মাঠের উপরে নেমে আসা কুয়াশাদের দেখেছ? ঐ যখন গোধূলি চলে যাওয়ার পরে যে সাঁঝবেলা থাকে, সেই সময়ে দেখবে ক্লান্ত কুয়াশারা মাঠের উপরে নেমে আসে গুটিগুটি পায়ে। পায়ে পায়ে তারা নামিয়ে আনে ঝুমসি অন্ধকার। ঠিক যেন সারাদিনের পরে মাঠের আলে, ধানের ক্ষেতের মাঝে, শিরীষ গাছের নীচে এসে বসে একটু বিশ্রাম নিতে। আমিও ওরকম কুয়াশার মতোই। সারাদিন কখনও চায়ের দোকানের কাপ, পুকুর পাড়ের জামরুল গাছ, বুড়ো শিবতলায় ভেঙে পড়া মন্দিরের গায়ে গজিয়ে ওঠা অশ্বত্থের চারা এসব পেরিয়ে এসে তখন একটু বিশ্রামের আশায় গা এলিয়ে দিই এই তালগাছগুলোর নিচে। কুয়াশার চাদর আস্তে আস্তে ঢেকে ফেলে আমাকে। আকাশে চাঁদ ওঠে। কোনদিন গোল থালার মতো, আবার কোনদিন হয়ত এক ফালি। যেমনই হোক আমার তখন তোমার কথা মনে হয়। মনে হয় আবার কি কোন একদিন…
এক বছর আগে যখন তুমি আমাকে ছেড়ে গেছিলে, সেদিনটা পুজোর দশমী ছিল। গালে লাগানো সিঁদুরখেলার সিঁদুর আর সাঁঝের আলোয় তোমাকে অদ্ভুত মায়াবী দেখাচ্ছিল। আমাকে ছেড়ে যখন চলে যাচ্ছিলে কাশবনের পাশ দিয়ে মনে হচ্ছিল তুমিও ঘরে ফিরে যাচ্ছ। এবার বিশ্রাম নেবে। সত্যিই তো। আমার মতো গেয়ো বাউণ্ডুলে, যে কিনা সারাদিন বৌদিদের গঞ্জনা আর মায়ের চোখের জল দেখেও চাকরির দশ লাখ টাকাটা জোগাড় করে উঠতে পারেনি, তার সাথে কি তোমায় মানায়? মানায়না। তাই সেদিন যখন তুমি আমাকে বলেছিলে, “বাবা বিয়ের ঠিক করে ফেলেছে। ছেলে স্কুলের মাস্টার।তুমি কালী পুজোর মধ্যে কিছু করতে না পারলে আর আমার পক্ষে অপেক্ষা করা সম্ভব নয়”, সেদিন আমার এতোটুকুও খারাপ লাগেনি। সেদিনও খুব ক্লান্ত, শ্রান্ত আমি বুড়ো শিবতলার দিকে এগিয়ে যেতে যেতে ভেবেছিলাম, আসলে তো তুমিও ঐ কুয়াশার মতোই। যাকে কখনও নিজের করে নেওয়া যায়না। খালি দূর থেকে দেখা যায়। কাছে গেলেই হারিয়ে যায়। তোমার থেকে যতো দূরে থাকা যায় ততোই তোমার সৌন্দর্য অনুভব করা যায়। সেই সৌন্দর্য্য দেখে মনটা বিষন্ন হয়ে যায়, কিন্তু একটা মনকেমন করা ভালোলাগাও হয়। ঠিক যেমন মাঠের উপরে নেমে কুয়াশাদের দেখে মনে হয়।
আজ যখন তুমি একটিবার খালি আমার সাথে দেখা করতে চাইলে, আমি ঠিক করেছিলাম তোমার কাছে যাব। জিজ্ঞেস করব কেমন আছো। কিন্তু কিন্তু যতোই তোমার কাছাকাছি হতে থাকলাম ততই আমার মধ্যে বাড়তে থাকল ক্লান্তি। আমি যেন ঠিক জলার পুকুর ধারে নুয়ে পড়া নারকেল গাছটার মতো। যার বয়স হয়েছে, এখন আর ফলও দেয়না। বয়সের ভারে নুয়ে পরেছে, কিন্তু কে জানে কোন অকারন মমতায় এখনও তাকে কেউ কেটে ফেলেনি। ভাবোনা আজও আমি চাকরি পাওয়ার টাকাটা যোগাড় করে উঠতে পারিনি। টাকার অঙ্কও এখন বাড়তে বাড়তে অনেক।
বৌদিদের গঞ্জনাও এখন অনেক বেড়েছে। মাও আর নেই চোখের জল ফেলার জন্য। কিন্তু তাও আমি এখনও একটু একটু করে বেঁচে আছি করবী গাছের লতায়, তাল গাছের ফাঁক দিয়ে ডুবে যাওয়া সূর্যে, খাল পাড়ে দূর থেকে ভেসে আসা মাদলের আওয়াজে। যেমন আমার একটুখানি এখনও বেঁচে আছে তোমার স্মৃতিতে। তাই তো তুমি আমাকে দেখা করতে বলেছিলে আমার একটা চাকরির ব্যবস্থা করেছ সেই খবরটা দেবে বলে। কিন্তু সত্যি বিশ্বাস করো, আমি পারলামনা তোমার কাছে যেতে। ঠিক যেমন যতো মাঠের মধ্যে হাঁটা যায়, ততোই কুয়াশার চাদর দূরে সরে যায়। আমিও তেমনই যতো তোমার কাছে পৌছাতে চাইলাম তুমি ততোই দূরে সরে গেলে। তোমার মাথার লাল টিপ, পরণের নীল শাড়ি তোমাকে কেমন যেন কুয়াশায় ঘেরা অনেক দূরের শিউলি গাছের মতো রূপদান করছিল। মনে হোল বিকেলের সাঝবেলায় ওখানে যাওয়া যায়না। ওখানে যেতে গেলে ভোরের অল্প ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা হাওয়া মেখে যেতে হয়।
কাল অষ্টমী। এবারে আর অঞ্জলি দেওয়া হবেনা আমার। বেকার বাউন্ডুলেদের অঞ্জলী দেওয়া উচিত নয়। কারন তাদের কাছে অনেক প্রশ্নের উত্তর থাকেনা। দুর্গাতলায় তোমাকে তোমার স্বামীর সাথে দেখে আমার দিকে তাকিয়ে মুখ টেপা হাঁসিগুলোর আমার কাছে কোন উত্তর থাকবেনা। কিংবা ভট্টাচার্য্যি কাকুর ছেলে বা জামাই কতো বড়ো চাকরি পেয়েছে সেকথা শোনার পর যখন কাকু আমাকে জিজ্ঞেস করবে আমি কম্পিউটারের কোর্স করেছি কিনা বা প্রাইভেট কোচিং সেন্টার কেন খুলছিনা, আমার কাছে সেসব প্রশ্নের কোন জবাব থাকবেনা। তাই আমার অঞ্জলি দিতে নেই। তাই ওখানেও তোমার সাথে আমার দেখা হবেনা।
আমি বরং বাড়ির জানলায় বসে রাস্তার দিকে তাকিয়ে থাকব। তুমি যখন লাল পাড় সাদা গরদের শাড়ি পরে খুব খুশি খুশি মুখ নিয়ে ফিরবে অঞ্জলী দিয়ে, তখন তোমাকে দেখে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলব আর একবার তাকে রাখা চাকরির পরীক্ষার বইগুলোর ধুলো ঝেড়ে রাখব।
তবে এবারেই শেষ তমালিকা। গাছ, কুয়াশা, বুড়ো শিবতলা নিয়ে কাব্য করা যায়, কিন্তু জীবন কাটানো যায়না। সেই সেদিন যখন তুমি কাশবনের পাশ দিয়ে চলে যাচ্ছিলে আমার যে আমি সেও চলে গেছিল তোমার পাশে পাশে হেঁটে। ডুব দিয়েছিল খালের জলে। তারপরে ভাসতে ভাসতে খাল পেড়িয়ে, নদী পেড়িয়ে সাগরে গিয়ে পরে ঢেউয়ের মাঝে পরে ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গিয়ে ছড়িয়ে গেছে শত কণায়, ঢেউয়ের উপরে আলগোছে ভেসে থাকা ফেনার মতোই। তাই জীবন পাল্টাব এবার। পরের পুজোয় হয়ত তোমার মতো আমিও ভালো থাকব।
কাব্য কবিতা অনেক হোল। এবার ঠিক করেছি সিন্ডিকেটের দলে নাম লেখাব। বেশ মজা হবে তাহলে। হাতে মোটা সোনার ব্রেসলেট পড়ব, গলায় ঝোলাব মোটা একটা চেন। একেবারে ২৪ ক্যারাট গোল্ডের। তোমার বাবা, যিনি কিনা আমাকে মানুষ বলেই ভাবেননা। তাকে দশ হাজার এক টাকার চাঁদার বিল কেটে দিয়ে আসব। মেসোমশাই আমার কাছে এসে কাকুতি মিনতি করে বলবেন, “বাবা আমি রিটায়ার্ড মানুষ, একটু বিবেচনা করো”। আমি তখন তোমার বাবার মুখের উপরে এক মুখ সিগারেটের ধোঁয়া ছেড়ে চিবিয়ে চিবিয়ে বলব, “বচ্ছরকার দিনে পাড়ার লোকে একটু আনন্দ করবে তাতেও এরকম হাত টান করলে চলবে কি করে মেসোমশাই। আপনার জামাই তো ইলশড়ার স্কুলে পড়ায়। স্কুল মাস্টারের তো অনেক মাইনে। মেয়েকেও তো প্রাইমারীর চাকরিটা পাইয়ে দিয়েছেন, পুকুর পাড়ের জমিটা বেচে। তাই এটুকু আপনার কাছে কোন ব্যাপারই নয়”। তোমার বাবার কাঁচুমাচু মুখটা কেমন দেখতে লাগবে বলো তখন। ভেবেই কেমন হাসি পাচ্ছে আমার।
পুজো এসে গেল তমালিকা। ভালো থেকো। পরের পুজোতে হয়ত আমিও ভালো থাকব। তখন হয়ত সদ্য সিঁদুর খেলা কোন মেয়ে আমার দিকেও আড়চোখের ইশারা নিয়ে তাকাবে। আর তুমি তাই দেখে ভাববে মেয়েটার নাকটা তোমার মতো টিকালো নয়। কপাল চওড়া। চুলের গোছ নেই। আমি কিন্তু ওসব দেখবনা। আমার চোখে তখন লোভ থাকবে। প্রশ্রয় থাকবে। আর সেই সাথে হিসাব করব মেয়েটাকে নতুন একটা স্যামসাং-এর মোবাইল কিনে দিলে মেয়েটা কি আমার সাথে শক্তিগড়ের হোটেলে যাবে নাকি একদিন ভালো রেস্টুরেন্টে নিয়ে গেলেই কাজ হয়ে যাবে। আমি তখন আর কুয়াশা থাকবনা তমালিকা। আমি তখন হটাত বৃষ্টির পরের ওঠা ঠা ঠা রোদের মতো হয়ে যাব। রোদের যেমন কোন কষ্ট থাকেনা, ক্লান্তি থাকেনা। আমারও তেমনই কোন কষ্ট, ক্লান্তি থাকবেনা।
ভালো থেকো, আমিও ভালো থাকব।হ্যাপী পুজো তমা।
বিদ্র – এদেরও তো পুজো থাকেনা। যেমন আরও অনেকের থাকেনা। কিন্তু এদের কথা তো কেউ বলেনা। তাই মনে হোল একটু এদের কথাই নাহয় বলি আজ।
দীপ্তশ্য জশ