গান্ধী পরিবারের পারিবারিক নাটক ভারতীয় গণতন্ত্রের ক্ষতি করছে

না কংগ্রেস মারা যায়নি, দলটি কোমায় অবস্থান করছে। সেই অর্থে এটি হয়তো জীবিত নয় কিন্তু কবে যে সক্ষম পুনর্জীবন ফিরে পাবে সেটাও বুক ঠুকে বলা যাচ্ছে না। এমন কর্মকাণ্ড ঘটে চলেছে মহান রাহুল গান্ধীর কংগ্রেস সভাপতির পদ থেকে সরে দাঁড়ানোর প্রতিক্রিয়ায়। তার পদত্যাগপত্রের প্রথম অনুচ্ছেদে তিনি কিছুটা পরাজয়জনিত দায়িত্ব স্বীকার করে নিলেও পরের কিছু পঙক্তি থেকেই যথানিয়মে বাকিটা অন্যকে দোষারোপ করেই কাটিয়ে দিয়েছেন। এর ফলে তিনি কতটা দায়বদ্ধভাবে পদত্যাগ করেছেন সে সম্পর্কে সন্দেহ থেকেই যায়।
সত্যিই এই পদত্যাগপত্রকে যথাযোগ্য গুরুত্ব দিলে এতদিনে একজন উপযুক্ত সভাপতি নিযুক্ত করার প্রক্রিয়া নিশ্চয় শুরু হতো। মনে হচ্ছে পদত্যাগটি যেন আক্ষরিক অর্থে কোনো পদ থেকে ছুটি নেওয়া হয়েছে, ক্ষমতা থেকে নয়। এই কায়দাটা গান্ধী পরিবারের সবিশেষ রপ্ত আছে। তারা এর বিপুল প্রয়োগও করে দেখিয়েছে। এই কারবারে গান্ধীদের Congress Chief Exceutive Officer (CEO) অর্থাৎ প্রধান কার্যাধ্যক্ষের নামাঙ্কিত কোনো কার্ড লাগে না। দশ বছর ধরে অন্তরালে থেকে শিখণ্ডী মনমোহন সিংহকে টেকনিক্যাল প্রধানমন্ত্রী বানিয়ে তারা দিব্যি ইচ্ছে মতো দেশ চালিয়ে গেছে।
পদত্যাগের পর দীর্ঘ সময় কেটে গেলেও এখনও পর্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে বিকল্প কোনো নেতাকে কংগ্রেস সভাপতির পদে বিবেচনাই করা হচ্ছে না। এর থেকে একটা বিষয় পরিষ্কার যে, তারা মঞ্চের পাশ থেকে তীক্ষ্ণ নজর রাখছেন যে রাহুলবাবুর ছেড়ে যাওয়া পদে বসবার হিম্মত অন্য কোনো কংগ্রেস নেতা দেখাচ্ছেন কিনা। যদি কোনো বুদু সেই চেষ্টা করে। পরিবারের কালো তালিকায় তার নাম বরাবরের জন্য উঠে যাবে। কেননা সে পরিবারের পক্ষে সম্ভাব্য বিপজ্জনক ব্যক্তি। সে চিরকালের জন্য সাইড লাইনের বাইরে চলে যাবে। আমার একটা হাল্কা গল্প এই সূত্রে মনে পড়ে গেল। একজন অভিভাবক তার বাচ্চাদের বললেন যাও কিছু বলব না তোমরা এখন টিভি দেখতে পারো। তিনি বাড়ি থেকে একটু বেরোচ্ছিলেন। কিন্তু বাইরে বেরিয়ে জানলা দিয়ে নজর রাখছিলেন কে প্রথম টিভিটা চালায়, ভবিষ্যতে তাকে কড়া শান্তির মুখে পড়তে হবে।
এতদূর তো মজা হিসেবে ঠিকই আছে। যদি এর কুফল আমাদের দেশের ভবিষ্যতের ওপর না পড়ে। গান্ধী পরিবার কেবলমাত্র তাদের নিজেদের কথাই ভাবছে। শুধুমাত্র নিজেদের কথাই তাদের একমাত্র অ্যাজেন্ডা। তারা দেশের কথা দুরস্থান, কংগ্রেস দলের সম্পর্কেও বিন্দুমাত্র চিন্তিত নয়। তারা আশা করছে যে হাতে-পায়ে ধরে অনুকম্পা ভিক্ষে করে সভাপতিকে পদে ফিরিয়ে আনতে দল হামলে পড়বে। মনে হয় তারা এমনটাও ভাবছে রাজনীতির হাওয়ার গতিপথ বদল হবে। অনুকূল বাতাসে ভারতের মানুষ। তাদের মন বদল করে আবার তাদের অভ্যর্থনা করে ফিরিয়ে আনবে। ভাববার কারণ এমন বহু অতীত রেকর্ড আছে।
অবশ্যই, ভবিষ্যৎ কেউই আগাম বলতে পারে না। কিন্তু গান্ধী পরিবারের পুনরুত্থানের সম্ভাবনা প্রায় অসম্ভব বললেই হয়। কংগ্রেসের ভবিষ্যৎ নিশ্চয় আছে। সারা পৃথিবীতে বহাল থাকা বিভিন্ন দেশের গণতন্ত্রে ভিন্ন ভিন্ন আদর্শের দলের প্রয়োজন সকলে মেনে নিয়েছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে গান্ধী পরিবার কিন্তু প্রতি দিন দেশবাসীর কাছে জনপ্রিয়তা হারাচ্ছে। তবে, এই লেখার উদ্দেশ্য সেই কারণ খোঁজা নয়। গান্ধী পরিবার যে দীর্ঘদিন আগেই নতুন প্রজন্মের ও নতুন ভাবনায় চালিত ভারতের সঙ্গে তাদের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছে। একথা সুবিদিত। তাদের মধ্যে কোনো বিনয়, অনুশোচনা বা ভুল শুধরে নিজেদের সময়োপযোগী করার কোনো তাগিদই ছিল না। পরিবারটি মূলগতভাবে কোনো প্রতিভাকে সম্মান করার কথা ভাবতেও পারে না, কেবল কুক্ষিগত করার ভাবনায় তারা মশগুল। যে কারণে তাদের প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থীর সম্ভাব্য তালিকা ভারতীয় তরুণ ভোটদাতাদের কোনো উদ্দীপনা জোগায়নি। যা হবার হয়েছে। এরকম অনেক সময় হয়তো ঘটে নেতৃত্ব দেশবাসীর সঙ্গে যোগসূত্র হারিয়ে ফেলে। কিন্তু একটা প্রাচীন দল তার অস্তিত্ব, পরিচয় একটা পরিবারের তুলনায় তুচ্ছ এ কখনই হতে পারে না। কিন্তু এই দলের ক্ষেত্রে সেটিই সত্যি হয়েছে। পরিবারই দল। দলই পরিবার।
বলতে কোনো দ্বিধা নেই এই মিথ্যে পদত্যাগপত্র দিয়ে এই পরিবার লোক দেখানোর জন্য পদটি ছেড়েছে। ক্ষমতা মোটেই নয়। কংগ্রেস সভাপতি হওয়ার মতো যোগ্য, প্রতিভাবান, আত্মবিশ্বাসী, স্বনির্ভর কোনো নতুন নেতার সন্ধানে পরিবার আদৌ উৎসুক নয়। এর থেকে বোঝা যায় তারা দলটির সময়োপযোগী উত্তরণ চায় না। তারা এই বিপুল পরাজয়ে কোনো দায়বদ্ধতা অনুভব না করে, শুধু মৌন থেকে বাস্তবকে অস্বীকার করতে চাইছে। কংগ্রেস দলের ওপর এর নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া তো নিশ্চিত পড়ছে, কিন্তু তার চেয়ে অনেক বড়ো গ্লানিকর প্রভাব পড়ছে আমাদের দেশের এই বৃহৎ গণতান্ত্রিক ধাঁচার ওপর।
আগেই মূল প্রসঙ্গ তুলেছিলাম যে, কংগ্রেস দল কোমায় চলে গেছে তা একটু অন্য ভাবে ব্যাখ্যা করলে বোঝায় সর্বোচ্চ নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রে অর্থাৎ মস্তিষ্কে পক্ষাঘাত ঘটেছে। এর পরিণতিতে হাত পা বা দেহের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ শরীর থেকে ব্যবচ্ছেদ করলেও মস্তিষ্কের কিছুই করার থাকে না। যে কোনো প্রতিবাদ করতে পারে না। এর প্রমাণ হচ্ছে কর্ণাটক ও গোয়ার ঘটনা। কংগ্রেসের বিধায়করা ঝাঁকে ঝাঁকে পদত্যাগ, দলত্যাগ করছে। দলের বিপুল শক্তিক্ষয় ঘটছে কিন্তু দলের সর্বোচ্চ নিয়ন্ত্রণকেন্দ্র অসাড়। সেখানে ক্ষয় বন্ধের কোনো পরিকল্পনাই নেই। আগেই বলেছি দলের সর্বোচ্চ পদের জন্য কেউই আবেদন করবে না। কোনো কানাঘুসো শোনা গেলেও চামচারা পরিবারকে রিপোর্ট করবে। হবু আবেদনকারী পরিবারের রোষে পড়ার ভয়ে গুটিয়ে যাবে। সর্বোচ্চ পদে দক্ষ নিয়ামক না থাকলে কংগ্রেস দলের নিয়ন্ত্রণহীন মস্তিষ্কের সুযোগে একটি একটি করে অঙ্গহানি ঘটবে।
দলের মধ্যে বিশ্বাসযোগ্য ও দায়িত্ববান যে কতিপয় রয়ে গেছেন তার মধ্যে পঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী ক্যাপ্টেন অমরিন্দর সিংহ একজন। তরুণ নতুন কংগ্রেস সভাপতি ঠিক করার কথা বলেছেন। আমি একটি ব্যক্তিগত ইনফরমাল টুইটার পোল করেছিলাম। ৪৩ হাজারের মতো সাড়া দেওয়াদের মধ্যে ৮৬ শতাংশ সচীন পাইলটদের মতো তরুণ কার হাতে ক্ষমতা তুলে দেওয়ার পক্ষপাতী। তারা বেশি অভিজ্ঞ কিন্তু ক্যারিশমা নেই এমন লোককে চাইছেন না। কিন্তু কাজের কাজ এখনও কিছুই হয়নি। আমি নিশ্চিত, এই অনির্দিষ্টকালের শূন্যতাকে মাথায় রেখে বিজেপি দলের অত্যন্ত গোঁড়া সমর্থকও আমার সঙ্গে একমত হবেন যে একটি যথার্থ চলমান শক্তিশালী গণতন্ত্রের পক্ষে শক্তিধর বিরোধী দল থাকা বিশেষ প্রয়োজন। অত্যন্ত হতাশা ব্যঞ্জকভাবে দেখা যায় কংগ্রেস প্রায়শই বিজেপিকে গণতন্ত্রকে দাবিয়ে রাখার দায়ে অভিযুক্ত করে কিন্তু এ বিষয়ে তাদের যে দায়িত্ব রয়ে গেছে সেকথা তাদের মনে পড়ে না।
আমরা আমাদের দেশকে ভালোবাসি। আমাদের দেশ সর্ব বিষয়ে ত্রুটিমুক্ত না হতে পারে কিন্তু আমরা আমাদের স্বাধীনতা ও প্রবহমান গণতান্ত্রিকতাকেও ভালোবাসি। এই গণতান্ত্রিকতা যখন কোনো একটি পরিবারের এক ধরনের নাটক, কুৎসিত মৌনতা বা বদখেয়ালের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তখন তা আমাদের কষ্ট দেয়। রাজনীতিতে বিরোধী দলের কর্তব্য পালনটা আবশ্যিক। কংগ্রেসের মধ্যে থেকে কোনো প্রতিভাবান মানুষ এসে দায়ভার নিন। অচলাবস্থা কাটান।
শুধুমাত্র একটি পদ থেকে সরে গেলে হবে না কঠোর বাস্তবকে মেনে নিয়ে সামগ্রিক রাজনৈতিক পরিসরই যোগ্যতরকে ছাড়তে হবে। দেশ বড়ো পরিবর্তনের মুখোমুখি।
চেতন ভগত

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.