কেন বৎসরকে সংস্কৃত ভাষায় বর্ষ বলা হয়?

এই প্রশ্ন সবার মনে জাগতে পারে। জাগবেও। এর উত্তর ঋগ্বেদে আছে। সেখানে বলা হয়েছে প্রকৃতির প্রধান ঋতু তিনটে : গ্রীষ্ম, বর্ষা ও শীত। উপমহাদেশের বাইরে কোথাও এত আলাদা করে তিনটে ঋতু দেখা যায় না। সেখানে গ্রীষ্মকালে অথবা শীতকালেই বৃষ্টি হয়ে থাকে। আমরা যাকে তুষারপাত বলি, তা আসলে শীতকালীন বৃষ্টি ছাড়া আর কিছুই না।

ঋগ্বেদে ৬-৩২-৫ সূক্তে বলা হয়েছে যখন সূর্যদেব উত্তর থেকে দক্ষিণ দিকে সরতে শুরু করেন, মোটামুটি সে সময়েই বৃষ্টির মরসুম শুরু হয়। সংস্কৃত ভাষায় বৃষ্টিকে বর্ষা বলা হয়, সে কারণে আমরা বৃষ্টির মরশুমকে এখনও বর্ষাকাল বলি। প্রতি বছর একটি নির্দিষ্ট সময় অন্তর বর্ষাকাল হয়, তা ঋগ্বেদে উল্লেখ করা হয়েছে।

সেই ১০০০০ খ্রিস্টপূর্ব থেকেই এখনও পর্যন্ত ভারতের প্রধান জীবিকা হিয়াবে গণ্য হয়ে আসছে চাষাবাদ। এবং ভারতে চাষাবাদ মুখ্যত বর্ষাকালেই হয়ে থাকে, কেননা এই সময়ে জলের অভাব কোনও প্রান্তে হয় না। বাকি দুই ঋতুতে জলের জোগান সেভাবে থাকে না বলে চাষাবাদ সম্ভব নয়। বর্ষাকালকে কেন্দ্র করেই বৈদিক যুগে পঞ্জিকা (পঞ্চাঙ্গও বলা হয়) নির্মাণ করা হয়েছিল।

প্রাচীন পঞ্জিকা নির্মাতারা সময়কে দুই প্রধান ভাগে বিভক্ত করেন : অয়ন। যা সংক্ষেপে উত্তরায়ন ও দক্ষিণায়ন নামে পরিচিত।

এখানে অয়ন মানে সূর্যদেবের উত্তর থেকে দক্ষিণে গমনকে বোঝাচ্ছে।

ঋগ্বেদে ২-২৪-৫ সূক্তে বলা হয়েছে বর্ষাকাল থেকেই নাকি বৈদিক যুগের মানুষ নতুন বছর মানা শুরু করেছিল। মূল সূক্ত এরকম : “ব্রাহ্মণস্পতি ।”
ঋগ্বেদে ১-৬৪-৫১ সূক্তে বলা হয়েছে, “বৃষ্টিপাত একটি সাধারণ বিষয়। তা সমুদ্র থেকে আকাশে উঠে যায়, তারপর ভূপৃষ্ঠে আছড়ে পড়ে। বৃষ্টি পৃথ্বীকে সন্তুষ্ট করে, এবং অগ্নি অন্তরিক্ষকে সন্তুষ্ট করে।”
এথেকে বোঝাই যাচ্ছে যে, প্রাচীন ভারতীয় পণ্ডিতরা জানতেন জল সমুদ্র থেকে সূর্যালোকের তাপের ফলে ঊর্ধ্বে উঠে আকাশে উঠে মেঘের চেহারা নেয়, তারপর ভূপৃষ্ঠে নিপাতিত হয় বৃষ্টির আকারে।
ঋগ্বেদে ৭-১০৩-১ সূক্তে বলা হয়েছে, “একজন ব্রাহ্মণ যেভাবে তার পরম কর্তব্য ‘ব্রত’ পালন করে, ঠিক সেভাবেই একটি ব্যাং শীতঘুম ভেঙ্গে সারা বর্ষাকাল জুড়ে বর্ষাকালের প্রতীক্ষায় থাকে। যখন বৃষ্টি শুরু হয়, সে আনন্দে ডাকতে শুরু করে সঙ্গিনী জোগাড় করার আশায়।”

ঋগ্বেদে ৭-১০৩-৭ সূক্তে বলা হয়েছে, “বর্ষাকালে বছরের প্রথম বৃষ্টিপাত শুরু হলে যেখানে একটাও ব্যাং দেখা যেত না, সেখানে সর্বত্র ব্যাঙের যেন বন্যা দেখা দেয়।”

ঋগ্বেদে ৭-১০৩-৮ সূক্তে বলা হয়েছে, “এই সময়ে ব্যাঙের কাতর ডাক শুনলে মনে হয় সে যেন ব্রাহ্মণের মন্ত্রোচ্চারণের ন্যায় নিজস্ব মন্ত্রপাঠ করে যাচ্ছে। এই হল তার হর্ষোল্লাসের ডাক।”
ঋগ্বেদে পরিষ্কার বলা হয়েছে, উত্তরায়ন শেষ হলে বর্ষাকাল শুরু হয়। অর্থাৎ গ্রেগরিয়ান পঞ্জিকা অনুসারে ২১ জুন নাগাদ। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে ২১ ডিসেম্বর থেকে উত্তরায়ন শুরু হয়।
ঋগ্বেদে ৭-১০৩-৯ সূক্তে বলা হয়েছে, “বছরের শেষ চার মাস (গ্রীষ্মকাল) এত গরম পড়ে, যেন মনে হয় পৃথিবীর শেষ দিন এসে গেছে। এরপর যখন বর্ষাকাল শুরু হয়, মানুষ এমন আনন্দে মেতে ওঠে, যেন পুনর্জীবন ফিরে পেয়েছে।”

বৃষ্টি না হলে ব্যাঙের বিয়ে দেওয়ার বিচিত্র প্রথা খ্রিস্টপূর্ব ১০০০ নাগাদ শুরু হয়েছে, যা এখনও চালু আছে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে।

অনুমান করা হয় ঋগ্বেদ প্রথম মুখে মুখে তৈরী করা হয়েছিল ২৩৭২০ খ্রিস্টপূর্ব নাগাদ। এতে বর্ষাকালের অনেক উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করা হলেও গ্রীষ্মকাল বা শীতকাল নিয়ে প্রায় নীরব থেকেছে। উপরোক্ত সূক্তসমূহ রচনা করেছেন মহর্ষি বশিষ্ঠ, যার ১০১ পুত্রকে কুখ্যাত রাজা কল্মাষপাদ হত্যা করেছিল।
ভগবান রামচন্দ্রের পূর্বসূরি ছিলেন ইক্ষবাকু বংশীয় কল্মাষপাদ, তার প্রায় ১৫ প্রজন্ম পর রামচন্দ্রের জন্ম হয়, আনুমানিক ২০০০ বছর বাদে।

নতুন বছর ধরা হত বর্ষ হিসাবে, যেহেতু তা বর্ষাকাল থেকেই শুরু হত। রামায়ণ শুরু হবার বহু বছর আগে বর্ষাকালকে নতুন বর্ষ হিসাবে গণ্য করার প্রথা শুরু হয়।

বাল্মীকি অবধি রামায়ণে অন্তত তিন শ্লোকের মাধ্যমে বর্ষের উল্লেখ করেছেন নতুন বছর হিসাবে।
অযোধ্যা কাণ্ডের ৭৭-২৫ নং শ্লোক দেখুন :
উত্থিতৌ তৌ নর ব্যাঘ্রৌ প্রকাশতে যশস্বিনৌ।
বর্ষ আতপ পরিক্লিনৌ পৃথগ ইন্দ্র ধ্বজাব ইব।।
দুই মনুষ্যরুপী ব্যাঘ্র (ভরত ও শত্রুঘ্ন) উঠে দাঁড়াল, তারপর দেবরাজ ইন্দ্রের সামনে পতাকা তুলে তার নামে জয়ধ্বনি দিল। সে সময়ে ঘোরতর বৃষ্টি পড়ছিল। যদিও গরম ছিল প্রচণ্ড।

সাধারণ জুন মাসে গরম থাকে, এবং সে সময়েই বর্ষাকাল শুরু হয়।

ঋগ্বেদের ১-১৬১-১৩ সূক্তে বলা হয়েছে : “কে রুবাহুকে জাগিয়ে তুলেছে?” এখানে রুবাহু মানে মেঘ।

তখন সূর্য উত্তর দিল, “অবশ্যই কুকুর। কেননা আজ হচ্ছে বছরের শেষ দিন।” এখানে কুকুর মানে হচ্ছে মৃগশিরা নক্ষত্র। এখানে বছরের শেষ দিন মানে গ্রীষ্মকালের শেষ ও বর্ষাকাল শুরু বোঝানো হচ্ছে। অর্থাৎ ঋগ্বেদের সময়ে বর্ষাকালকে নতুন বছর হিসাবে ধরা হত।

যখন সূর্য মৃগশিরা নক্ষত্রের দিকে প্রবেশ করবে, তখনই বর্ষাকাল শুরু হবে, এটাই ছিল তখনকার বিশ্বাস।

যখন সূর্য ১৩ দিন বাদে মৃগশিরা নক্ষত্র ছেড়ে অরুদ্র নক্ষত্রে প্রবেশ করবে, তখন পৃথিবী রজস্বলা হয়ে উঠবে। অর্থাৎ প্রচণ্ড বর্ষাকাল শুরু হবে। সাধারণত জুলাই মাসের শুরুতে কৃষকরা বীজ বপন শুরু করেন। এর কারণ উপরে ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, পুরীতে জগন্নাথ দেবের রথযাত্রাও বর্ষাকালের সময়েই শুরু হয়।

তৈত্তরীয় সংহিতার ৭-৪-৮ সূক্তে বিভিন্ন বর্ষচক্রের উল্লেখ পাওয়া যায়। সেখানে উত্তর ফাল্গুনিকে বছরের প্রথম রাত বলা হয়েছে এবং পূর্ব ফাল্গুনিকে বছরের শেষ রাত বলা হয়েছে।

শতপথ (৬-২-২-১৮), গোপথ (৬-১৯) এবং পঞ্চ বিংশ (৫-৯-৯) এবং সংখ্যায়ন ব্রাহ্মণ ইত্যাদি গ্রন্থেও তৈত্তরীয় সংহিতার কথার সমর্থন পাওয়া যায়।
তৈত্তরীয় সংহিতা হচ্ছে যজুর্বেদ এর একটা ভাগ। সেখানে উত্তর ফাল্গুনিকে নতুন বছর বলার অর্থ হচ্ছে বসন্ত ঋতুতে নতুন বছর শুরু হচ্ছে : ২১ মার্চ দিয়ে নতুন বছর শুরু হচ্ছে।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, দক্ষিণ ভারতে উগাড়ি উৎসবও ২১ বা ২২ মার্চে পালিত হয়। সেখানে তৈত্তরীয় সংহিতাকে কৃষ্ণ যজুর্বেদ হিসাবে ধরা হয়।

ঠিক এই কারণে তৈত্তরীয় সংহিতায় (৬-৫-৩) প্রশ্ন করা হয়েছিল : “ঋতুর দুটি মুখগহ্বর আছে। কিন্তু কেউই জানে না মুখগহ্বর কেন খোলে।”

নবরাত্রির ঠিক ছয় মাস বাদে উগাড়ি উৎসব পালন করা হয়। দেবী ভাগবতম অনুসারে উগাড়ির দিনেই রাত বারোটায় নাকি দেবী মা দুর্গা মহিষাসুরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করেছিল, যা সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে শেষ হয়।

এক মানবলোক বছর মানে দেবলোকে এক দিনের সমান। প্রতি মাস দেবলোকের কাছে দুই ঘণ্টার সমান।

সেই হিসাবে ঈশ্বর ভোর চারটে সময়ে ওঠেন এই হিসাব ধরলে তা ডিসেম্বরের মাঝামাঝি সময় হবে। বৈষ্ণবরা এই দিন (১৫-১৭ ডিসেম্বর) ধনুর্মাস দিবস রুপে পালন করেন।

দেবলোকের ভোর ছটাকে মানবলোকে সেই হিসাবে জানুয়ারি মাসের মাঝামাঝি হিসাবে ধরতে হবে। হিন্দুদের কাছে ঐ সময় মকর সংক্রান্তি হিসাবে পালিত হয়। ঐ দিনেই উত্তরায়ন শুরু হয়।

একই ভাবে সন্ধ্যায় ছটা দক্ষিণায়ন হিসাবে শুরু হয়। আর সেদিন থেকে শীতকাল শুরু হয়।

  • অয়ন চক্রবর্তী

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.