২০১৩-র ৪ অক্টোবর মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে মহাকরণে শেষ কাজ করেন মমতা। এর পর ‘নবান্ন’-তে স্থানান্তরিত হয় রাজ্যের মূল সচিবালয়। পর্যায়ক্রমে সরিয়ে দেওয়া হয় মহাকরণের বিভিন্ন বিভাগ। এর পর কেটে গিয়েছে আট বছরের ওপর। প্রশ্ন উঠছে, কেন এতদিনেও শেষ হল না সংস্কারের কাজ? এখন এই সংস্কার কোন পর্যায়ে?
কাজ শুরুর আগে বছর দুই ধরে সমীক্ষা হয় মহাকরণের সংস্কার নিয়ে। কতটা অংশ কী ভাবে ভাঙা হবে, তা ঠিক করতে বিভিন্ন স্তরে কয়েক ডজন বৈঠক হয়। সমীক্ষার পর যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্যবিদ্যার শিক্ষক মধুমিতা রায় এ ব্যাপারে রিপোর্ট জমা দেন রাজ্য সরকারকে।
১৭৭৬ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ক্লার্ক বা রাইটারদের থাকার জন্য লালদিঘির পাড়ে তৈরি হয় এই ভবন। নাম দেওয়া হয় রাইটার্স বিল্ডিং।নির্মাণকাজ চলে ১৭৭৭ থেকে ১৭৮০ সাল পর্যন্ত। পরে ধাপে ধাপে ১৮২১, ১৮৬০, ১৮৮০-’৮২, ১৮৮৯ এবং ১৯০৬ সালে এর সম্প্রসারণ করা হয়। মহাকরণের মাঝখানের ফাঁকা জায়গায় তৈরি হয় নতুন আরও চারটি ভবন। স্বাধীনতার পর থেকে রাজ্য সরকারের সদর দফতর ছিল এই ভবন।
যাদবপুরের শিক্ষক-স্থপতির তৈরি নকশায় মহাকরণের ওই চারটি ভবন ভেঙে ফেলে পিছনের ব্লকগুলিকে আরও চওড়া করে মহাকরণকে একটি সার্বিক রূপ দেওয়ার কথা বলা হয়। মধ্যের ফাঁকা অংশে একতলা ভবনটি জুড়ে দেওয়ার কথা বলা হয় মেন ব্লক এবং পিছনের ব্লকের সঙ্গে। ওই ভবনগুলিতে ভিআইপি-লাউঞ্জ, ক্যান্টিন, রেস্তোরাঁ ইত্যাদি রাখার প্রস্তাব হয়। ঠিক হয়, উপরের ছাদে তৈরি হবে বাগান। একটি অংশে একটি জাদুঘর তৈরির পরামর্শও ছিল। এই ভাবনাকে সমর্থন জানায় রাজ্য প্রশাসনের মহাকরণ সংস্কার সংক্রান্ত টেকনিক্যাল কমিটি।
কিন্তু তাঁদের তৈরি রিপোর্টটি নিয়ে হেরিটেজ কমিশন আপত্তি জানায়। কমিশন বলে, এই নকশা মহাকরণকে বদ্ধ করে তুলবে। বাগান তৈরির ভাবনার বাস্তবতা নিয়ে প্রশ্ন তোলে তারা। তাদের বক্তব্য ছিল, মহাকরণে জাদুঘর তৈরি হলে সাধারণ মানুষের আসা-যাওয়া নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না। তাতে নিরাপত্তা ব্যবস্থা বিঘ্নিত হতে পারে। মহাকরণ সংস্কারের দু’টি স্তর রয়েছে। একটি তার পুরনো চেহারা ফিরিয়ে দেওয়া এবং অন্যটি বর্তমান সময়ের কথা ভেবে মহাকরণের প্রয়োজনীয় পরিবর্তন করা। কমিশন বলে, এই দু’টি বিষয়ের উপরে জোর না দিয়ে যাদবপুরের ৫০ পাতার রিপোর্টের মধ্যে ২৮ পাতা জুড়ে রয়েছে শুধু মহাকরণের ইতিহাস।” অথচ পুরনো ভবন সংস্কারের জন্য যে সব পূর্ব-সমীক্ষা করতে হয়, তা করা হয়নি।
হেরিটেজ কমিশনের এক কর্তার বক্তব্য, পুরনো ভবন সংস্কারের কাজ শুরু করার আগে তার ত্রুটি-চিহ্নিতকরণ (ডিফেক্ট ম্যাপিং) সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। সারা বিশ্বে কাজে স্থপতিরা এ বিষয়ে বার্নার্ড এম ফিল্ডেনকে গুরু বলে মানেন। ফিল্ডেনের বইতে এ ধরনের ভবনের পরিস্থিতি-সমীক্ষা (কন্ডিশন সার্ভে) কী ভাবে করা উচিত, তার বিস্তারিত বিবরণ দেওয়া রয়েছে। কিন্তু কমিশনের কর্তাদের দাবি, “যাদবপুরের রিপোর্টে এ ধরনের কোনও সমীক্ষা করা নেই।”
মহাকরণ তৈরির সময়ে বিদ্যুতের ব্যবহার ছিল না। অগ্নি-নির্বাপণ ব্যবস্থা, লিফ্ট, এসি, কম্পিউটার আর তারের জালও ছিল না। ফলে যত দিন গিয়েছে মহাকরণের অগ্নিরোধক ব্যবস্থা নড়বড়ে হয়ে গিয়েছে। কমিশনের বক্তব্য, এ ব্যাপারে কী করা হবে, তার নির্দিষ্ট প্রস্তাবও যাদবপুরের রিপোর্টে ছিল না। হেরিটেজ কমিশনের আপত্তিগুলি খতিয়ে দেখে যাদবপুরের স্থপতির প্রস্তাব সংশোধন করার চেষ্টা হয়। মায়ানমারে ইয়াঙ্গনের সচিবালয়টি হুবহু রাইটার্স বিল্ডিংয়ের ধাঁচেই তৈরি। তার সংস্কারের কাজ করেছিলেন ফিলিপ ডেভিস। সে কারণে তাঁর পরামর্শও নেওয়া হয়।
এই মতানৈক্যের মধ্যেই চলতে থাকে ভাঙাভাঙির কাজ। এ ব্যাপারে প্রশ্ন করলে মধুমিতা দেবী এই প্রতিবেদককে বলেন, “এটুকুই বলতে পারি, হেরিটেজ কমিশন যে সব প্রশ্ন তুলেছিল, তার জবাব দেওয়া হয়েছিল। এখন এ নিয়ে কোনও মন্তব্য করব না।” এই রিপোর্ট তৈরির সঙ্গে যুক্ত যাদবপুরের অন্য অধ্যাপকেরা বলছেন, “হেরিটেজ কমিশনের বুঝতে কোথাও ভুল হয়েছে। এটা তো বিস্তারিত রিপোর্ট ছিল না।“
যাই হোক, এ রকম একটা অবস্থায় ভাঙার কাজ শুরু হয় ২০১৪-র মে মাসের প্রথম সপ্তাহে। সংস্কার শুরুর পর পূর্ত দফতর জানিয়েছিল, যাবতীয় তথ্য ওয়েবসাইটে দেওয়া হবে। যা দেখে সাধারণ মানুষ তাঁদের ভাবনা এবং মতামত জানাতে পারবেন। তা সেভাবে হয়নি। দু’টি পর্যায়ে আটটি ব্লক ভাঙা হয়। এর আয়তন প্রায় আড়াই লক্ষ বর্গফুট। তদারকির মূল দায়িত্বে থাকা পূর্ত দফতরের এগজিকিউটিভ ইঞ্জিনিয়ার ২০১৫-র ৬ জুন এই প্রতিবেদককে তিনি জানিয়েছিলেন, দু’টি পর্যায়ে হবে ভাঙার কাজ। প্রথম পর্যায়ের কাজ হবে জুলাইয়ের দ্বিতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত। ইতিমধ্যে দ্বিতীয় পর্যায়ের ভাঙার টেন্ডার চূড়ান্ত করা হবে। ভেঙে ফেলা অংশগুলোয় হবে সৌন্দর্যায়ন এবং সুবজায়নের কাজ। কিন্তু প্রস্তাবিত সৌন্দর্যায়ন এবং সুবজায়নের কাজ কিছুই হয়নি।
কত টাকা লাগার কথা ছিল এই ভাঙাভাঙিতে? এই প্রতিবেদককে পূর্ত ইঞ্জিনিয়ারেরা ২০১৪-তে জানিয়েছিলেন, “এর জন্য উল্টে সরকার টাকা পাবে। যাঁরা ভাঙার বরাত নিয়েছেন, তাঁরাই দেবেন টাকা। কত টাকা, তা ঠিক করার নির্দিষ্ট কিছু রূপরেখা আছে। বাড়িটি কত পুরনো, কী দিয়ে তৈরি— এ সব খতিয়ে হার নির্ণয় হয়। প্রথম পর্যায়ের ভাঙাভাঙিতে পাওয়া যাচ্ছে প্রায় ৪৬ লক্ষ টাকা।“
বিবাদি বাগ এলাকায় অফিস স্পেসের দাম সে সময় নাকি বর্গফুটপিছু ছিল প্রায় ২০ হাজার টাকা। সেই হিসাব দেখিয়ে বিরোধিরা অভিযোগ তোলেন, প্রায় ৫০০ কোটি টাকার জিনিস ধ্বংস করে ফেলা হচ্ছে। তাদের মতে, এই টাকা উন্নয়নের কাজে ব্যবহার করা যেত। সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক সূর্যকান্ত মিশ্র দাবি করেন, এ ব্যাপারে রাজ্য সরকার শ্বেতপত্র প্রকাশ করুক।
এখন সংস্কারের কী অবস্থা? প্রশাসনের দাবি, ঐতিহ্য বজায় রেখে মহাকরণকে স্বাধীনতাপূর্বের অবস্থায় ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য সব রকম চেষ্টা হচ্ছে। দেরির অন্যতম কারণ, গত ৭৫ বছরে এখানে কোন অংশে কতটা সংযোজন হয়েছে, সে ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া। এর জন্য পুরনো ও প্রামান্য ছবি সংগ্রহ করা হয়েছে। মহাকরণের গ্রন্থাগারেও পাওয়া গিয়েছে এ ব্যাপারে নির্দিষ্ট তথ্য ও ছবি। ব্লক ওয়ান, ব্লক টু এবং মেন ব্লকের একাংশ সংস্কার করা হয়েছে। ব্লক ওয়ানের ঘরগুলোর কাঠামো একই রাখা হয়েছে। সেখানে দরজা ও ঘর আরও বেশি লম্বা করা হয়েছে, বিদ্যুৎ সংযোগব্যবস্থা আমূল বদল করা হয়েছে। মহাকরণ সংস্কারে মোট ১৫০ কোটি টাকা খরচ ধরা হয়েছিল। এখনও অবধি ৪০ কোটি টাকার কাজ হয়েছে বলে সূত্রের দাবি। ফ্লোরিং আর ফিনিশিংয়ের কাজ বাকি, বাদবাকি সবই হয়ে গিয়েছে।
কাঠামো সংস্কার হলেও, এখনও অনেক কাজ বাকি।পূর্ত ইঞ্জিনিয়াররা এই প্রতিবেদককে জানান, ’২০-র এপ্রিলে করোনা শুরুর পর থেকে কাজ বন্ধ ছিল। ১ ও ২ নম্বর ব্লকের মাঝে এবং ৩ ও ৪ নম্বর ব্লকের মাঝে যে দুটি বড় বাড়ি ছিল, সেগুলো পুরো ভেঙে ফেলা হয়েছে। ৩ এবং ৪ নম্বর ব্লকের মাঝে এবং ৪ ও ৫ নম্বর ব্লকের মাঝে দুটি বড় বাড়ি আছে। সে দুটি ভাঙতে হবে। কিন্তু ৪ নম্বর ব্লকে আছে গোটা ভবনের বিদ্যুতের নিয়ন্ত্রণকেন্দ্র। এটিকে প্রতিস্থাপন করা বেশ সময়সাপেক্ষ কাজ। সেটায় ভেবেচিন্তে এগোতে হবে। কারণ, মহাকরণের বিভিন্ন অংশে বেশ কিছু বিভাগ আছে। বিদ্যুৎবিহীন অবস্থায় সেগুলো থাকলে চলবে না।
বিবাদী বাগের এই লালবাড়ি কয়েক যুগের ইতিহাসের সাক্ষী। কবে শেষ হবে সংস্কারের কাজ, উত্তর জানা নেই পুর্ত দফতরের কর্তাদের। তাঁদের একজনের দাবি, যা যা করার পরিকল্পনা, ধরে নিতে পারেন তার প্রায় ৩৭ শতাংশ কাজ হয়েছে। সব মিলিয়ে, দীর্ঘকালের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভবন মহাকরণ যেন ক্রমেই ডুবে যাচ্ছে বিস্মৃতির আড়ালে।
অশোক সেনগুপ্ত