“অদ্ভুত আঁধার চারদিকে। বাংলাদেশে একের পর এক মণ্ডপে, মন্দিরে, হিন্দুবাড়িতে হামলা হচ্ছে, আর এপারে সব্বাই প্যান্ডেল হপিংয়ের ছবি দিচ্ছে, অষ্টমী, নবমী “সর্টেড” স্ট্যাটাস দিচ্ছে। আনন্দ করছে, তাতে আপত্তি নেই। আনন্দের দিন, আনন্দ তো করবেই। কিন্তু মানুষের কী নিজের শিকড়ের প্রতি সামান্যতম মায়া-মমতাও থাকে না?
না, শিকড় মানে দশহাতের মূর্তি বানিয়ে তার পাশে তাঁর চার কল্পিত ছেলেমেয়েকে দাঁড় করিয়ে দেওয়া নয়। আদতে তো দুর্গাপুজা, মহিষমর্দিনীর পুজো, শষ্যের দেবীর পুজো। কলাবউ, যার আসল নাম নবপত্রিকা, তাতে থাকে নয় রকম ওষধিযুক্ত গাছের অংশ। বোধন হয় কলাবউকে স্নান করিয়ে, শষ্যের দেবীকে আবাহন করে। পশ্চিম এবং দক্ষিণ ভারতের বেশ কিছু অংশ এখনো নবরাত্রিতে নতুন চুপড়িতে নয়রকম শষ্য রোপন করে, তাতে জলসিঞ্চন করে এই নয়দিন। এই শষ্যের দেবীর আরাধনা তো আর ব্রাহ্মণ্য যুগের নয়। এ তারও আগের কথা। যবে থেকে গোষ্ঠীতে কার্য ভাগাভাগি হল, আর মেয়েদের ভাগে পড়ল শষ্য উৎপাদন আর ছেলেদের ভাগে শিকার, এ সেই সময়ের কথা! মাতৃকা হলেন শষ্যের দেবী! তিনি পূজিত হতে শুরু হয়েছেন সেই প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে। এ সেই সময়ের কথা, যখন গোষ্ঠীর প্রধান হতেন মা। প্রজননের মূল্য ছিল অপরিসীম, কারণ সন্তান জন্মের মাধ্যমেই গোষ্ঠীর সংখ্যা বৃদ্ধি পায় আর কে না জানে, মাতৃগর্ভ থেকেই তার শুরু। এ সেই সময়ের মাতৃকাপূজার, প্রজননের দেবীর পূজার অবশেষ!
মানুষ মাতৃকা-উপাসক সেই কাল থেকে। হিন্দুর মাতৃকাপূজা সেই পূজার অবশেষ মাত্র।
মাটির প্রতিমার সামনে মন্ত্র পড়লে যে দেবী নেমে এসে বর-ফর দেন না, এ এমনকি বৈদিক যুগের সামগান বাঁধা ঋষিরাও জানতেন। তাই তাঁরাও দেবতার উপাসনার ছলে প্রকৃতিরই উপাসনা করেছেন।
“যো দেবোহগ্নৌ যোহপ্সু
যো বিশ্বং ভুবনমাবিবেশ।
যা ওষধীষু যো বনস্পতিষু
তস্মৈ দেবায় নমো নমঃ॥”
চেনাপরিচিত অনুবাদটাই থাক।
“যিনি অগ্নিতে যিনি জলে,
যিনি সকল ভুবনতলে,
যিনি বৃক্ষে যিনি শস্যে,
তাঁহারে নমস্কার —
তাঁরে নমি নমি বার বার।”
কাজেই প্রতিমার এই রূপ তো অতি অর্বাচীন। খ্রীষ্টিয় প্রথম বা দ্বিতীয় শতাব্দীতে সম্ভবত মহিষাসুরমর্দিনী রূপের যথাযথ দেখা মেলে প্রথম। তার আগের মহিষমর্দিনীকে দেখে আজকের রূপের সাথে মেলানো শক্ত। কিন্তু এই পুজা আদতে দশ-হাতি দুর্গার নয়, তাঁর ছেলেমেয়ে সহ বাপের বাড়ি আসা উপলক্ষেও নয়, ও তো বাঙালির স্বকপোলকল্পিত স্নেহের প্রকাশ মাত্র। এ আদতে সেই আদিমাতৃকার উপাসনা। এ সেই নারীর উপাসনা, যিনি প্রথম শষ্যবীজ রোপন করেছিলেন বেখেয়ালে, আর বর্ষার চাতুর্মাস্যে গোষ্ঠীর খাদ্যের অভাব বুঝতে দেন নি। তাই এই শক্তিই অন্নপূর্ণা। ইনিই কামাক্ষী, সন্তানদাত্রী। ইনি শক্তিরূপা, শান্তিরূপা, ভীতিরূপা, কন্যারূপা, মাতৃরূপা। ইনিই সর্বস্ব। এনাকে ভিন্ন জগত নাই। কারণ ইনিই প্রাণের আধার, মনুষ্যজগৎ সৃষ্টির কারণ।
অর্বাচীন ধর্মের খড়গে আঘাত করে যদি এনাকে পরাজিত করা যেত, তবে তা বহু আগেই ঘটত। ধর্মের আঘাত তো কম আসে নি এই ভূখণ্ডে! কিন্তু তা হওয়ার নয়। আদিমতম নারীশক্তির শাশ্বত প্রকাশ, বিমূর্ত রূপ হলেন মাতৃকা। জগতে আদি মাতৃকা-উপাসক জাত সম্ভবত এক-আধটিই টিকে আছে এবং তাঁদের উপাস্যের মধ্যে ইনি সর্ববৃহৎ এবং অন্যতমা।
এই জমিতে ধর্মের শতকরা ভাগ দেখায়েন না। এই উপাসনা সেই সময়ের অবশেষ, যখন আমার আপনার ধর্ম থাকা তো দূর, মনুষ্যজাতি সবেমাত্র পোষাক পরতে বা কথা বলতে শিখছে। কাজেই যতই মূর্তি ভাঙুক, যতই আগুন জ্বলুক, যতই ঘর পুড়ুক, এ উপাসনাকে এই ভূমি থেকে উৎখাত করে, এমন শক্তি এখনো জন্মায় নি। মূর্তি ভাঙলে জীবিত কন্যারূপে দেবীর পুজো হবে। কন্যা অবশিষ্ট না থাকলে মানস-পূজা হবে, ঘটস্থাপনা করে। কারণ, পূজা তো মূর্তির নয়। পূজা তো সেই শক্তির, যিনি সর্বভূতে শক্তিরূপে বিরাজমান। শুনে রাখুন, সর্বভূতে। শক্তিরূপে। বিরাজিতা। আমাতে। আপনার গৃহের সাহসী কন্যাটিতে। জগতের সমস্ত নারীতে। যিনিই শক্তিরূপা, তাঁতেই তাঁর অধিষ্ঠান।
“যা দেবী সর্বভূতেষু শক্তিরূপেণ সংস্থিতা।
নমস্তসৈ নমস্তসৈ নমস্তসৈ নমো নমঃ।।”
তাঁকে প্রণাম। মাতৃকাকে প্রণাম। জগতের সকল শক্তিমতীকে প্রণাম। প্রকৃতি-মাতাকে প্রণাম।
ভাঙুন এবার। যত খুশি মূর্তি ভাঙুন। মূর্তি ভাঙলে মাতৃকা-উপাসনা বন্ধ হয় না, এ আপনি জানেন না। কারণ আপনি মূর্খ, অর্বাচীন। যুগসৃষ্টির সেই আদিকালের যারা প্রকৃত উত্তরপুরুষ, তারা জানে। তারা জানে মাতৃকা সর্বভূতে বিরাজমানা, তাই অগ্নি, জল, বায়ু বা মরমানুষের সামান্য অস্ত্র, কারোর সাধ্য নেই তাঁকে ধ্বংস করে। তিনি অজর, অমর, অক্ষয়।
অলমিতি।”
দেবশ্রী মিত্র লিখেছেন-