অটলবিহারী বাজপেয়ী, না নরেন্দ্র মোদী— প্রধানমন্ত্রী হিসেবে সাফল্যের নিরিখে কে কতখানি এগিয়ে? প্রায়শই এইরকম একটি প্রশ্ন বিভিন্ন মহল থেকে উঠে আসে। বাজপেয়ীর সঙ্গে মোদীর তুলনা করতে চান অনেকেই। অবশ্য এরকম তুলনা করায় অন্যায়ের কিছু নেই। বরং, এটিই স্বাভাবিক। স্বাধীনোত্তর ভারতে সত্তর বছরের সংসদীয় রাজনীতির ইতিহাসে ভারতীয় জনতা পার্টির প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দুই ব্যক্তিই লালকেল্লায় ভাষণ দেবার বিরল সম্মান অর্জন করেছেন। একজন অটলবিহারী বাজপেয়ী এবং দ্বিতীয়স্থানে অবশ্যই নরেন্দ্র দামোদরদাস মোদী। অটলবিহারী তার পাঁচবছরের প্রধানমন্ত্রিত্বকাল পূরণের পর দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় ফিরে আসতে পারেননি। নরেন্দ্র মোদী পাঁচ বছর প্রধানমন্ত্রিত্ব করার পরও দ্বিতীয়বার আরও বিপুল গরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় ফিরে এসেছেন। অটলবিহারী বাজপেয়ীকে পাঁচটি বছর শরিক নির্ভর হয়ে কেন্দ্রে একটি সরকার চালাতে হয়েছিল। নরেন্দ্র মোদীকে শরিকদের ভরসায় সরকারটি চালাতে হয়নি, এবারও হচ্ছে না। তবু নরেন্দ্র মোদীকে বারবার অটলবিহারী বাজপেয়ীর সঙ্গে তুলনার মুখোমুখি পড়তে হবে, কেননা অটলবিহারীর ছায়াটি অতীব দীর্ঘ। এই দীর্ঘ ছায়াকে অতিক্রম করে যাওয়া যে কোনো মানুষের পক্ষেই দুঃসাধ্য। অটলবিহারী বাজপেয়ী প্রসঙ্গে বলতে গেলে একটিই কথা বলতে হবে, তা হলো, দক্ষ রাজনীতিবিদ অনেকেই হন, কিন্তু স্টেটসম্যান বা রাষ্ট্রনায়ক দু-একজনই হন। অটলবিহারী সেই দু-একজনের ভিতর রয়েছেন। নরেন্দ্র মোদী একজন অতীব দক্ষ রাজনীতিবিদ। তাঁর সামনে একটিই শিখর ছোঁয়ার বাকি রয়েছে। সেই শিখরটির নাম অটলবিহারী বাজপেয়ী। এই শিখরটি তিনি যতদিন না ছুঁতে পারছেন, ততদিন অটলবিহারীর সঙ্গে তার তুলনা টানাটি অনর্থক। ফলে, কোনো তুলনা নয়, নরেন্দ্র মোদীর রাজনৈতিক দক্ষতার এখন বিচার করতে হবে কতগুলি সাফল্যের সিঁড়ি তিনি পেরিয়ে এলেন।
তিন-তিনটি দফায় গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী থাকার পর ২০১৪ সালে লোকসভা নির্বাচনে বিপুল সাফল্যকে সঙ্গী করে নরেন্দ্র মোদী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন। এখন প্রশ্ন উঠতেই পারে, ২০১৪ সালে ভারতীয় জনতা পার্টি, বিশেষত সঙ্ঘ পরিবার, নরেন্দ্র মোদীকেই প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী হিসেবে বেছেছিল কেন? ওই সময় বিজেপির ভিতরেই অন্তত জনা তিনেক মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন, যাঁরা প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী হিসেবে যথেষ্টওজনদার নাম হিসেবেই বিবেচিত হবেন। তবু নরেন্দ্র মোদীকে প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী হিসেবে বেছে নেওয়ার একটাই কারণ ছিল যে উন্নয়ন এবং হিন্দুত্ব দুইয়ের সংমিশ্রণ নরেন্দ্র মোদীর মতো এমন কেউই করতে পারেননি। এবং এই দুইয়ের সমন্বয় করে নরেন্দ্র মোদী নিজের জনপ্রিয়তা ও গ্রহণযোগ্যতাকেও অনেক বাড়িয়ে নিয়েছিলেন। সঙ্ঘ পরিবার এবং বিজেপি যে নরেন্দ্র মোদীকে বেছে নেওয়ায় ভুল কিছু করেনি— তা প্রমাণ হয়েছিল ২০১৪-র লোকসভা নির্বাচনের ফলাফলে। নরেন্দ্র মোদীকে প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী হিসেবে তুলে ধরে বিপুল গরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় এসেছিল বিজেপি। কিন্তু গুজরাটের তিন-তিনবারের মুখ্যমন্ত্রীকে প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী হিসেবে উঠে আসার পথটিতে দুস্তর বাধার সম্মুখীন হতে হয়েছিল। গুজরাটে নরেন্দ্র মোদীর প্রথম দফার শাসনকালে গোধরায় করসেবকদের পুড়িয়ে মারা এবং তৎপরবর্তীতে গুজরাট দাঙ্গার ঘটনা ঘটে। এই ঘটনায় দেশের সমস্ত বিরোধী রাজনৈতিক শক্তি, বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন, বিদেশি মদতপুষ্ট বিভিন্ন সংগঠন নরেন্দ্র মোদীকে আসামির কাঠগড়ায় তোলে। এমনকী বিজেপির অভ্যন্তরেও একটি অংশ মোদীর বিরোধিতায় সক্রিয় হয়ে ওঠে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মোদীর সে দেশে প্রবেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে। সিবিআই তদন্তের মুখোমুখিও হতে হয় মোদীকে। এই প্রতিকূল পরিস্থিতিতে মোদী কিন্তু বিচলিত হননি। বরং, গুজরাটের উন্নয়ন এবং বিকাশে তিনি মনোনিবেশ করেন। অচিরেই নিজেকে গুজরাটের বিকাশ পুরুষ হিসেবে তুলে ধরতে সমর্থ হন। দ্বিতীয় দফায় আরও বিপুল জনপ্রিয়তা নিয়ে গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী হয়ে মোদী প্রমাণ করেছিলেন, যাবতীয় সমালোচনার যোগ্য জবাব দিয়ে, জনমত নিজের দিকে সংগঠিত করার অত্যাশ্চর্য ক্ষমতাটি তার করায়ত্ত আছে। তা যে আছে, তার প্রমাণ তিনি ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনেও দিয়েছেন। তাঁর প্রধানমন্ত্রিত্বের প্রথম দফার পাঁচ বছরে বিরোধীরা একযোগে তার ওপর নানাবিধ অভিযোগ আরোপ করে গেছেন। রাহুল গান্ধী তো তাকে ‘চোর’ বলতেও দ্বিধা করেনি। দেশব্যাপী এমন একটা ধারণা সৃষ্টি করে দিয়েছিলেন বিরোধীরা—যেন নরেন্দ্র মোদীকে এবার বিদায় নিতেই হচ্ছে। তাদের সঙ্গে সঙ্গত করে গিয়েছিল জাতীয় এবং আঞ্চলিক সংবাদমাধ্যমগুলি। বিরোধীরাও এমন একটা খোয়াবে মগ্ন ছিলেন যে, এবার কেন্দ্রে জোট সরকার হচ্ছেই। এই পরিস্থিতিতে মোদীর অবিচল থাকাটা কারো দৃষ্টি এড়ায়নি। বিরোধীদের নিম্নশ্রেণীর অভিযোগের সুদৃঢ় উত্তর দেবার সঙ্গে সঙ্গে মোদী অবিচলিতভাবে একটি দাবি করেছিলেন এবারও আমরা ফিরছি। এবং আর ভালোভাবেই ফিরছি। ফল বেরনোর পর দেখা গিয়েছে, বিরোধীদের সব আশা হতাশায় পর্যবসিত হয়েছে এবং মোদীর দাবির যথার্থতা প্রমাণ হয়েছে। ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচন। প্রমাণ করেছে, নরেন্দ্র দামোদরদাস মোদী নামের ভদ্রলোক জানেন তার নামটি এখনো কেমন আবেগের সৃষ্টি করে জনমানসে। জনগণের মন বোঝার ব্যাপারে যে তিনি অদ্বিতীয় এক রাজনীতিবিদ— তাও প্রমাণ করেছেন নরেন্দ্র মোদী।
তাঁর রাজনৈতিক দূরদৃষ্টির আর একটি অকাট্য প্রমাণ তাৎক্ষণিক তিন তালাক নিষিদ্ধকরণ। নরেন্দ্র মোদী জানেন, কংগ্রেস-বামপন্থী বা সমাজবাদীদের মতো মুসলমান। তোষণের রাজনীতির পথটি তার বা বিজেপির নয়। আবার একথাও সত্য, ভারতের সংসদীয় রাজনীতিতে মুসলমান সমাজের এক অংশের। সমর্থনটিও ভীষণভাবেই জররি। তোষণের রাজনীতিতে পা না বাড়িয়েও সেই সমর্থনটি আদায় করা যায় তা নরেন্দ্র মোদী দেখিয়েছেন। তাৎক্ষণিক তিন তালাক নিষিদ্ধকরণের সিদ্ধান্ত নিয়ে মুসলমান সমাজের এক গরিষ্ঠ অংশের, বিশেষত মুসলমান মহিলাদের সমর্থন জিতে নিয়েছেন তিনি। স্বাধীনোত্তর ভারতে তোষণের রাজনীতির ঊর্ধ্বে উঠে এতবড়ো বৈপ্লবিক রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত আর কেউ নিতে পারেননি। এমনকী বাজপেয়ীর নেতৃত্বাধীন এনডিএ সরকারের পক্ষেও এরকম সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব হয়নি। পাশাপাশি নরেন্দ্র মোদী এটাও প্রমাণ করেছেন, প্রধানমন্ত্রী হিসেবে আবেগ বা হঠকারিতার রাজনীতিকে তিনি প্রশ্রয় দিতে রাজি নন।নন বলেই অতি উগ্র অপরিণামদর্শী কিছু তথাকথিত হিন্দুত্ববাদী সংগঠনের বিশৃঙ্খল কাজকর্মের রাশ ধরার কঠোর বার্তাও তিনি দিয়েছেন। কারণ, তিনি জানেন, এই ধরনের অপরিণামদর্শী কাজকর্ম আদতে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের পক্ষেই ক্ষতিকর হয়ে উঠতে পারে। কিন্তু এরই পাশাপাশি নরেন্দ্র মোদী এও প্রমাণ দিয়েছে সনাতন হিন্দুত্বের প্রতি তার শ্রদ্ধা অটুট। নরেন্দ্র মোদীই প্রথম ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী যিনি বাংলাদেশ গিয়ে ঢাকার সিদ্ধেশ্বরী মন্দির পরিদর্শন করেছেন। এতে বার্তাটি পরিষ্কার হয়েছে। নির্যাতিত হিন্দুদের পাশে যে তিনি রয়েছেন সেই বার্তাটি বুঝিয়ে দিতে পেরেছেন সহজেই।
নরেন্দ্র মোদী জানেন, সর্বোচ্চ যে শিখরটি তাঁকে ছুঁতে হবে, তাঁর নাম অটলবিহারী বাজপেয়ী। এও জানেন, এই শিখরটি ছোঁয়া এত সহজ কাজ নয়। শিখরটি ছোঁয়ার জন্য। ধাপে ধাপে শীর্ষে ওঠার পথটিও এবার বেছে নিয়েছেন মোদী। বলেছেন—“সবকা। সাথ, সবকা বিকাশ।
মোদী জানেন, দ্বিতীয় দফার এই প্রধানমন্ত্রিত্বে তাকে কোনো সংকীর্ণ গণ্ডির মধ্যে আবদ্ধ থাকলে চলবে না। তাকে শুধু বিজেপির প্রধানমন্ত্রী হলেও চলবে না। তাকে প্রমাণ করতে হবে, তিনি সব দল, সব মতের ঊর্ধ্বে ওঠা এক নিরপেক্ষ প্রধানমন্ত্রী। সেই জন্যই সব কা সাথ, সবকা বিকাশের নীতিতে তিনি এবার আগ্রহী। সেই সঙ্গে এও বুঝিয়ে দিয়েছেন, দলীয় রং বিচার না করেই রাজধর্ম পালনেও তিনি আগ্রহী। যে কারণেই তার দলের প্রতিপত্তিশালী কোনো নেতার পুত্র অন্যায় করে ফেললে তৎক্ষণাৎ তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতেও দ্বিধা করছেন না।
প্রথম দফার প্রধানমন্ত্রিত্ব কালেই বোঝা গিয়েছিল, নরেন্দ্র মোদী একজন ব্যতিক্রমী রাজনীতিবিদ। আর পাঁচজনের সঙ্গে ঠিক এক সারিতে বসানো যাবে না। তাৎক্ষণিক তিন তালাক রোধের মতো সাহসী সিদ্ধান্ত তিনিই নিতে পারেন। তিনিই নিতে পারেন নোটবন্দির মতো কঠোর সিদ্ধান্ত। নোটবন্দির সিদ্ধান্তের পিছনে অসম্ভব রাজনৈতিক ঝুঁকি আছে। জেনেও, পপুলিস্ট রাজনীতির পথে পা বাড়াননি নরেন্দ্র মোদী। ঝুঁকি নিয়েও এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন এবং প্রমাণ করেছেন, তার সিদ্ধান্তে কোনো ভুল ছিল না। পাকিস্তানি জঙ্গি হামলার পর দেশবাসীর আবেগকে মর্যাদা দিয়ে সার্জিকাল স্ট্রাইক করে তিনি বুঝিয়ে দিয়েছেন, শত্রুর মুখে দেশকে নেতৃত্ব দেওয়ার রাজনৈতিক যোগ্যতাও তার রয়েছে।
নরেন্দ্র দামোদরদাস মোদীর দ্বিতীয় ইনিংস সবেমাত্র শুরু হয়েছে। দ্বিতীয় ইনিংসের শুরুতে তিনি প্রমাণ করেছেন, তিনি আরও স্থিতধী। সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে ওঠা এক বিকাশ পুরুষ। এখন আরও কিছুটা পথ তাকে হাঁটতেই হবে শিখর স্পর্শ করার জন্য।
রন্তিদেব সেনগুপ্ত

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.