আসলে যাঁরা অসহিষ্ণুতার অভিযোগ করে প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি লিখেছেন তারা মানবতাবোধ থেকে একাজ করেননি। তাদের প্রতিক্রিয়ার মূল কারণ রাজনীতি। তা যদি না হত তবে তো তারা বাংলাদেশে সংখ্যালঘু হিন্দুদের উপর লাগাতার অবর্ণনীয় অত্যাচারে প্রতিবাদ করতেন। পূর্ণিমা শীলের জন্য বা চক্রগ্রামের নাজিরহাট কলেজের অধ্যক্ষ গোপালকৃষ্ণ মুহুরির জন্য এরা একফোঁটা চোখের জল ফেলেননি। বাংলাদেশের মানবাধিকারের জন্য এঁদের চিন্তা নেই, কিন্তু গাজা ভূখণ্ডে ইজরাইলের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে এনারা রাস্তায়, ইরাকে মার্কিন আগ্রাসনের প্রতিবাদে তাঁরা টিভির পর্দা ফাটিয়ে দেবেন।

দেশে অসহিষ্ণুতা বাড়ছে ভীষণ চিন্তিত বিদ্বজ্জনেরা। প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি লিখেছেন তাঁরা। ‘জয় শ্রীরাম’ নাকি ‘ওয়ার ক্রাই’ হয়ে উঠেছে। যেসব জ্ঞানীগুণী মানুষ তাতে সই করেছেন তাতে বাংলাভাষীর সংখ্যা চোখে পড়ার মতো। তারা সংখ্যালঘু আর দলিতদের উপর লাগাতার অত্যাচারের জন্য উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।

সত্যি বলতে কী অসহিষ্ণুতার যে বীভৎস রূপ বাংলার মানুষ দেখেছেন সারা ভারতবর্ষে তার উপমা মেলা ভার। বিনা অপরাধে পিটিয়ে মারা ট্র্যাডিশন বিগত দশকগুলি থেকে ধারাবাহিকভাবে চলে এসেছে। কিন্তু বাংলার বিষয়গুলি ওই বিদ্বজ্জনদের দ্বন্দ্বমূলক ইতিহাসবোধের মধ্যে হয়তো আসে না। তাই সেই অসহিষ্ণুতার বিষয়ে তারা আগেও কোনও কথা বলেননি। আজও বলেন না, ভবিষ্যতেও চুপটি করে বসে থাকবেন।
এ বছর ১০ ফেব্রুয়ারি দক্ষিণ ২৪ পরগনার মগরাহাটের মুলটি গ্রামে সুমন দাস নামে ২৬ বছরের এক যুবককে পিটিয়ে মেরে ফেলা হয়েছে। পরের দিন একই থানায় আনুমানিক ৪৬ বছরের আরও এক মহিলাকে একইভাবে মেরে ফেলা হয়। দক্ষিণ ২৪ পরগনার পুলিশ সুপার নিজমুখে এই ‘লিঞ্চিং’-এর ঘটনার বর্ণনা করেছিলেন। বুদ্ধিজীবীদের সমাজবাধে এই উড়িশাবাসী গরিব কাপড়ের ব্যবসায়ীর গণপ্রহারে মৃত্যুটা কোনও ভয়ানক ঘটনা ছিল না। তাই তারা টুঁ-শব্দটিও করেননি।

প্রধানমন্ত্রীকে লেখা চিঠিতে জ্ঞানীজনেরা দলিত সমাজের কথা বলেছেন। পশ্চিমবঙ্গে বিগত কয়েক বছরে তথাকথিত অন্তজ সমাজের উপর অবর্ণনীয় অত্যাচার হয়েছে। ২০১৫ সালের ৪ মে নদিয়ার কালীগঞ্জ থানার জুরানপুর গ্রামে দিনের আলোয় হত্যা করা হয় হাজরা পরিবারের তিনজনকে। মারু হজরা (৪৮), অসময় হাজরা (১৮) আর শান্তনা হাজরাকে (৪০)। হাজরারা একেবারে দরিদ্র তপশিলি জাতিভুক্ত পরিবার। ভারত সরকারের আইন প্রিভেনশন অফ অ্যাট্রোসিটিজ এগেন্সট এসসি এসটি, ১৯৮৯ কে বুড়ো আঙুল দেখানো হয়েছিল সেদিন। কোনও সাহায্য, কোনোরকম প্রতিকার, অপরাধের বিচার হয়নি। এসব কথা  জানাবেন বিদ্বজ্জনেরা?

খড়গপুরের তপশিলি জাতি খটিক সম্প্রদায়ের রোহিত তাঁতিকে (৩৪) পিটিয়ে মেরে ফেলা হয়েছিল। নদিয়ার হাঁসখালিতে তপশিলি মেয়ে মৌ রজককে (১৭) ২০১৬ সালের ১০ অক্টোবর অ্যাসিড বালব ছোড়া হয়েছিল। টানা ন’-দশদিন মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে দুর্গাপুজার দশমীর দিন কলকাতার এনআরএস হাসপাতালে বিসর্জন হয়েছিল মৌয়ের। এ ঘটনাগুলি বোধহয় জানতেন না ওই গুণী মানুষেরা।

জানতেন না যখন, তখন বাংলার তথাকথিত দলিত মানুষদের অবস্থাটা সত্যি সত্যি জানুন। সুন্দরবনের গোসাবায় বটতলি একটা অজগ্রাম। সাইকেল ভ্যান ছাড়া কিছুই যেতে পারে না সেখানে। ২০১৩ সালের ১০ অক্টোবর এক নাবালিকাকে ধর্ষণ করে স্থানীয় দুষ্কৃতীরা। তপশিলি জাতিভুক্ত স্থানীয় কিছু যুবকের প্রচেষ্টায় ২০১৭ সালের ১৭ অক্টোবর ওই গ্রামে রূপার বাড়িতে আসেন জাতীয় সিডিউল কাস্ট কমিশনের সদস্য কে রামাল্ল, যোগেন্দ্র পাসোয়ানেরা। সেই রাত্রেই ওই তপশিলি পাড়া আক্রান্ত হয়। যে শিক্ষক দম্পতি ওই ধর্ষিতা মেয়েটিকে নিয়ে দিল্লি গিয়েছিলেন তাদের সেইরাত্রেই গ্রামছাড়া হতে হয়েছে। একবার বটতলি গ্রামে যাবেন নাকি?

পশ্চিমবঙ্গে এই অসহিষ্ণুতার বয়স দেখতে দেখতে বেশ কয়েক দশক হয়ে গেল। সাঁইবাড়িতে প্রণব সাঁই আর মলয় সাঁইদের অপরাধ ছিল তারা ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস দল করতেন। সেই অপরাধে তাদের হত্যা করে তাদের রক্ত ভাতে মেখে সেই ভাত তাদের মা মৃগনয়নী সাঁইকে জোর করে খাওয়ানো হয়। প্রধানমন্ত্রীকে লেখা চিঠিতে লেখা হয়েছে, বাংলা থেকে যারা সই করেছেন তাদের কাছে অনুরোধ যে সাইবাড়ি মামলায় ঠিক কতজনের কী ধরনের শাস্তি হয়েছিল একবার যদি খুঁজে দেখেন।

নিজেদের মতের বিরোধিতা করলেই শেষ করে দাও  এই অসহিষ্ণুতার একের পর এক ঘটনার সাক্ষী পশ্চিমবঙ্গ। ১৯৮২ সালের ৩০ এপ্রিল শহর কলকাতার মধ্যস্থলে বালিগঞ্জের বিজন সেতুতে দিনের আলোয় ১৬ জন সন্ন্যাসী আর একজন সন্ন্যাসিনীকে ট্যাক্সি থেকে নামিয়ে পিটিয়ে পিটিয়ে মারা হল। তারপর তাঁদের গায়ে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হল। হাজার হাজার মানুষের চোখের সামনে জ্বলতে থাকল সতেরোটা দেহ। আজ পর্যন্ত কতজন অপরাধীর শাস্তি হয়েছে বিজন সেতুর ঘটনায় ?

এই অসহিষ্ণুতা,নানারূপে সারা দেশের বিভিন্ন জায়গাতে আজও আছে। সবচেয়ে  বেশি প্রকট রূপে দেখা যায় অতিবাম প্রভাবিত এলাকায়। গত ১৭ এপ্রিল উড়িশার কান্দামালেনকশালপন্থীরা হত্যা করল সংযুক্তা দিগলকে। তার অপরাধ তিনি নির্বাচনী আধিকারিক হিসাবে ভোট নিতে যাচ্ছিলেন। সংযুক্তা দিগলের বছর খানেক আগে বিয়ে হয়েছিল। তিনিও গরিব দলিত পরিবারের মেয়ে ছিলেন। এই অসহিষ্ণুতার প্রতিবাদ হবে না?

গণতান্ত্রিক দেশে আইন নিজের হাতে নেওয়ার অধিকার কারও নেই।  অপরাধীর পরিচয় অপরাধীই। তার বিচার হওয়া উচিত। এবং যত সত্বর হয় ততই ন্যায় হবে। সেটা ৫২ বছরের একলাখকে যারা মেরেছে তাদের জন্যও সত্যি আবার ৩২ বছরের সংযুক্তাকে যারা হত্যা করেছে তাদের জন্যও প্রযোজ্য হওয়া উচিত।  যাঁরা প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি লিখেছেন তাদের সমস্যা হল, তারা মানবতার জন্য লিখছেন না, রাজনীতির জন্য লিখছেন। এনারা ব্যক্তিজীবনে বুর্জোয়া, আর অতিবামপন্থী এনাদের স্টাইল স্টেটমেন্ট, নিজ নিজ ক্ষেত্রে, শিক্ষা, সংবাদ মাধ্যম শিল্প সবক্ষেত্রে এনারা চরম অসহিষ্ণু। নিজেদের আদর্শের না হলে কারোকে বিন্দুমাত্র স্থান দিতে এই বিদ্বজ্জনেরা রাজি ছিলেন না। যাদের জীবন গত ৩০-৪০ বছর এ রাজ্যে কেটেছে তাদের কাছে এটা  আর ভেঙে বলতে হবে না।

বরং আজকের কেন্দ্রীয় সরকারের সময়ে এই মতাদর্শগত অসহিষ্ণুতা অনেক কমেছে। এই চিঠিতে সই করেছেন ঐতিহাসিক রামচন্দ্র গুহ। উনি স্বঘোষিত বিজেপি বা আরএসএস বিরোধী। তাই বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রকের মন্ত্রী বা অন্য সদস্যরাও এটা বিলক্ষণ জানেন। তবু গত জুলাই মাসে ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ সায়েন্সের ভিজিটিং প্রফেসর মনোনীত হয়েছেন। ‘সতীশ ধাওয়ান’ চেয়ার প্রফেসর খুবই সম্মানীয় পদ।  অনেক কিছু যুক্তি দিয়েই মোদি সরকার এই মনোনয়ন আটকাতে পারত। বিজ্ঞান সংস্থায় ঐতিহাসিক কেন? কলকাতার আইআইএস থেকে ওনার যে ডিগ্রি আছে সেটা পিএইচডির সমতুল্য কিন্তু কোনও বিশ্ববিদ্যালয়ের পিএইচডি নয়। যে কারণের জন্য এপিজে আবদুল কালামের মতো বিশ্ববরেণ্য পণ্ডিত মানুষকে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকের পদ দেওয়া যায়নি। একই কারণে রামচন্দ্র গুহাকেও আটকানো যেত। কিন্তু স্পষ্টতই বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকার শিক্ষাক্ষেত্রে বহু বছরের এই অসহিষ্ণুতার পরম্পরা ভঙে বের হয়ে আসতে চেয়েছে। তাদের ঔদার্যের জন্যই ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ সায়েন্সের ‘সতীশ ধাওয়ান’ চেয়ার প্রফেসর হতে পেরেছেন রামচন্দ্র গুহ।

আসলে যারা অসহিষ্ণুতার অভিযোগ করে প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি লিখেছেন তারা মানবতাবোধ থেকে একাজ করেননি।  তাঁদের প্রতিক্রিয়ার মূল কারণ রাজনীতি। তা যদি না হত তবে তো তারা বাংলাদেশে সংখ্যালঘু হিন্দুদের উপর লাগাতার অবর্ণনীয় অত্যাচারে প্রতিবাদ করতেন। পূর্ণিমা শীলের জন্য বা চক্রগ্রামের নাজিরহাট কলেজের অধ্যক্ষ গোপালকৃষ্ণ মুহুরির জন্য এরা একফোটা চোখের জল  ফেলেননি।
বাংলাদেশের মানবাধিকারের জন্য এঁদের চিন্তা নেই, কিন্তু গাজা ভূখণ্ডে ইজরাইলের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে এনারা  রায়, ইরাকে মার্কিন আগ্রাসনের প্রতিবাদে তারা টিভির পর্দা ফাটিয়ে দেবেন। এইসব হৃদয়হীন রাজনীতি দেখে দেখে এ রাজ্যের মানুষ ক্লান্ত হয়ে গেছেন।

পশ্চিমবঙ্গের মানুষ আজ সহজ কথা সহজে বলতে চান। আপনি নামকরা শিল্পী,  খ্যাতনামা পরিচালক, প্রথিতযশা অধ্যাপক কিন্তু আপনার কোনও রাজনৈতিক মতবাদে বিশ্বাস আছে। থাকতেই পারে। বিজেপিকে, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে আপনাদের অপছন্দ হতেই পারে। কিন্তু রাজনৈতিক বক্তব্য রাজনৈতিক ভাবে রাখুন। বিশুদ্ধ রাজনৈতিক কথা বুদ্ধিজীবী বা বিদ্বজ্জনের নাম দিয়ে চালানোর চেষ্টা করবেন না। দোহায় আপনাদের। এতে আপনাদের মতো মানী মানুষের সম্মান নষ্ট হচ্ছে,  রাজ্যবাসীর ভাবমূর্তিও ভূলুণ্ঠিত হচ্ছে!

জিষ্ণু বসু

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.