সেদিনের সেই কারিগরকে দেখলাম আজ কালীঘাটের হরিশ চ্যাটার্জি স্ট্রীটের মোড়ে দাঁড়িয়ে কলার না তুলে উর্দি পড়ে মস্তানি করছেন

২০১৯ এর ১৭ অক্টোবর । সন্ধ্যে সাতটা । দিন এবং সময়টা ভুলবোনা । যতদিন বেঁচে থাকব ।

সবে রেকর্ডিং করে চায়ের কাপে চুমুক দিয়েছি । দরজায় ঠক ঠক । দরজা খুলতেই ঝাঁপিয়ে পড়ল বাহিনী । কিছু বোঝার আগে, কিছু প্রশ্ন করার আগে প্রায় ১৫/ ১৬ জনের বাহিনী তুলে নিয়ে গিয়ে খড়দহ থানার ছোট্ট একটা কুঠুরিতে সন্ধ্যে সাড়ে সাতটা থেকে ভোর সাড়ে চারটে পর্যন্ত একটা টুলের ওপর বসিয়ে রেখে রাতের অন্ধকারে পুলিশের জিপে তুলে দিয়েছিল । অন্ধকার চিরে যে জীপ ছুটেছিল অজানা উদ্দেশ্যে সেখানে পাশে দুই বেয়নেট ধারী, সামনে অফিসার, মাঝখানে আমি । আমি তখনও জানিনা কোথায় যাচ্ছি, আমার পরিবার জানেনা কোথায় নিয়ে গেছে এরা আমাকে ।

সকাল সাড়ে দশটা নাগাদ জীপ পৌঁছালো পুরুলিয়ার প্রত্যন্ত এক গ্রামের আউট পোস্টে । দূরে পাহাড় দেখা যাচ্ছে । অযোধ্যা পাহাড় । জীপ থেকে যখন নামছি হাঁটার শক্তি নেই । কাঁধ, চোয়াল ফুলে, পিঠে, ঘাড়ে কালসিটে । জামা ছেঁড়া । আগের রাতের মারে বিধ্বস্ত আমি । কয়েকজন সিভিক প্রায় পাঁজা কোলা করে নিয়ে গেল একটা ঘরে । সেখান থেকে হাসপাতাল । ডাক্তার বললেন মেরেই তো এনেছেন, আর আনলেন কেন । কিছুটা ইতস্তত পুলিশ অফিসারটি বিড় বিড় করে কি বললেন বোঝা গেল না । বেশ মনে আছে প্রায় ঘন্টা খানেক চিকিৎসা চলেছিল । স্প্রে, তিনটে ইনজেকশন, গুচ্ছের ওষুধ খাইয়ে কোর্টে হাজির করিয়েছিল পুরুলিয়া পুলিশ । তিন রাত জেলে কাটিয়ে জামিন নিয়ে বেরিয়েছিলাম । আমার অপরাধ কালীঘাটের গুণধরের বাহিনীর টাকা তোলার একটা কাহিনী প্রমাণ সহ পেশ করেছিলাম বাংলার বার্তায় । তাতে নাকি মান গিয়েছিল গুণধর ভাইপোর । তাই ভবানীপুর নয়, কালীঘাট থানা নয়, পুরুলিয়ায় সাইবার ক্রাইমে এফ আই আর । এবং তার ভিত্তিতে আমার এই শাস্তি নির্ধারিত হয়েছিল ।

এই কাহিনীটা আজ আবার নতুন করে বললাম কারণ কালীঘাটের গুণধর ভাইপো এই ম্যানেজমেন্টটা সেদিন যাঁদের দিয়ে করিয়েছিলেন তাঁদের চিনতাম না কাউকে ব্যক্তিগত ভাবে । চেনার কথাও নয় । তৎকালীন পুরুলিয়ার এস পি ছিলেন গুণধর ভাইপোর খুব আস্থাভাজন । তাই আমার বিরুদ্ধে সেদিন সেই এস পি কেই কাজে লাগিয়েছিলেন ।

মনে আছে পুরুলিয়া থানার আই সি ছিলেন সঞ্জয় চক্রবর্তী । রাত দেড়টা পর্যন্ত তাঁর চেম্বারে তিন ডেপুটি কমিশনারের জেরা চলেছিল । ঘুরিয়ে ফিরিয়ে একটাই বার্তা দিচ্ছিলেন – কেন সরকারের বিরোধিতা করছেন ? কথা দিন এটা বন্ধ করবেন দু দিনে সব কেস withdrawn হবে । কলকাতায় আমরাই কথা বলিয়ে দেব । না হলে কবে ছাড়া পাবেন বলতে পারব না । আরও বড় বিপদ অপেক্ষা করছে । প্রায় ৩২ ঘণ্টা না খেয়ে ক্ষত বিক্ষত শরীর নিয়ে সে রাতটা যুঝেছিলাম । নত হইনি । অপরাধতো করিনি । পরের রাতেও এক জেরা । এক বার্তা । রাজী হইনি ।

জামিন পেয়ে সোজা ঝাড়খন্ডে গিয়ে আড়াল করেছিলাম নিজেকে । কালীঘাটের রত্ন আর রত্না তখন কেস সাজিয়েছেন বাংলার একাধিক থানায় । জামিন পাচ্ছি, আবার একটা কেসে পুলিশ ট্যাগ করছে, সেই পুরানো পুলিশি খেলা । তারপর দীর্ঘ আইনি লড়াই । এবং শেষপর্যন্ত বাড়ি ফেরা ।

এই কাহিনী আজ আবার লিখলাম দু বছর বাদে কারণ সেদিনের সেই কারিগরকে দেখলাম আজ কালীঘাটের হরিশ চ্যাটার্জি স্ট্রীটের মোড়ে দাঁড়িয়ে কলার না তুলে উর্দি পড়ে মস্তানি করছেন । তৎকালীন পুরুলিয়ার এস পি, এখন দক্ষিণ কলকাতার ডি সি পি আকাশ মাগারিয়া ।

দেখলাম রাজ্য বি জে পি সভাপতি অধ্যাপক ড: সুকান্ত মজুমদারকে আজ ধমকাচ্ছেন, এক মহিলা সাংবাদিককে চমকাচ্ছেন । দেখে নেব, দেখে নেব ভাব । সি এনের সাংবাদিক অভিরুপার কাছে ক্যারেক্টার সার্টিফিকেট দেখতে চাইছেন । প্রকাশ্যে দাঁড়িয়ে একটার পর একটা মিথ্যে কারণ দেখিয়ে প্রচার আটকাচ্ছেন । কিরকম একটা নির্লজ্জতা হাবে, ভাবে, আচরণে, বডি ল্যাঙ্গুয়েজে । পাড়ার রকে বসা তৃণমূলীদের স্টাইলে । দেখছিলাম । পারফেক্ট ভাইপো ক্লাস ।

দেখছিলাম আর ভাবছিলাম সেই দু বছর আগের রাতের দুর্বিষহ রাতের কথা ।সেদিনের সেই নিভৃত কারিগরের কথা । যার গেঁথে দেওয়া স্মৃতিচিহ্ন শরীরে মনে আজও বয়ে বেড়াচ্ছি । আমৃত্যু বইব । ভোলা যাকে অসম্ভব । ভুলব না ।

সারা রাজ্য জুড়ে আজ এইরকম কত অফিসার তৈরি করে রেখেছেন কালীঘাটের গুণধর রত্ন কে জানে !

একটা আকাশ মাগারিয়ার সন্ধান আজ নতুন করে পেলাম । কিভাবে এরা শাসকের দাস হয়, দাসত্ব করে চাক্ষুষ করেছি নিজের জীবনের অভিজ্ঞতায় এক গাঢ় অন্ধকার গভীর রাতে । কত মানুষের জীবন নষ্টের কারিগর এরা এভাবে আদতে হয় কেউ কি কতটা জানি ?

একটা আকাশ কত অন্ধকার হয়, হতে পারে সেদিন দেখেছি, আজও আবার নতুন করে দেখলাম । অন্ধ দাসত্বে এরা কি অনাবিল আনন্দ খুঁজে পায় । এঁদের শিক্ষা, মেধা কি অনায়াসে এরা জলে দিয়ে দেয় !!

তবু কি নির্বিকার এরা, নিশ্চল এরা, প্রভুর কৃপা পেতে । সারমেয় হার মানে এঁদের প্রভু ভক্তির কাছে । এঁরা আজও কলার না তুলেও নির্লজ্জ ভাবে মস্তানি করে উর্দিকে ঢাল করে । এরাও এক একজন রত্ন এই ” রত্নার” যুগে । নয় কি ?

সন্ময় বন্দ্যোপাধ্যায় ( ৯৮৩০৪২৬০৭৮)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.