মুম্বাই পুলিশ সম্প্রতি একটি নির্দেশিকা জারি করেছে। সেখানে জনসাধারণের উদ্দেশ্যে বলা হয়েছে তারা যেন হেট স্পীচ, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিরোধী এবং ফেক নিউজ জাতীয় কোন ম্যাসেজ ফরওয়ার্ড করা থেকে বিরত থাকে এবং কাউকে যদি এই ধরণের কাজ করতে দেখে তবে যেন তৎক্ষণাৎ পুলিশকে অবগত করে। যদি এই নির্দেশিকা কোন ব্যক্তি অমান্য করে বা কোন সোশ্যাল মিডিয়া গ্রুপ এই ধরণের ম্যাসেজ আদান প্রদান করতে দেয় তবে তাদের বিরুদ্ধে, বিশেষত গ্রুপ অ্যাডমিন এবং ঐ ধরণের ম্যসেজ আদান প্রদানকারী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কড়া পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
বললে ভুল হবে না, মুম্বাই পুলিশকে এহেন কড়া অবস্থান নিয়ে এরূপ নির্দেশিকা জারি করতে বাধ্য করা হয়েছে। কারণ বিগত কয়েকদিন ধরেই কিছু ফেক ম্যাসেজের মাধ্যমে মহারাষ্ট্রের বিভিন্ন স্থানে অস্থিরতা তৈরি করা হয়। যার জেরে বিগত ২-৩ দিন ধরে সেই সব জায়গাতে শান্তি বজায় রাখাতে প্রশাসনকে ১৪৪ ধারা জারি করতে হয়েছে।
ঘটনার সূত্রপাত হয় শুক্রবার ১২-১১-২১ থেকে, যখন হেট স্পীচ, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিরোধী ফেক ম্যাসেজ থেকে প্ররোচিত হয়ে, একটি বিশেষ ধর্মের মানুষ প্রথমে না ঘটা একটি ঘটনার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ মিছিল করে। তারপর মিছিল থেকে পাথর ছোঁড়া, ভাঙচুর এবং অগ্নি সংযোগের মতন ঘটনা ঘটিয়ে উত্তেজনা ছড়িয়ে দেয়।
জানা যায়, উত্তরপূর্ব ভারতের একটি রাজ্যে একটি বিশেষ ধর্মের মানুষের ধর্মস্থানে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ ঘটানো হয়েছে বলে বেশ কিছু ফেক নিউজ, ছবি, ভিডিও এবং উত্তেজক ম্যাসেজ ছড়িয়ে পরার পরেই এই ঘটনাটি ঘটেছে। যদিও এই ধরণের কোন ঘটনা উত্তরপূর্ব ভারতের রাজ্যটিতে আদৌ ঘটেইনি বলে সংশ্লিষ্ট রাজ্যের পুলিশ এবং প্রশাসনের পক্ষ থেকে আগেই জানানো হয়েছিল। কিন্তু উত্তেজিত জনতা ফেক ম্যাসেজের দৌলতে সে সবের তোয়াক্কা করেনি।
সোশ্যাল মিডিয়াতে ফেক ম্যাসেজ, হেট স্পীচ ইত্যাদির মাধ্যমে উত্তেজনা ছড়ানোর মতন ঘটনা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশেই দেখা যায়। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায় ২০২১ সালের দুর্গাপূজার সময়, বাংলাদেশে মাত্র একটা ফেক ম্যাসেজের জন্য গোটা দেশ জ্বলে উঠেছিল। ঐ একটা ফেক ম্যাসেজের ফলে সেই দেশে শতাধিক দুর্গাপূজা আক্রান্ত হয়। সঙ্গে আক্রান্ত হয় কয়েক হাজার সংখ্যালঘু। অনেককে খুনও করা হয়, লুণ্ঠিত হয় সংখ্যালঘু নারীদের সম্ভ্রম।
২০২১ সালেই দক্ষিণ আফ্রিকাতে চীনপন্থি কিছু প্রভাবশালী মানুষের ভারতীয় বংশোদ্ভূতদের উদ্দেশ্যে বিদ্বেষ মূলক হেট স্পীচ সোশ্যাল মিডিয়াতে ভাইরাল হওয়ার পরে, ঐ দেশে আক্রান্ত হয় ভারতীয় বংশোদ্ভূতরা।
এবার একটু পিছন দিকে তাকালেই দেখা যাবে আমাদের দেশও এসবের থেকে একেবারেই পিছিয়ে নেই। কিছু মানুষের উদ্দেশ্য-প্রণোদিত ভাবে ছড়িয়ে দেওয়া ফেক ম্যাসেজের মাধ্যমে উত্তেজনা ছড়ানোর ফলে, ২০২০ সালে উত্তরপ্রদেশে খুন হন জাতীয়তাবাদী নেতা কমলেশ তিওয়ারি। ঐ একই ফেক ম্যাসেজ গুলোর জন্য ২০১৬ সালে মালদার কালিয়াচকে দাঙ্গাও হয়েছিল।
তাছাড়াও ২০১৯ সালের ডিসেম্বর মাসে ভারতের জাতীয় নাগরিক পঞ্জি(এনআরসি) এবং সংশোধিত নাগরিকত্ব প্রদান আইনের(সিএবি)বিরুদ্ধে একাধিক ফেক ম্যাসেজের মাধ্যমে অপপ্রচার চালানো হয়। ফলস্বরূপ, আমাদের রাজ্য পশ্চিমবঙ্গ সহ ভারতের বিভিন্ন অংশে আগুন জ্বলেছিল। যার ফলে কোটি কোটি টাকার সরকারি সম্পত্তির ক্ষয়ক্ষতিও হয়। খুঁজতে চাইলে এরকম না জানি কত-শত উদাহরণ পাওয়া যাবে।
প্রযুক্তির উন্নতি হওয়ার ফলে মানুষের সঙ্গে মানুষের যোগাযোগ যেমন আগের থেকে অনেক সহজলভ্য হয়েছে, তেমনি পাল্লা দিয়ে বৃদ্ধি পেয়েছে তার দুর্ব্যবহারও। অসৎ মানুষেরা তাদের উদ্দেশ্যকে চরিতার্থ করতে, এই প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়েই সমাজকে আগের থেকে অনেক সহজে দ্রুত গতিতে অস্থির করে তুলতে সক্ষম হচ্ছে।
এমতাবস্থায় আমাদের কি কি করনীয়? এই ধরণের অপ্রীতিকর পরিস্থিতি থেকে বাঁচতে সবচেয়ে আগে আমাদের উচিৎ, সোশ্যাল মিডিয়াতে এই ধরণের যে কোন ম্যাসেজ বা পোষ্টকে এড়িয়ে চলা। বিতর্কিত কোন পোষ্ট বা ম্যাসেজ পেলে সেটাকে বিশ্বাস করা বা ফরোয়ার্ড করার আগে একবার অন্তত পরোখ করে নেওয়া দরকার। তার জন্য সব থেকে সহজ পদ্ধতি হল গুগুল বা সুবিধা মতন যে কোন সার্চ ইঞ্জিন ব্যবহার করে, ঐ ঘটনা সংক্রান্ত কোন তথ্য আদৌ কোন প্রথমসারির মিডিয়াতে আছে নাকি সেটা দেখে নেওয়া। সম্ভব হলে সংশ্লিষ্ট রাজ্যের বা জেলার পুলিশের সোশ্যাল মিডিয়ার পেজ বা হ্যান্ডেলে কিছু বার্তা দেওয়া আছে নাকি দেখে নিতে হবে। সব কিছু চেক করে নিয়ে আশ্বস্ত হলে তবেই সেই ম্যাসেজকে বিশ্বাস করা বা ফরোয়ার্ড করা বা গ্রুপে রাখতে দেওয়া উচিৎ। অন্যথায় সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবাদ এবং ডিলিট করাতে হবে। তাহলে একদিকে যেমন পুলিশি ঝামেলা থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে, ঠিক তেমনই সমাজকেও রাষ্ট্র বিরোধী শক্তির থেকে রক্ষা করা যাবে। সকলকে মনে রাখতে হবে দেশ ও সমাজকে সুরক্ষিত রাখার দায়িত্ব শুধু সরকারের নয় আমাদেরও।
https://timesofindia.indiatimes.com/mobileapplist/7404562.cms