্রায় ৩১ বৎসর পরে।অর্থাৎ সাভারকর তাঁর বিখ্যাত পুস্তক যেটি ১৯২৩ খ্রিস্টাব্দে Essentials of Hindutva, যেটি ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দে আবার নতুন নাম Hindutva : Who is a Hindu হিসেবে প্রকাশিত হয়, তার অনেক আগেই, ১৮৯২ খ্রিস্তাব্দে বাবু গুরুদাস চট্টোপাধ্যায় কর্তৃক ২০১, কর্নওয়ালিস স্ট্রিট, কলকাতা থেকে প্রকাশিত হয় ।ঐ পুস্তক প্রকাশ থেকে একটি বিষয় পরিষ্কার বোঝা যায়, হিন্দু জাতীয়তাবাদী ঐতিহ্য বাংলায় অপরিচিত ছিল না উনবিংশ শতকেই ।পরন্তু, হিন্দুত্বের মূল জন্মভুমি এই বাঙলা। চন্দ্রনাথ গৌরমোহন আঢ প্রতিষ্ঠিত ‘ওরিয়েন্টাল সেমিনারি’র মূল স্কুলে ক্যাপ্টেন ডি এল রিচার্ডসন, হারমান জেফ্রয়,ক্যাপ্টেন পামার, উইলিয়াম কার প্যাট্রিক, রবার্ট ম্যাকেঞ্জি ইত্যাদি দিকগজ শিক্ষকদের কাছে অধ্যয়ন করেন । এরপরে ঐ সময়কার বেশীরভাগ শিক্ষিত বাঙ্গালীর মতই চন্দ্রনাথ বসুও পড়াশোনা করেছিলেন বিখ্যাত প্রেসিডেন্সী কলেজে । ১৮৬৫ খ্রিস্টাব্দে তিনি ঐ কলেজ থেকে ইতিহাসে স্নাতক হন । পরের বৎসর, ১৮৬৬ খ্রিস্টাব্দে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হয়ে ইতিহাসে এম এ পাশ করেন এবং পরের বৎসর তিনি এবং প্রখ্যাত আইনবিদ রাসবিহারী ঘোষ একসঙ্গে বি এল পাশ করেন ।প্রেসিডেন্সী কলেজের যুক্তিবাদী প্রভাব তাঁর মধ্যে অনেকদিন অবধি ক্রিয়াশীল ছিল ।এমনকি বেথুন সোসাইটির ষষ্ঠ অধিবেশনে, ১৮৬৯ খ্রিস্টাব্দের ২৯শে এপ্রিল “ The effects of English education upon Bengali Society” বিষয়ে এক আলোচনা সভায় চন্দ্রনাথ বসু ইংরাজি শিক্ষা, ইউরোপীয় আচার-ব্যবহার সমর্থন করেছিলেন ।তিনি এটাও মনে করতেন, ইউরোপীয় আচার-ব্যবহার সমাজে যে চালু হবে তা কারও ইচ্ছা বা অনিচ্ছার উপর নির্ভর করে না, ইংরাজী শিক্ষাবিস্তারের ফলে স্বাভাবিকভাবেই তা আসবে ।১৮৭৮ খ্রিস্টাব্দের ৭ মে ‘হিন্দু প্যাট্রিয়ট’ পত্রিকা তাঁর High Education in India নামক এক বক্তৃতার উল্লেখ করে লিখেছিল, “ At last Thursday’s meeting of the Bethune Society Babu Chandranath Bose M.A., delivered an exhaustive and eloquent lecture on High Education in India. The very Revd. Father Lafont presided and wound up the discussion with a thoughtful and telling speech.” এই সময়ে ব্রাহ্মসমাজে দলাদলি, কেশবচন্দ্র সেনের অত্যধিক ‘প্রত্যাদেশ’-বিশ্বাস, খৃস্টপ্রীতি ইত্যাদি শিক্ষিত হিন্দু সমাজের মনে প্রবল প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে । চন্দ্রনাথ বসুও এই প্রতিক্রিয়া মুক্ত ছিলেন না। তাঁর এই ‘ইংরাজি ভাবাপন্ন’ মনোভাব মোটামুটি ১৮৭৮ খ্রিস্টাব্দ অবধি বজায় ছিল।
এখন তাঁর কর্মজীবন সম্পর্কে সংক্ষেপে কয়েকটি কথা বলছি । কিছুদিন আইন সম্পর্কিত দফতরে কাজ করবার পরে তিনি ছয় মাসের জন্য ঢাকার ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে কাজ করার পরে কলকাতাতে স্থায়ীভাবে বসতি শুরু করেন ।১৮৭৯ খ্রিস্টাব্দের ৭ অক্টোবর নিযুক্ত হয়ে কয়েক বৎসর তিনি বেঙ্গল লাইব্রেরীর( পরবর্তীকালে ন্যাশনাল লাইব্রেরী)‘লাইব্রেরিয়ান’ হিসেবে কাজ করেন। এছাড়া চন্দ্রনাথ বাংলা সরকারের অনুবাদক হিসেবে ১৮৭৭ খ্রিস্টাব্দে কাজ শুরু করে ১৯০৪ সালে অবসরপ্রাপ্তি অবধি ঐ পদেই কর্মরত ছিলেন। এছাড়া তিনি জয়পুর কলেজ, কলকাতার অধ্যক্ষ, টেক্সট বুক কমিটির সদস্য এবং বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের অস্থায়ী সহ-সভাপতি(১৮৯৬)এবং সভাপতি( ১৮৯৭) হিসেবেও কাজ করেন । বঙ্কিমচন্দ্রের মতই তিনিও প্রথমে ইংল্যান্ডের ‘ গৌরবময় বিপ্লব’ সম্পর্কে ইংরাজিতে লেখা শুরু করেন । এমনকি তাঁর এক প্রবন্ধ যেটি ১৮৬৪ তে প্রকাশিত হয়েছিল তার সম্পর্কে দি ইংলিশম্যান পত্রিকায় এক পর্যালোচনায় সন্দেহ প্রকাশ করা হয়েছিল যে রচনাটি আদৌ কোন ভারতীয়ের লেখনীপ্রসুত কিনা ! বঙ্কিমচন্দ্রের ‘কৃষ্ণকান্তের উইল’ এর এক পর্যালোচনার মধ্যেই স্বয়ং বঙ্কিমচন্দ্র তাঁর সাহিত্যপ্রতিভা আবিষ্কার করেন । বঙ্কিমচন্দ্রের কথাতেই চন্দ্রনাথ বাংলায় লেখা শুরু করেন এবং তখনকার দিনের অগ্রণী সাহিত্যপত্রিকা ‘বঙ্গদর্শনের’ সাথে যুক্ত হন।এছাড়াও তিনি গিরীশচন্দ্র ঘোষের ‘বেঙ্গলী’, অক্ষয়চন্দ্র সরকারের ‘ নবজীবন’ ইত্যাদি পত্রিকাতেও নিয়মিত লিখতেন। চন্দ্রনাথ প্রেসিডেন্সী কলেজে পড়ার সময় ব্রাহ্ম সমাজের আলোচনায় মাঝে মাঝে যেতেন; এমনকি তিনি অল্প সময়ের জন্য হলেও ব্রাহ্ম সমাজের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন । হিন্দুধর্মে তাঁর আস্থা ফিরে আসে উনবিংশ শতাব্দীর হিন্দু পুনরুথানবাদী আন্দোলনের অন্যতম প্রধান নেতা, পণ্ডিত শশধর তর্কচূড়ামণির সাথে বঙ্কিমচন্দ্রের গৃহে তাঁর সাক্ষাতের পরে ।১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দের মে মাসে এই সাক্ষাৎকার ঘটে ।এই সাক্ষাৎকারের পরেই শুরু হয় চন্দ্রনাথ বসুর জীবনের দ্বিতীয় পর্ব।
এই দ্বিতীয় পর্বে তিনি হিন্দুধর্মের মাহাত্ম, পুস্তক রচনা এবং হিন্দু পুনরুজ্জীবনবাদী কাজে নিজেকে মগ্ন করেন । সমালোচক খগেন্দ্রনাথ মিত্র তাঁর সম্পর্কে লিখেছেন, “ যাহারা শিক্ষাপ্রাপ্ত হইয়া হিন্দু ও হিন্দুত্বকে কেবল ঘৃণা করিতে শিখিয়াছে,তাহাদিগকে মনে ঘৃণার পরিবর্তে অনুরাগ সঞ্চার করিয়া দেওয়াও যেমন একটি কর্তব্য, তেমনিই আর একটি কর্তব্য , হিন্দুধর্মের মধ্য হইতে স্ব-ধর্মনিরত হিন্দুদিগের নিমিত্ত অনুরাগের ও শ্রদ্ধার সামগ্রী আহরণ করা । সমাজ-বন্ধন যে স্থানে শিথিল হইয়াছে, সে স্থানে সে বন্ধন দৃঢ় করা এবং যে স্থানে দৃঢ় আছে , সে স্থানে তাহা চিরকাল দৃঢ় রাখিবার বন্দোবস্ত করা উভয়ই কর্তব্য কর্ম। চন্দ্রনাথ বাবুর সমস্ত শক্তি এই কারজে নিয়োজিত হইল ।“ এইপর্বে চন্দ্রনাথ বেশ কয়েকটি পুস্তক রচনা করেন। তার মধ্যে শকুন্তলা তত্ব ( ১৮৮১),পশুপতি সংবাদ(১৮৮৪),’কঃ পন্থা’(১৮৯৮),বর্তমান বাঙলা সাহিত্যের প্রকৃতি(১৮৯৯), সাবিত্রী তত্ব(১৯০০)ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য । তাঁর রচিত পুস্তক ‘পশুপতি সংবাদ’ পাঠকমহলে যথেষ্ট সাড়া ফেলে । তিনি যথেষ্ট জনপ্রিয়তা পান এবং হিন্দু পুনরুথান আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেন । তাঁর বিভিন্ন রচনাবলীর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রচনা অবশ্যই “ হিন্দুত্ব “ নামক পুস্তকটি । তিনি ‘হিন্দুত্ব’ পুস্তকটি রচনা করেন ১৮৯২ খ্রিস্টাব্দে, বিনায়ক দামোদর সাভারকর তাঁর “ Hindutva—Who is a Hindu “ পুস্তকটি লেখার অনেক আগেই । যদিও একথা স্বীকার করতে হবে , সমগ্র ভারতে ‘হিন্দুত্ব’ ধারণাটি জনপ্রিয় করতে সাভারকরের পুস্তকটি যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেছে । এর কারণ অবশই রাজনৈতিক । সাভারকর নিজে সক্রিয় রাজনৈতিক নেতা ছিলেন; তিনি হিন্দু মহাসভা দলের সভাপতি ছিলেন । ফলে তাঁর রাজনৈতিক দর্শন সহজেই বিস্তারলাভ করেছিলো । দুর্ভাগ্যবশতঃ খুব কম ভারতবাসী, এমনকি বাঙ্গালীও চন্দ্রনাথ বসুর “ হিন্দুত্ব” বইটি পড়েছেন । এই বইটি সম্পর্কে জানেন খুব কম মানুষ । যদিও তাত্বিক আলোচনার সূত্রে, উনবিংশ শতকের হিন্দু পুনরুথানবাদী আন্দোলন আলোচনাসূত্রে, তার উল্লেখ কিছু গবেষক করেছেন, কিন্তু কেউই তার বিস্তারিত বিবরণ দেননি । কোন ইংরাজি অনুবাদ, এমনকি বাংলাতেও বইটি সহজলভ্য নয় । যাইহোক বইটি সম্পর্কে Calcutta Review পত্রিকার ১৮৯৪, জুলাই সংখ্যায় দেশীয় সাহিত্য(Vernacular Literature ) বিভাগে Critical Notices নামে একটি পর্যালোচনা বেরোয় । ঐ পর্যালোচনায় বলা হয়, give som“ This is evidently a work of Hindu revival , and therefore it is desirable to e idea of this movement. “ ঐ পর্যালোচনায় আরও বলা হয়, “ Babu Chandranath’s is the first work which treats of the Hindu articles of faith. It aims at being an exposition of the deepest and abstrusest doctrines of Hinduism, not in a spirit of apology, not in a spirit of bombast, but in a calm and dispassionate spirit…….. Babu Chandranath has selected the noblest doctrines of Hinduism.” অধুনা বিলুপ্ত ইংরাজি দৈনিক অমৃতবাজার পত্রিকা ওইসময়ে ‘হিন্দুত্ব’ পুস্তকটি সম্পর্কে লিখেছিল, “ The discussions are carried through out the book in strictly logical method and the author has made no attempt to hide confusion of thought by verbosity and rhetoric . The Adaitabad doctrine which European metaphysicians have, by mistake, natural to them, called pantheistic doctrine and which has in fact been distantly echoed by thinkers like Spinoza has been elucidated and supported in a manner that would do credit to any European theologist or metaphysician. “ চন্দ্রনাথ বসুর আগে রাজনারায়ণ বসু, ভুদেব মুখোপাধ্যায় এবং বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় হিন্দুত্ব নিয়ে লেখালেখি করেছেন। এঁদের সকলেই ইংরাজি শিক্ষায় শিক্ষিত ছিলেন । ইউরোপীয় জ্ঞান-বিজ্ঞান, সাহিত্য, সমাজনীতি তাঁরা আত্মস্থ করেছিলেন । সেই শিক্ষা থেকেই তাঁরা অনুসন্ধিৎসু হয়ে পড়েন নিজের দেশের অতীত অনুসন্ধানে । তাঁদের এই অনুসন্ধিৎসা থেকেই তাঁরা এক নতুন ভারত আবিষ্কার করেছিলেন। চারজন ইংরাজি শিক্ষিত বাঙ্গালী চারটি বই লেখেন হিন্দুধর্মের উপর। এই গ্রন্থগুলির উপর ভিত্তি করেই বাংলায় হিন্দুত্ববাদী আন্দোলন গড়ে উঠে। ব্রাহ্ম রাজনারায়ণ বসু নবগোপাল মিত্র প্রতিষ্ঠিত ‘হিন্দুমেলার’ অন্তর্ভুক্ত ‘জাতীয় সভার’ ১৫ সেপ্টেম্বর ১৮৭২ তারিখের অধিবেশনে তাঁর যুগান্তকারী দীর্ঘ প্রবন্ধ ‘ হিন্দুধর্মের শ্রেষ্ঠতা’ প্রবন্ধ পাঠ করেন । এই দীর্ঘ প্রবন্ধই একই নামে পুস্তকাকারে প্রকাশিত হয় ১৮৭৯ খ্রিস্টাব্দে ।তিনি ‘বৃদ্ধ হিন্দুর আশা’ নামে এক ক্ষুদ্র পুস্তিকায় এক ‘ মহা হিন্দু সমিতি’ গঠনের প্রস্তাব করেন ১৮৮৯ খ্রিস্টাব্দে।পরবর্তীকালে হিন্দু মহাসভা গঠনের মাধ্যমে তাঁর এই প্রস্তাব পূর্ণতাপ্রাপ্ত হয় । তাঁর এই পুস্তিকাটি Old Hindu’s Hope নামে ইংরাজিতে অনূদিত হয়েও প্রকাশিত হয় । বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ‘ধর্মতত্ব’ লেখেন ১৮৮৫ সালে ভারতের জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠার তিন বৎসর পরে , ১৮৮৮ সালে এবং ভুদেব মুখোপাধ্যায়ের ‘সামাজিক প্রবন্ধ’ প্রকাশিত হয় ১৮৯২ খ্রিস্টাব্দে । এই গ্রন্থগুলির উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠে ‘হিন্দুত্বের’ ধারণা । এই প্রবাহের শেষতম গ্রন্থ হল চন্দ্রনাথ বসুর “ হিন্দুত্ব “ । এটি প্রকাশিত হয় ১৮৯২ খ্রিস্টাব্দে । এই পুস্তক প্রণয়ন সম্পর্কে গ্রন্থের ভুমিকায় চন্দ্রনাথ বলেছেন, “ পূজ্যপাদ শ্রীভুদেব মুখোপাধ্যায় এবং শ্রীবঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় অগ্রে এই চেষ্টা করিয়াছেন বলিয়া আমি ইহাতে প্রবৃত্ত হইতে সাহস করিতে পারিয়াছি । মুখোপাধ্যায় মহাশয়ের সামাজিক প্রবন্ধে এবং চট্টোপাধ্যায় মহাশয়ের ধর্মতত্বে হিন্দুত্বের আলোচনা আছে ।“ যদিও তিনি ব্রাহ্ম রাজনারায়ণ বসু বা তাঁর ‘ হিন্দুধর্মের শ্রেষ্ঠতা’ পুস্তিকাটির উল্লেখ করেননি ।তিনি ঐ ভুমিকায় আরও বলেছেন, “ আর একটি কথা এই, হিন্দুত্বের যে সকল লক্ষ্মণ নির্দেশ করিয়াছি, তদ্দৃষটে যদি হিন্দুকে অতি অসাধারণ মৌলিকতা সম্পন্ন বিরাট মনুষ্য বলা যায়, তাহা হইলে ভুল হয় না । এই অসাধারণ মৌলিকতার একটি অর্থ এই যে, ধর্মশাস্ত্র, দেবতত্ব, দর্শন, বিজ্ঞান,সমাজপ্রনালী— কিছুরই নিমিত্ত হিন্দু কাহারো নিকট কিছুমাত্র ঋণী নয় । হিন্দুর যাহা কিছু আছে, সবই তাঁহার নিজের ।“
“ হিন্দুত্ব” গ্রন্থে তিনি তাঁর হিন্দুত্ব তত্ব দাঁড় করিয়েছেন মূলত ‘অদ্বৈত-বেদান্ত’ তত্ব এবং কতকগুলি মৌলিক বিষয়ের উপর । বিষয়গুলি হল সোহহং, লয়, নিষ্কাম ধর্ম, তুষানল, কড়াক্রান্তি, ব্রহ্মচর্য, মূর্তিপূজা, মৈত্রী ইত্যাদি বিষয়ের উপর । এই বিষয়গুলিকে কেন্দ্রকরে তিনি হিন্দুত্বের লক্ষ্মণগুলি ব্যাখ্যা করেছেন । এই বিষয়গুলি বিশ্লেষণ করে তিনি দেখিয়েছেন, হিন্দুর মনের ন্যায় সমগ্রগ্রাহী, সমগ্রব্যাপী মন পৃথিবীতে আর নাই ।
ঐ গ্রন্থের ‘সোহহং’ প্রবন্ধে তিনি ব্যাখ্যা করেছেন,সোহহং অর্থাৎ সেই আমি অর্থাৎ ঈশ্বরই আমি । হিন্দু ঈশ্বরের সাথে একাত্মতাবোধ করেছে। আমরা প্রিয়েরে আপন করি, আপনারে প্রিয় ।উপনিষদে বলা হয়েছে, ‘আত্মানমেব প্রিয়মুপাসিত’ অর্থাৎ, পরমাত্মাকে প্রিয়রূপে উপাসনা করবে । ‘একথা ভারতের হিন্দু বই আর কেহ কখন কহে নাই । এই কথা কহে বলিয়া হিন্দু হিন্দু , — এই কথাতে হিন্দুর হিন্দুত্ব, হিন্দুর হিন্দুধর্ম । সোহহং হিন্দুর লক্ষ্মণ, হিন্দুত্বের লক্ষ্মণ, হিন্দু-ধর্মের লক্ষ্মণ ।‘ অন্য কোন ধর্মে নিজেকে ঈশ্বরের সাথে একাত্ম করে দেখা হয়নি; সেখানে ঈশ্বরের সাথে মানুষের সম্পর্কের মাঝে রয়েছে যোগাযোগকারী কোন ‘গসফেল’ বা ‘রসুল’ । হিন্দুরা মনে করে, জগতে শুধু আমি সেই নই,–যাহা কিছু আছে, সকলই সেই, সর্বং খল্বিদং ব্রহ্মঃ ।এরপরে তিনি লয় অর্থাৎ অলৌকিক পৌরুষেয়তা, নিষ্কাম ধর্ম, ধ্রুব বা দৃঢ়প্রতিজ্ঞতা, তুষানল অর্থাৎ বিষম কষ্টসহিষ্ণুতা, কড়াক্রান্তি বা সুদুরগামিতা, ব্রহ্মচর্য বা জীবনে ব্রহ্মৈকপরতা, ত্রেত্রিশ কোটি দেবতা বা সর্বত্র ব্রহ্মদর্শিতা যেখানে বলা হয়েছে ঈশাবাস্যমিদং সর্বং জগত্যাং জগৎ, প্রতিমা বা মূর্তিপূজা( স্মর্তব্য যে, এক্ষেত্রে উনি লিখেছেন, হিন্দুশাস্ত্রে সাকার নিরাকার উভয়বিধ পূজারই ব্যবস্থা আছে। নিরাকার পূজার ব্যবস্থা জ্ঞানীর জন্য, সাকার পূজার ব্যবস্থা আপামর জনগোষ্ঠীর জন্য), মৈত্রী অর্থাৎ বিশ্বব্যাপী সমদর্শিতা যার ফলে সর্বভূতে অনুরাগ জন্মে ( স্মর্তব্য , আত্মবৎ সর্বভুতেষু পশ্যন্তি) ইত্যাদিকে হিন্দুত্বের সাধারণ লক্ষ্মণ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন তিনি । হিন্দুত্বের যে ঐতিহ্য বাঙ্গালী মননে রয়েছে তা তিনি সুত্রাকারে প্রকাশ করেছেন । তিনি শুধু তাত্বিক নেতা ছিলেন না, তিনি হিন্দু পুনরুথানবাদী আন্দোলনের একজন সক্রিয় কর্মীও ছিলেন । তাঁর পূর্বে উদারপন্থী হিন্দু-ব্রাহ্ম রাজনারায়ণ বসু, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এবং ভুদেব মুখোপাধ্যায় তাঁদের লেখার মাধ্যমে ইংরাজি শিক্ষিত হিন্দুদের মধ্যে হিন্দুত্বের ধারণা ছড়িয়ে দিয়েছেন । খ্রিষ্টান, মুসলমান এবং ইংরাজি শিক্ষিতরা অভিযোগ করত যে, হিন্দু সামাজিক পরিসরে কোন সমানতা বা সাম্য নেই । এ অভিযোগের যথার্থ উত্তর দিয়েছিলেন চন্দ্রনাথ। তিনি শাশ্ত্র উদ্ধৃত করে দেখিয়েছেন, হিন্দুরা সমস্ত জগতের সাথে একাত্মতা অনুভব করে, তাঁরা মনে করে ‘সর্বং খল্বিদং ব্রহ্মঃ; খ্রিষ্টান বা ইসলামিক ধর্মশাস্ত্রে কোথাও এমন সর্বব্যাপী ঐক্যের কথা বলা হয়নি ।
ইংরাজি শিক্ষিত রাজনারায়ণ বসু, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, ভুদেব মুখোপাধ্যায় এবং চন্দ্রনাথ বসু হিন্দু পুনরুজ্জীবন প্রয়াসে গ্রহণ করেছিলেন যুক্তির আশ্রয় । এঁরা সবাই ছিলেন উচ্চশিক্ষিত। এঁদের কাছে অন্ধ ইংরাজ অনুকরণ ভীরুতা বলেই মনে হয়েছিল । ভাবাবেগ ত্যাগ করে যুক্তির সাহায্যে তাঁরা হিন্দুধর্মের মূল সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করতে সচেষ্ট হয়েছিলেন । ১৮৭২ খ্রিস্টাব্দে ‘হিন্দুধর্মের শ্রেষ্ঠতা’ বক্তৃতার মাধ্যমে রাজনারায়ণ বসু এর প্রথম সূচনা করেন । এই প্রজ্ঞাপ্রবাহে চন্দ্রনাথ বসু শেষ গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব। তিনি হিন্দু সমাজের সবকিছু সুন্দর বলে মনে করেননি; কিছু কিছু আবর্জনাও যে আছে তা তিনি স্বীকার করতেন । হিন্দুধর্মের পুনরুথানবাদী হলেও তিনি হিন্দুধর্মকে সংস্কারের অতীত বলে মনে করেননি । ত্রিধারা প্রবন্ধে তিনি বলেছেন, “ এই সকল বিষয় অনিষ্ঠকর কুসংস্কার নাশ করা বর্তমান কালে আমাদের সংস্কার কারজ্যের প্রধান উদ্দেশ্য হওয়া উচিত ।“
ইদানীংকালে কোন কোন মহল থেকে সোচ্চারে ঘোষণা করবার চেষ্টা হচ্ছে, বাংলার ডি এন এ তে ‘হিন্দুত্ব’ নেই । কথাটা যে সর্বৈব মিথ্যে একথা বলার অপেক্ষা রাখে না। বাংলার রেনেসাঁ বা সংস্কার আন্দোলনের ভিত্তিতেই আছে হিন্দুভাবনা। হিন্দুধর্মের ত্রুটিগুলো দূর করে তার সংস্কারই ছিল ঐ আন্দোলনগুলির মূল প্রেরণা । পরবর্তীকালের স্বাধীনতা আন্দোলনেও হিন্দু অনুষঙ্গগুলিই স্বাধীনতাকামীদের উদ্বুদ্ধ করেছে । বাংলার সংগ্রামশীল জাতীয়তাবাদী দেশপ্রেমিকদের কাছে প্রেরনার উৎসই ছিল হিন্দুধর্ম। সেটা বারে বারে ভুলিয়ে দেবার চেষ্টা হয়েছে। কিন্তু সেই চিন্তাভাবনা যে মানুষের মনে নব কলেবরে প্রস্ফুতিত হচ্ছে সেটা বোঝা প্রয়োজন ।বাংলার চন্দ্রনাথ বসু “ হিন্দুত্বের” তাত্বিক সংজ্ঞা দিয়েছিলেন ১৮৯২ খ্রিস্টাব্দে, আর ৩১ বৎসরের ব্যবধানে, ১৯২৩ সালে মহারাষ্ট্রের বিনায়ক দামোদর সাভারকর দিয়েছেন ‘হিন্দুত্বের’ ভৌগোলিক ব্যাখ্যা এবং রাজনৈতিক গতি ।
বিনয়ভূষণ দাশ