২০২১ সালে পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচনের আগে, এই বক্তব্য নিয়ে একটি ভিডিও উপস্থাপনা হয়েছিল। এর লক্ষ্য ছিল পূর্ববঙ্গের হিন্দুদের বহু প্রতীক্ষিত ” নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল”। বিগত নির্বাচনে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক শক্তি, সংসদীয় গনতান্ত্রিক বামপন্থী, অতিবামপন্থী, তথাকথিত প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবিদের এক বাস্তুতন্ত্র কাজ করেছিল। অতিবিপ্লবী শক্তি কোথা থেকে বহু বহু টাকা জোগাড় করে #NoVoteToBJP করলেন সে নিয়ে আমার প্রশ্ন নেই। বামদলগুলি কেন তাদের বহু দশকের তৈরী ভোটব্যাঙ্ক শাসক দলকে দিলেন, সেটাও তাদের দলগত বিষয়।
নির্বাচনের ফল প্রকাশের পরে সারা পশ্চিমবঙ্গ জুড়ে রাজনৈতিক প্রতিশোধের নামে নারকীয় সন্ত্রাস চলেছে। নামে রাজনৈতিক হলেও সন্ত্রাসে মূল শিকার ছিলেন হতভাগ্য হিন্দুরা। ২রা মে থেকে আজ পর্যন্ত ৫৫ জন মানুষের প্রান গেছে। বহু গ্রামে মা বোনেরা গনধর্ষিতা হয়েছেন। হিন্দুর সম্পত্তি লুঠ হয়েছে নির্বিচারে। রাজ্যের পুলিশ প্রশাসনের ভুমিকায় ক্রুদ্ধ মহামান্য আদালত রায় দিয়েছে। কিন্তু শাসকদলের ভুমিকা নিয়েও এই লেখার অবতারণা নয়।
আমি প্রশ্ন করতে চাই সেই সব শিল্পী, সাহিত্যিক, অভিনেতা, চিত্র পরিচালককে যাঁরা বহু অর্থ ব্যয়ে ওই সিনেমাটোগ্রাফি করেছিলেন, আমরা অন্য কোথাও যাবো না।
২০০১ সালের পর থেকে কিছুদিন বাংলাদেশে হিন্দুদের বিরূদ্ধে জেহাদি তান্ডব কিছু কম ছিল। এই বছর পশ্চিমবঙ্গে ভোট পরবর্তী সময়ে একতরফা লাগাতার হিন্দু নির্যাতন ওপার বাংলায় মৌলবাদীদের নতুন করে উৎসাহিত করেছে। ওপার বাংলায় সংকেত গেছে যে হিন্দুরা এপারেও হেরে গেছে, পদদলিত হয়েছে। আর এই হেরে যাওয়া হিন্দু বাঙ্গালিকে অত্যাচার করার আদর্শ সময় হল দেবীপক্ষ।
কুমিল্লার নানুয়া দীঘিরপাড় গ্রামে দুর্গা মন্ডপে হনুমানজীর পায়ের কোরান রেখে, সেই ছবি ছড়িয়ে দেওয়া হয়। অভিযোগের তীর শাসক দলেরই এক নেতার বিরূদ্ধে। তিনিই মৌলবাদের উস্কেছেন। তার উস্কানিতেই ওই মন্ডব আক্রমণ করা হয় এবং দেবী প্রতিমা ভেঙে ফেলে অষ্টমীর দিনই দুর্গা বিসর্জন দিয়ে দেয়। এই কোরান শরিফ রাখা বা অন্য মিথ্যে রটনা করে হিন্দু মারার পদ্ধতি এক পুরাতন চালাকি।
১৯৬৩ সালের ডিসেম্বরের শেষে কাশ্মীরের হজরত বাল দরগায় পবিত্র কেশরাজি চুরি যাওয়ার গুজব ছড়িয়ে খুলনা সহ পূর্ববঙ্গের সর্বত্র হিন্দু নিধন করা হয়েছিল। সেবার ঢাকা বিমান বন্দর থেকে ইসলামাবাদে ফেরার পথে গুজব ছড়িয়েছিলেন স্বয়ং প্রেসিডেন্ট আয়ূব খান। যদিও কিছুদিন পরেই “হজরত বাল” যথাস্থানে রেখে দেওয়া হয়েছিল। এবার এই চক্রান্তের রেশ এপার বাংলাতেও এসে গেছে। গত বিধানসভা নির্বাচনে বাম-কংগ্রেস জোটের শরিক ছিল এক মৌলবাদী দল। বাংলাদেশের দুর্গা মন্ডপের ঘটনার পরে সেই দলের প্রধান, “বাঁদরের পায়ে পবিত্র গ্রন্থ” রাখার কথা বলে পুরাতন খেলা শুরু করে দিয়েছেন।
আজকের তথ্যপ্রযুক্তির যুগে খবর চেপে রাখা খুব কঠিন। তাই তথাকথিত বড় মাপের শিল্পী, সাহিত্যিক, অভিনেতা যারা ভোটের আগে “সি এ এ”-র বিরোধিতা করে, ‘আমরা অন্য কোথাও যাব না’ বানিয়েছিলেন, তাঁদের নেটিজেনরা প্রশ্ন করছেন, “এখন আপনারা চুপ করে আছেন কেন?”, ” পূর্ববাংলার হিন্দুদের নাগরিকত্ব দেওয়ার বিরোধিতা করলেন কেন?”, “কেন মানুষকে মিথ্যে কথা বলে বিভ্রান্ত করলেন?”
বুদ্ধিমান বুদ্ধিজীবীরা এখন চুপ করে আছেন। তবে সবার গায়ের চামড়া তো সমান পুরু হয়না। আর বয়স কম হবে বৈষয়িক লাভের থেকে ইমেজ সচেতনতাও বেশী কার্যকর হয়।
তাই ওই দলের একজন অভিনেতা মুখ খুলেছেন। বলেছেন, বাংলাদেশের দু একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনাকে বড় করে দেখানো হচ্ছে, আসলে সারা বাংলাদেশে শান্তিপূর্ণভাবেই দুর্গাপূজা পালিত হচ্ছে। এই কথাটি সম্পূর্ণ অসত্য।
এখনো পর্যন্ত প্রাপ্ত খবর অনুসারে ৫ জন নিরপরাধ হিন্দু দুর্গাপূজা করার অপরাধে খুন হয়েছেন। চাঁদপুর হাজীগঞ্জে খুন হয়েছেন মানিক সাহা। নোয়াখালী জেলায় দুর্গামন্ডপেই খুন হয়েছেন যতন সাহা।
নোয়াখালি ইস্কন মন্দিরের প্রধান পুরোহিত সাধু নিমাই কৃষ্ণ ও প্রান্ত দাস নামে আরো একজন সন্যাসীকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে।বাংলাদেশের ২৫ টি জেলায় শতাধিক দুর্গাপূজার মন্ডপ ভেঙে দেওয়া হয়েছে। তিন শতাধিক মন্দির গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।
শুরুটা হয়েছিল কুমিল্লা জেলার নানুয়া দীঘিরপাড় গ্রামের পরিকল্পিত গুজবের মধ্য দিয়ে। তারপর কুমিল্লা সদরের কালীবাড়িতে হামলা হয়।
এরপরেই সুদূর .চট্টগ্রামের বাঁশখালীতে ১৫ টি পূজা মণ্ডপের উপর হামলা করা হয়। চট্টগ্রামের কক্সবাজারের চকরিয়া ও পেকুয়ায় ৪ টি ইউনিয়নে (গ্রাম পঞ্চায়েতে) ২০০টির বেশী হিন্দু পরিবারের উপর হামলা করা হয়েছে।চট্টগ্রামের যাত্রা মোহন হল মণ্ডপে হামলা হয়েছে। সংলগ্ন জেলা বান্দরবানের লামা হরি মন্দির হামলা , ভাঙচুর করে সব কিছু লুঠ করে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। গাজীপুরেও পূজা মণ্ডপে হামলা চলেছে।
সিলেটের জকিগঞ্জে পূজামণ্ডপে হামলা চলেছে ১৩ তারিখ রাতেই। ১৪ তারিখে সিলেটের কাছে মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জে দুটি মণ্ডপের মূর্তি ও প্যান্ডেল ধূলিসাৎ করা হয়। সেখানে পাঁচটি মণ্ডপের গেট ভাঙে দেওয়া হয়েছে।
ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের কাছে কুলাউড়াতে দুর্গামণ্ডপে ভয়ানক হামলা হয়েছে। অন্যদিকে লক্ষ্মীপুরের রামগতিতে পূজা মণ্ডপে হামলা চলেছে দুইদিন ধরে। কুড়িগ্রামের উলিপুরের তিনটি ইউনিয়নের সাতটি মন্দিরে ভাঙচুর করে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে। চাঁদপুর রামকৃষ্ণ মিশন আক্রান্ত হয়েছে। চাঁদপুরের হাজীগঞ্জে পূজামণ্ডপে মন্ডপে হামলা এখনও চলছে। নোয়াখালীতে চৌমুহুনীতে রামঠাকুরের আশ্রম দেশভাগের পরে এই প্রথমবার আক্রান্ত হয়েছে। চকবাজার থানার অধীন করুনাময়ী কালীমন্দিরে লুঠপাট করে ভাঙচুর করা হয়েছে।
সমগ্র বাংলাদেশ জ্বলছে। নোয়াখালীতে : ত্রিশূল , মঙ্গলা , নবদূর্গা , বিজয়া প্যান্ডেল, কোটবাড়ি মন্দির সম্পূর্ণ আগুনে জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে। বারগ্রাম, ছয়ানীবাজার ,বেগমগঞ্জ, সোনাইমুড়ীতে হিন্দুদের বাড়ি বাড়ি ঢুকে শ্লীলতাহানি, লুঠতরাজ করা হয়েছে। গ্রামের পর গ্রামে অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে ।
পূর্ব বাংলা থেকে লক্ষ লক্ষ হিন্দু এদেশে দুটাকা কেজি চাল খাওয়ার জন্য আসেন না, এই সহজ কথাটি বুঝতে পারেন না ওই হৃদয়হীন সেলিব্রিটির দল। যাঁরা সি এ এর বিরোধিতা করে ‘অন্য কোথাও যাবো না’ নাটক মঞ্চস্থ করেছিলেন সেই সব কিছুর উওর আজ তাঁদের দিতে হবে। এই দেবীপক্ষই বাঙালি হিন্দুর জীবনের সবথেকে আনন্দঘন সময়। তাই জেহাদিরা এই সময়টিকেই আক্রমণের আদর্শ সময় হিসেবে বেছে নিয়েছে। আজ থেকে ঠিক ৭৫ বছর আগে এমনই দেবীপক্ষের শেষ দিনে, কোজাগরী পূর্ণিমার দিনে জেহাদি গোলাম সারওয়ার নেতৃত্বে নোয়াখালীর দাঙ্গা শুরু হয়েছিল। শতশত মানুষের হত্যা, অগনিত নারী ধর্ষনের খবর পেয়ে মহাত্মা গান্ধী সেখানে ছুটে গিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি খালি হাতে ফিরে এসেছিলেন। আজ রক্তাক্ত ইস্কন মন্দির ৭৫ বছরে পুরাতন ক্ষতচিহ্ন স্মরণ করিয়ে দিল।
বাংলাদেশের পাশবিক অত্যাচারের প্রতিবাদ এপার বাংলার তথাকথিত বুদ্ধিজীবীরা করেন না। সেই পাপের প্রায়শ্চিত্ত হয়ত অদূর ভবিষ্যতেই তাঁদের নিজেদের করে যেতে হবে। আকাশে সেই অশনি সঙ্কেতের চিহ্ন স্পষ্ট হয়ে উঠছে।
আর আমরা সাধারণ মানুষ, যারা কলকাতার জুতো প্যান্ডেলে ঢাকের তালে কোমর দোলাচ্ছি, বাংলাদেশ যখন পুড়ছে তখন দেবীপক্ষে নেচে নেচে প্যান্ডেল হপিং করছি, আর ওই সব শিল্পী, অভিনেতার কথায় “কা, কা, ছি, ছি ” করছি, আমাদের অবস্থাটা ছাগলের তৃতীয় ছানার মতো। নাচতে নাচতে একদিন পিছনে ফিরে দেখবো, আমার ভাই বোন কেউ নেই। আমি যখন নাচছিলাম তখন সবাইকে জবাই করা হয়ে গেছে। এবার আমার পালা।
জিষ্ণু বসু