শারদীয়া রক্তাঞ্জলি : ভূলুণ্ঠিতা দুর্গতিনাশিনী

২০২১। এই বাংলায় বাঙালীরা যখন বছরকার চারদিন আনন্দে মাতোয়ারা, প্রতিবেশী বাংলাদেশে তখন বাঙালীর সবচেয়ে বড় উৎসব রক্তাক্ত। অবশ্য দুর্গাপুজো উৎসব হিসাবে যতই নজরকাড়া ও বাণিজ্যিক লেনদেনের মাধ্যম হোক না কেন, পৃথিবীতে ও এই উপমহাদেশেও মোট বাঙালী জনসংখ্যার ধর্মীয় মানচিত্র অনুযায়ী পুজো হিসাবমতো বাঙালীর ক্ষুদ্রতর জনগোষ্ঠীর উৎসব, যারা ক্রমশ আরও ক্ষুদ্র হয়ে বিলয়ের পথে এগোচ্ছে। অধিকাংশ বাংলাভাষী বা বলা ভালো বাংলাবাসীর উৎসবের মর্যাদা ইদ, মহরম, মিলাদ-উদ-নবী ইত্যাদিরা কেড়ে নিয়েছে। যে এই উৎসবগুলোর জন্মস্থান সুদূর মরূদেশে, সেগুলোর অনুসারীরা বাংলাবাসী হলেও প্রকৃত বাঙালী কিনা, সে তর্কে আপাতত যাওয়ার অবকাশ নেই। কারণ বাঙালীর চিরাচরিত ধর্মীয় উৎসব বাংলারই বিস্তীর্ণ ভূখণ্ড জুড়ে শুধু ধ্বস্তই হয়নি, হয়েছে লুঠপাট, ধর্ষণ, প্রাণহানি, ঘর পোড়ানো, বাস্তুচ্যুতি ইত্যাদির উপলক্ষ্যও। বস্তুত ‘হয়েছে’ বললেও ভুল হয়, হয়ে চলেছে, যে আগুন নিভতে নিভতে ভস্ম ছাড়া কিছু অবশিষ্ট থাকবে কিনা বলা যাচ্ছে না।
ঘটনার সূত্রপাৎ সামাজিক মাধ্যম ও পরে গুটিকতক মিডিয়ার মাধ্যমে সবার জানা। কুমিল্লার একটি দুর্গা মণ্ডপে হনুমানের কোলে একটি ‘পবিত্র’ কোরান আবিষ্কার হয়েছে। তাতে নাকি ‘পবিত্র’ গ্রন্থের অবমাননা হয়েছে; তাই ১৩ অক্টোবর বুধবার মহাঅষ্টমীর দিন কুমিল্লার নানুয়া দীঘি থেকে প্রায় এক কিলোমিটার দূরে চকবাজার এলাকায় (কাপুড়িয়াপট্টি) শত বছরের পুরোনো চাঁদমণি রক্ষাকালী মন্দিরে সকাল ১১টায় প্রথম হামলা দিয়ে পবিত্রকরণ কর্মসূচি শুরু হয়৷

‘হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ’-এর কাছে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী কুমিল্লা ছাড়াও ঐ একই দিনে চাঁদপুর, লক্ষ্মীপুর, গাজিপুর, কুড়িগ্রাম, মৌলভিবাজার, হবিগঞ্জ, সিলেট, ভোলা, চট্টগ্রাম, ও কক্সবাজারেও পুজো মণ্ডপ ও হিন্দুদের বাড়ি বাড়ি হামলা হয়েছে। হামলা ও লুঠপাটের উল্লাস ঐ দিনেই থেমে থাকেনি। ১৪ অক্টোবর বান্দরবান ও নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে, ১৫ অক্টোবর নোয়াখালীর চৌমুহনী ও চট্টগ্রামে পুনরায় ভয়ঙ্কর হামলা হয়েছে৷ ১৬ অক্টোবর শনিবার হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ জানিয়েছে দেশের বিভিন্ন স্থানে দুর্গাপূজার তিন দিনে কমপক্ষে ৭০টি পূজা মণ্ডপে হামলা-ভাঙচুর-লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে৷ মণ্ডপ ও মন্দির ছাড়াও বহু হিন্দু বাড়ি ও দোকানেও অনুরূপ তাণ্ডব চালানো হয়েছে৷ ‘তাণ্ডব’ শব্দটা প্রচলিত অর্থে প্রয়োগ করলেও আসলে অপপ্রয়োগ হয়ে গেল। কারণ তাণ্ডব নেচেছিলেন পত্নীবিরহে কাতর ও হিতাহিত জ্ঞান হারানো স্বয়ং মহাদেব, কোনও খুনি ধর্ষক নয়।
যাইহোক, পরের দিন ১৫ অক্টোবর শুক্রবার জুম্মার নামাজের পর ‘মালিবাগ মুসলিম সমাজ’ এর ব্যানারে ঢাকার বায়তুল মোকাররম থেকে মিছিল বের করেন কয়েকশো মানুষ৷ শনিবার ১৬ই অক্টোবর বাংলাদেশের ব্যানারে প্রায় দশ হাজার মুসলিম বায়তুল মোকাররমের সামনে বিক্ষোভ করেন৷ পুলিসের টিয়ার সেল ও শট গান সহকারে প্রতিরোধেও কোনও হতাহত হয়নি উন্মত্ত জনতার মধ্যে।

মন্দিরে মণ্ডপে হামলার প্রতিবাদে ‘কেন্দ্রীয় পূজা উদযাপন পরিষদ’-এর আহ্বানে সারা দেশে বিক্ষোভ মিছিল ও প্রতিবাদ সমাবেশের ডাক দেওয়া হলে ফেনীতে সেই কর্মসূচির প্রস্তুতি চলার সময়ও হামলা হয়৷ এরপর চলে শহরে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ, আরও কিছু মন্দির ও হিন্দু মালিকানাধীন বেশকিছু দোকানপাটে ভাঙচুর, যানবাহনে অগ্নিসংযোগের মতো ঘটনা৷ বিকেল ৪-৩০ থেকে রাত সাড়ে ১১টা পর্যন্ত ফেনীতে থেমে থেমে সংঘর্ষ হয়েছে৷ ১৭ অক্টোবর রোববার রাতে রংপুরের পীরগঞ্জের এক হিন্দু তরুণের ফেসবুকে ইসলাম অবমাননার অভিযোগ তুলে রামনাথপুর ইউনিয়নে জেলেপল্লীর হিন্দু পরিবারগুলির ওপর হামলা করে ঘরে লুঠপাট, ভাঙচুর ও শেষে অগ্নিসংযোগ পর্যন্ত করা হয়। সংবাদ সংস্থা ‘বাসস’-এর কাছে শেষ পাওয়া খবর অনুযায়ী ৫৮৩ জনকে গ্রেপ্তার ও ১০২টি মামলা হয়েছে। অসংখ্য ছোটবড় ঘটনা, বর্ণনা দিতে গেলে ‘লজ্জা’-র সিকোয়েল লিখতে হবে।
শুধু ভাঙচুর লুঠপাট নয়, হয়েছে বেশ কিছু খুন ও গণ ধর্ষণের মতো ঘটনাও যার জেরেও একটি দশ বছরের বালিকার মৃত্যু হয়েছে। তার মা ও ঠাকুমাকেও একই ঘরে একই দল গণধর্ষণ করে আশঙ্কাজনক অবস্থায় ফেলে যায়। তাঁরা বেঁচে আছেন কিনা জানা নেই। পুজোর ক’দিন অতিক্রান্ত হওয়ার পরেও নোয়াখালীসহ একাধিক জায়গায় নতুন করে কাফের নিধনের সংবাদ পাওয়া গেছে। অসমর্থিত সূত্রে খবর এক প্রসূতীকে গণধর্ষণ করে হত্যা করা হয়েছে এবং মৃত্যু নিশ্চিত করার পরেও বেশ কিছুক্ষণ লিঙ্গোৎপাত সক্রিয় ছিল। ভুক্তভোগী সম্প্রদায়ের এবং গুটিকয় ব্যতিক্রমী নিরপেক্ষ সংবাদাতারা ক্লান্ত হয়ে গেলেও ঘটনার ধারাবাহিকতা এখনও থামেনি। এই লেখা প্রকাশ পেতে পেতে মৃত, ধর্ষিত, বাস্তুচ্যুত এবং ফলত ভারতে শরণার্থীর সংখ্যা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে, কোনও ধারণা নেই। নিত্য আপডেট পেতে মুখপুস্তক ও হোয়াট্‌স্অ্যাপ অনুসরণীয়, কারণ নিখাদ সত্য হোক বা অতিরঞ্জিত – খবর যা পাওয়ার সেখানেই মিলবে; মূল স্রোতের মিডিয়ার তো হামলা শুরুর ১৩ দিন পরেও ভালো করে ঘুম ভাঙেনি, সবে হাই উঠছে।

এবার আবার পিছিয়ে একটু গোড়া থেকে আরম্ভ করে কতগুলো প্রশ্ন ঝালিয়ে নিই।

১) পুজো মণ্ডপ থেকে কোরআন উদ্ধার করে কোতোয়ালি থানার ওসি আনোয়ারুল আজ়িম৷ কিন্তু খবরে প্রকাশ, পুজোর উদ্যোক্তারাই ওসি সাহেবকে খবর দিয়েছিল মণ্ডপে কোরআন আছে বলে। তা তিনি তেনাদের পাক কেতাব উদ্ধার করার পরেও কীভাবে সন্ত্রাস ছড়িয়ে পড়ল? খবরটা কি পুলিস প্রশাসনই দায়িত্ব নিয়ে ধর্মান্ধ জনতার মধ্যে ছড়িয়ে দিয়েছিল?

২) শৌচাগারে নয়, আস্তাকুঁড়ে নয়, মানুষের পায়ে নয়; কোরআন পাওয়া গিয়েছে দেবীর মণ্ডপে একটি মূর্তির কোলে। তবুও ঐ সন্ত্রাস প্রশিক্ষণ পুস্তকটি অপবিত্র হয়ে গেল? কোনও কোনও মণ্ডপে তো মোল্লাদের দ্বারা আজানও দেওয়া হয় শুনেছি। দুর্গা মণ্ডপে আজান হলে আজান অপবিত্র হয় না, আর কোরআন রাখা থাকলে কোরআন অবমাননা হয়ে যায়? কী বিচিত্র ধর্মবোধ!

৩) এই প্রথম দুর্গা পুজোয় আক্রমণ হয়নি। এই মূর্তি ভাঙা, পুজো পণ্ড, হিন্দু বাড়ি লুঠপাট বাংলাদেশে একটি বাৎসরিক উৎসব। বস্তুত সারা বছরই অল্পবিস্তর চলতে থাকে। আগে সোশাল মিডিয়ার অভাবে সব খবর পাওয়া যেত না। যারা গড়তে জানে না, নষ্ট করেই তাদের সুখ; কারণ কাজটা সহজ এবং সাফল্য তাৎক্ষণিক ও নিশ্চিত। এই ঘটনাক্রম ২০১৪-য় ভারতে বিজেপি সরকার আসার পর দিনে দিনে মাত্রাছাড়া হয়েছে। ভারত সরকারের নেকনজরে থাকা হাসিনার আওয়ামি লীগ সরকারের প্রশাসন খুব ভালো করেই এসব জানে। প্রতিটি মণ্ডপেই তাই নাকি পুলিসি নিরাপত্তা থাকে। এখন পুলিস নিরাপত্তা দিচ্ছিল না সন্ত্রাসীদের উস্কানি? আর সেটা কি প্রধানমন্ত্রীর অমতে সম্ভব? ভারতের মতো যুক্তরাষ্ট্রে পুলিস রাজ্যের অধীনে বলে রাজ্যে রাজ্যে বিবিধ ছবি। কিন্তু বাংলাদেশের মতো পুঁচকি রাষ্ট্রে কটা রাজ্য আছে?

৪) মূর্তির কোলে কোরআন সাজিয়ে রাখার মতো আত্মঘাতী কাজ যে হিন্দুরা করেনি, তা জানা কথা। তবু তিন দিন ধরে তছনছ চলল। তারপর আবিষ্কৃত হল ইকবাল হোসেন (৩৫) নামের এক ব্যক্তি কোরআন রেখেছে। তাকে ও পরে আরও দু’জন অভিযুক্তকে আটক করা হয়েছে। সে নাকি মানসিক ভারসাম্যহীন, পরিবার বিচ্ছিন্ন নেশাখোর। সে পাগোল বা সেয়ানা যাই হয়ে থাক, কিন্তু সে বা তার সহযোগীরাই কি শুধু ষড়যন্ত্র করেছে? তাহলে দেশজুড়ে দলে দলে গুজব ছড়িয়ে হিন্দু নিষ্পেষণে মেতে উঠল কারা? কেনই বা সংবাদ মাধ্যম সংবাদ চেপে রেখেছিল? কেন হামলার খবর প্রকাশ ও প্রচারে ‘সংযমী’ থেকে তারা নির্যাতন, লুঠপাট, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগের ঘটনা পাশ কাটিয়ে গিয়েছিল, যার ফলে নির্যাতনের বলিরা আরও বেশি নির্যাতনের মুখে পড়ে? চাঁদপুরে ৪ জন ও অন্যত্র আরও একাধিক ব্যক্তির হত্যার ঘটনা, নোয়াখালী ও রংপুরে বর্বরতার চিত্র কেনই বা চেপে যাওয়া হয়? স্পষ্টত বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমও সংখ্যালঘুদের সঙ্গে সংখ্যাগুরুর আচরণই করেছে। সর্বোপরি সংবাদ পাওয়ার পরেও অরাজকতা দমনে রাষ্ট্রের পদক্ষেপ নিতেই বা এত দেরি হল কেন যে সুযোগে হামলাকারীরা নির্যাতনের মাত্রা বাড়াতে পেরেছে?

৫) নোয়াখালীর চৌমোহনীতে জুম্মার নামাজের ঠিক আগে মন্দিরে হামলার সময় পুলিস পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল, কিন্তু কোনও পদক্ষেপই নেয়নি। যারা মন্দির লক্ষ্য করে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করছিল, তারা সবাই ঐ এলাকার পরিচিত মুখ। মন্দির কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে যা তাদেরকে তারা চেনে, কিন্তু ভয়ে নাম প্রকাশ করতে পারছে না। কারণ পুলিসি নিস্ক্রিয়তায় তাদের আশঙ্কা, হামলাকারীদের নাম সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশ করলে অবস্থা আরো ভয়াবহ রূপ ধারণ করবে। [সূত্রঃ একাত্তর টিভি।] প্রশ্ন: মন্দিরে আক্রমণের সময় এলাকাবাসী দুর্বৃত্তদের চিনতে পারলেও সেখানে দাঁড়িয়ে থাকা পুলিস কেন পারেনি? ঘটনা ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার পর সরকারের তরফে উদারতা সহিষ্ণুতা নিয়ে অনেক বড়ো বড়ো বুলি শোনা গেল। কিন্তু সেসব সেই সকল বুলি প্রশাসন বা হামলাকারীরা কেউই পাত্তা দিচ্ছে না। তাহলে দেশ চালাচ্ছে কারা? সরকার কি তবে ব্যার্থ, নাকি এই সব কিছুর মধ্যে সরকার দলের লোকেদেরও হাত আছে?

৬) সারা দেশ জুড়ে হিন্দুদের ওপর যে নৃশংসতা নোংরামো ধ্বংসলীলা জমিদখল চলল, তার দায় কি শুধু জনৈক ইকবাল ও তাকে ব্যবহার করা দুজন মোল্লার ওপর চাপিয়ে দেওয়া যায়? আর দেব প্রতিমার কোলে কোনও ধর্মগ্রন্থ থাকলে সেটা তো সেই বইটিকে মর্যাদা দেওয়া হয়। তাকে কেন্দ্র করে এমন হিংস্রতা পূর্ব প্রস্তুতি ছাড়া সম্ভব? একটা পরিকল্পিত এথনিক ক্লিনজিংকে একজন ইয়াবা খোরের কীর্তি হিসাবে চালিয়ে কি রাষ্ট্র নিজের হাত ধুয়ে ফেলতে চাইছে না?

    বাংলাদেশ সরকার যে নিজেদের ব্যর্থতা বা সাম্প্রদায়িক দুরভিসন্ধি চাপা দেওয়ার চেষ্টা করবে, তা প্রত্যাশিত। কিন্তু তার লাগোয়া আরেক বাংলাতেও সরকারের তরফে এই ধারাবাহিক ও চরম বর্বরতাকে নিন্দা করে কিছু বলা হয়েছে কি? কী করে হবে? সেখানেও তো একই প্রক্রিয়া চলেছে যেখানে সংখ্যাগুরু নয় তথাকথিত সংখ্যালঘুরাই যে কোনও অপরাধ করার লাইসেন্স নিয়ে বুক ফুলিয়ে ঘোরে। এই পরিস্থিতিতে ফেসবুকে বুদ্ধিজীবীদের ‘সিলেক্টিভ কান্না’ সিরিয়ালে ঠিক দেড় দিন ধার্য হয়েছে সনাতনীদের নামে নাকি কান্নার পর্বের জন্য। পশ্চিমবঙ্গের কবি লেখকরা বাংলাদেশে শান্তিরক্ষার আবেদন করতে গিয়ে এত কাণ্ডের পরেও মুজিব ও হাসিনার গুণ কীর্তন আর সাম্প্রদায়িক অশান্তির জন্য ভারতের অর্থাৎ হিন্দুদের প্রধান দায় স্বীকার করছে, যাতে করে নিজেদের বাংলাদেশ সফর অব্যাহত থাকে, আবার মুসলিম ভোট নির্ভর পশ্চিমবঙ্গ সরকারকেও সন্তুষ্ট রাখা যায়।

জাতীয়তাবাদী রিপাবলিক বাংলা থেকে মৌলবাদী এবিপি আনন্দ – সর্বত্র আমন্ত্রিত বুদ্ধিজীবীদের মতে ভারতেও নাকি অনুরূপ ঘটনা ঘটে মুসলিমদের সঙ্গে! এর চেয়ে মিথ্যে আর কী হতে পারে? কিন্তু বুদ্ধিজীবী নামাঙ্কিত প্রানীগুলোর কাছে এটাই প্রত্যাশিত। কারণ তাদের আদালতে গুজরাট কাঠগড়ায় দাঁড়ায়, কিন্তু গোধরা কাণ্ড বেকসুর খালাস পায়। ভারতে যে কখনও অকারণে একতরফা সংখ্যালঘু নিধন হয় না, তা এঁদের খুব ভালো করে জানা। সংখ্যাগুরুরা মার খেয়ে আত্মরক্ষার জন্য পাল্টা দিলেই দ্বিতীয় সংখ্যাগুরুরা ভিক্টিম কার্ড খেলা শুরু করে শোরগোল ফেলে দেয় তো এঁদেরই প্রত্যক্ষ মদতে।

আসলে হিন্দুত্বের সঙ্গে বাঙালীত্বের অবিচ্ছেদ্য সম্পর্কটা অস্বীকার করার প্রস্তুতি চলেছে বহুদিন ধরেই। বাঙালী হিন্দুর সামনে দু’টি পথ খোলা– হয় জেহাদের আগুনে ঝলসে মরো, নতুবা দলে দলে ধর্মান্তরিত ধর্মোন্মাদে পরিণত হয়ে বাংলা ও ইসলামের অভিন্নতা প্রমাণ করো। এভাবে হারিয়ে যেতে বসেছে দুর্গা, কালী, লক্ষ্মী, সরস্বতী পুজোর মাধ্যমে হিন্দু ধর্মে দেওয়া নারীর প্রতীকী শক্তির রূপটিও। মাতৃপূজার সঙ্গে বাঙালীর আবেগ অধিকতর সম্পৃক্ত হলেও ভারতের বাকি হিন্দুদের কি ছিটেফোঁটাও নেই? অবশ্যই আছে। নাহলে জম্মুর বৈষ্ণদেবী থেকে তালিমনাড়ুর মীনাক্ষী মন্দির পর্যন্ত এত ভক্তের ভিড় হত না। ভারতবর্ষ তো বটেই, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, আফগানিস্তান, নেপাল জুড়ে, তীব্বত, শ্রীলঙ্কার, মায়ানমারের কয়েকটি স্থানে, এমনকি চীনেরও এক স্থানে রয়েছে শক্তিপীঠ। এগুলো গড়ে উঠেছে সতীমাতার দেহের বিভিন্ন অংশ পড়েছে, এই পৌরাণিক আখ্যান আশ্রয় করে। আমি তো বলি, “শক্তিপীঠ যেখানে হিন্দুভূমি সেখানে; সতীপীঠ যতদূর ভারতবর্ষ ততদূর।” শিবের চরণস্পৃষ্ট ও মহামায়া আদ্যাশক্তির দেহাংশ ধন্য বলেই দেশকে আমরা ‘মাতৃভূমি’ বলি। এই বিস্তীর্ণ পুণ্যভূমির অধিকাংশ জুড়েই আজ স্বয়ং জগন্মাতার লাঞ্ছনা চলেছে, শিবের অসম্মান হচ্ছে। এভাবে তো পুরাণ ও প্রাচীন দর্শন আধারিত মাতৃ উপাসনাই হিন্দু সংস্কৃতি থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। ধ্বংস হয়ে যাবে প্রকৃত বাঙালী জাতিসত্তাও। আর সেটা হলে ধস নামবে ভারতীয় সংস্কৃতিতেও। মধ্যযুগে বিধ্বস্ত হিন্দু সমাজে প্রথম সুসংস্কার এসেছে বাঙালী মহাপুরুষদের হাত ধরেই। এসেছে জাতীয়তাবোধও।

কিন্তু আজ বাঙালী মণীষার সিংহভাগ জেহাদের উর্বর জমি। অবশিষ্টদের মধ্যেও একটা অংশ বুদ্ধিজীবী তকমা পেয়ে বিকারগ্রস্ত। প্রত্যাশিতভাবেই তারা ধর্ষক ও ধর্ষকামী মতবাদের হয়ে সাফাই গেয়ে বাংলাকে আরবের হারেমে পাঠিয়ে শান্তিরক্ষার অভিনয় করছেন। এদের কাছে সত্যিই কিছু আশা করা যায় না। কিন্তু যাদের কাছে আশা করা যায়, তাদের ভূমিকা কী? হ্যাঁ, বিভিন্ন হিন্দু সংগঠন তো বটেই, একটু সময় নিলেও রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সঙ্ঘ ও ভারতীয় জনতা পার্টির পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য শাখা বাংলাদেশে পুজো পণ্ড পর্বের নিন্দায় মুখর হয়েছে। ব্যাপক হিংস্রতা ও হিন্দু হত্যালীলার জেরে পশ্চিমবঙ্গের অতি সহনশীল হিন্দুদেরও সামাজিক মাধ্যমে ক্ষোভ চাপা থাকেনি। কিন্তু তাই দেখে যে হাসিনা আগাম হুঁশিয়ারি দিয়েছেন, ভারতে যেন এই হিংসার কোনও প্রতিক্রিয়া না হয়, হলে বাংলাদেশের অবশিষ্ট হিন্দুদের তার ফল ভোগ করতে হবে; এই স্পর্ধার কোনও জবাব কি আমাদের শক্তিশালী সেনা সমন্বিত সুবিশাল দেশের সরকারের কাছে নেই?

বিদেশনীতির সৌজন্যে বাংলাদেশ ভারতের সরকারের কাছে এত শতসহস্র উপহার উপঢৌকন ও বাণিজ্যিক সুবিধা ভোগ করার পরেও সেখানে ধারাবাহিকভাবে হিন্দু হত্যা ও বাস্তুচ্যুতি চালিয়ে যাচ্ছে, যার জেরে এই ভারতেই শরণার্থীর চাপ বাড়ছে? জানি না বাংলাদেশকে আধিকার করা সম্ভব কিনা বা সেটা করেও সমস্যার সমাধান হবে কিনা। তবে সবরকম বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিন্ন করলে বাংলাদেশ যতটা চাপে থাকবে, ভারতেরও কি ততটা ক্ষতি হবে? বাংলাদেশকে স্বাধীন থাকতে দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়, বরং চীনের সাম্রাজ্য বিস্তারের পথ খোলা থাকবে। ভারতের একমাত্র জাতীয়তাবাদী দল দ্বারা গঠিত কেন্দ্র সরকারের কাছে বিষয়টি নিয়ে ভাবার আবেদন রইল।

প্রসঙ্গত যা ঘটেছে, তা নতুন কিছু নয়। যে দেশটাকে স্বাধীন করতে হিন্দু বাঙালীর প্রাণ গেছে লক্ষ লক্ষ, সেই দেশ থেকে এমন বিশ্বাসঘাতকতা হিংস্রতা পেতে পেতে অভিমানের চরমে পৌঁছে বাংলাদেশের হিন্দুরা স্থির করেছে, এ বছর দীপাবলীতে তারা উৎসব করবে না। তাতে ক্রমশ তালিবানপন্থা গ্রাস করা দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনতা তথা সরকারের বয়েই গেছে। তারা তা এটাই চায়। কিন্তু সঙ্গত সহমর্মীতায় পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য বিজেপির উদ্বাস্তু প্রকোষ্ঠ থেকে আপামর হিন্দুদের কাছে আবেদন করা হয়েছে, এ বছর এই বাংলাতেও দীপাবলীর আলোকসজ্জা বর্জন করে নিজেদের বাড়ির নীচে যথোপযুক্ত পোস্টার লাগিয়ে কারণটা মানুষকে জানিয়ে দিতে।

খুব সংবেদনশীল প্রস্তাব। সঙ্গে একটি প্রশ্ন আমিও রাখছি: বাঙালী হিন্দু তো কাশ্মীরী হিন্দুদের জন্যও গলা ফাটায়, পাকিস্তান আফগানিস্তানের অবাঙালী হিন্দুদের জন্যও কাঁদে। তার বিপর্যয়ে একবারের কি জন্য পুরো ভারতবর্ষ দীপ নিভিয়ে প্রতীকী প্রতিবাদেও পাশে দাঁড়াতে পারে না? ভারতবর্ষকে স্বাধীন করার জন্যও তো এই হিন্দু বাঙালীরাই প্রাণ বিসর্জন দিয়েছিল সবচেয়ে বেশি।

শ্রীপর্ণা বন্দ্যোপাধ্যায় (Sriparna Bandyopadhyay)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.