দেবকে শহুরে মানুষদের পছন্দ নয় ওর দুর্বল অভিনয়ের জন্য, দেবকে আঁতেলদের পছন্দ নয় কারণ সে সিনেমার মাধ্যমে সমাজকে সমাজবাদের শিক্ষা দেবার চেষ্টা করে না বলে, দেবকে বামপন্থীদের পছন্দ নয় কারণ সে লাভ জেহাদ কিম্বা মার্ক্সবাদকে প্রমোট করে না, দেবকে আমাদের বিজেপির সমর্থকদের পছন্দ নয়, কারণ সে দুইবারের তৃণমূলের সাংসদ l কিন্তু সবকিছুর পরেও সে জনপ্রিয়তম নায়ক যার এখনো কোন সিনেমা ফ্লপ করেনি l এককথায় সুপারষ্টার l আর বাংলা সিনেমা বাঁচাতে একজন সুপারস্টার প্রয়োজন l দেব মানেই টাকা l টাকা না এলে ইন্ডাস্ট্রি বাঁচবে না, ইন্ডাস্ট্রি না বাঁচলে কর্মচারী বা অভিনেতাদের মাইনে তো বাড়বেই না, বহু মানুষকে বিনা পয়সায় কাজ করে যেতে হবে, যা এখন টালিগঞ্জের রোজনামচা l বহু বাঙালী বোম্বে তো বটেই, চেন্নাই, হায়দ্রাবাদ চলে যাচ্ছেন শুধু মাত্র সঠিক সময়ে মাইনেটা পেতে l আর এই অন্যায় বন্ধ করার জন্য দরকার সিনেমার আরও বড় বাজার l আর বাজার বাড়াতে চাই একজন রজনীকান্ত, যার ধারে কাছে এখনো বাংলা ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির কেউ যেতে পারেনি l
কিন্তু দেব কেন বাকিদের থেকে এগিয়ে? টাকার দাম ডিসকাউন্ট না করে অর্থাৎ উত্তম কুমারের সময়ের বা গুপী গায়েন বাঘা বাইনের সময়ের টাকার মূল্য এবং আজকের টাকার মূল্য তুলনা না করলে দেব এক নম্বরে l (নতুবা সম্ভবতঃ গুপী গায়েন বা বেদের মেয়ের জোছনা l) কিন্তু বাংলা সিনেমার ইতিহাসে সবচেয়ে বেশী বিক্রি হওয়া দশটি ছবির সাতটি দেবের, দুটি জিতের এবং একটি বাংলাদেশের নায়ক সাকিব খানের l এর মধ্যে প্রথম দুটির বিক্রি পরের আটটির সমান এবং দুটিই দেবের l অতিমারীর ভয় উপেক্ষা করে ‘গোলান্দাজ’ আর কয়েকদিনের মধ্যে এই প্রথম দশে আসতে চলেছে l. কেন বলছি? প্রথম সপ্তাহে বিক্রির নিরিখে যে পাঁচটি ছবির সর্বকালীন রেকর্ড করে আছে তার চারটি দেবের এবং পঞ্চম স্থানে গোলান্দাজ l অতিমারী উপেক্ষা করেও l আঁতেল, শহুরে, বামপন্থী, কংগ্রেস এবং বিজেপির একটা বড় অংশের এলার্জি উপেক্ষা করেও এগিয়ে দেব l
এখন আঁতেল বাঙালী আবার টাকাকে খুব ঘৃণা করে l তবে হ্যাঁ, সেটা নিজের টাকা নয়, অপরের টাকা l আর বাংলার সর্বকালের সেরা পরিচালকও যখন দেখেন মহানয়াকের পকেটে টাকা আছে, তিনিও মেনে নিতে পারেননি l নায়ক ছবিতে সেটা নির্দ্বিধায় বলেও ফেললেন l সাধুসন্ত গুণীজনদের কথা অনেক সময় লেগে যায় l আর বড় মানুষ নজর দিলে তো হয়ে গেল আর কি? অনেকে বলে, উত্তমকুমারের চরিত্র ভেবেই নাকি নায়ক আর সেই ছবিতে অভিনয় করেই দেশের প্রথম জাতীয় পুরস্কার তুলে নেন উত্তমবাবু l কিন্তু এই দৃশ্যটা দেখে একটু অবাস্তব মনে হচ্ছে না কি? খোদ টাকার হিমালয় পর্বতে বসা বিল গেটস বা ধীরুভাই আম্বানি এই স্বপ্ন কোন দিন দেখেছেন? কেন বাবা মহানয়কের পয়সায় নজর দেয়া? মহানায়ক তো চলে গেলেন এর একযুগ পরে l কিন্তু পরের মহানায়করা তো একেবারে ভিখিরি দশা? রজনীকান্ত একটি ছবি করে নেন 100 কোটি, আর সংস্কৃতিবান পশ্চিমবঙ্গের সর্বোচ্চ বিক্রির সিনেমা আমাজন অভিযানের আয় 50 কোটি l দ্বিতীয় চাঁদের পাহাড় 20 l এরপর রংবাজ, পাগলু সব 10 l কেন মহামানব যে নজর দিলেন মহানায়কের অর্থে? আর এই অর্থের অভাবই অনর্থ ডেকে আনল বাংলার সংস্কৃতিতে l সত্তরের দশকের শেষ দিক থেকেই বাংলা সিনেমার আয় কমতে শুরু করল l
যে বুদ্ধবাবু সংস্কৃতি মন্ত্রী হিসেবে বাংলা সিনেমার অধঃপতনের সবচেয়ে বড় সাক্ষী (1977-2000), তিনি মুখ্যমন্ত্রী হবার পরে কিন্তু বাংলা সিনেমা আবার মাথা তুলে দাঁড়াতে থাকে জিত বা দেবের হাত ধরে l কারণ কিছুটা হলেও বাংলার শিল্পে খরা কাটানো শুরু হয়েছিল l সেক্টর 5, বোম্বে রোডের পাশে কিছু কর্মসংস্থান l এবং নায়ক সেই জিত এবং দেব l যাদের একজন জন্মসূত্রে বাঙালীই নন এবং অপরজনের বাংলা উচ্চারণে এখনো দক্ষিণ কলকাতার আভিজাত্য আসেনি l শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়, পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়দের থেকে কয়েকশো মাইল এগিয়ে l কারণ আঁতলামি ছেড়ে বিনোদনে মন দিয়েছেন এঁরা l দরকারে তেলেগু, তামিল স্ক্রিপ্ট চুরি করে l ইন্ডাস্ট্রিতে পয়সা দরকার l বাজার দরকার l মানুষ যেন মাল্টিপ্লেক্সে সলমন খান বা শাহরুখ খানের বদলে একবার জিত বা দেবের বাংলা সিনেমা দেখার কথা ভাবেন l জীবনে প্রচুর সমস্যা l তিন ঘন্টা বিশুদ্ধ বিনোদন দিলে আসবে পয়সা, পয়সা এলে শুধু নায়ক নয়, সহঅভিনেতা, কর্মচারীদের জীবনের মান বাড়বে l আসবে নতুন মেধা l আর এটা পারেন একমাত্র নায়কই l নায়কের কোন বিকল্প হয় না, বলে গেছেন নায়ক ছবির সেই মুকুন্দ লাহিড়ী l জিত বা দেব যা পারে তা পরমব্রত বা কৌশিক সেন পারে না l
নারাদা ভিডিওতে পাওয়া একটি ফুটেজ অনুযায়ী, দেব নাকি রাজনীতিতে আসতে চাননি l তাঁর কিছু কথাতে হতাশা প্রকাশ পেয়েছে l 2014 র পর থেকে তাঁর ছবির সংখ্যাও কমেছে l তৃণমূল সুপ্রিমো যদি তাঁকে রাজনীতি থেকে মুক্তি দেন, বাঙালী জাতির মঙ্গল l উন্নতি হবে টালিগঞ্জ ইন্ডাস্ট্রির সকলের l দশ বছর পরে নয় আবার ওকে ডেকে নেবেনl রাজনীতিতে……..
সুদীপ্ত গুহ