আলেকজান্দ্রিয়া লাইব্রেরীর জ্ঞানের উৎস
গ্ৰীসের জ্ঞান-বিজ্ঞান এর উৎস খুঁজতে হলে আলেকজান্দ্রিয়ার লাইব্রেরীর ইতিহাস ঘাঁটতে হবে।
বিজ্ঞানের সঙ্গে জড়িত বেশিরভাগ গ্ৰীক নামের সঙ্গেই আফ্রিকার আলেকজান্দ্রিয়া লাইব্রেরীর যোগ পাওয়া যায়।
কিন্তু আলেকজান্দ্রিয়ার লাইব্রেরীর তৈরি হলো কেমন করে ? ইতিহাসে আলেকজান্দ্রিয়া লাইব্রেরী আর গ্ৰীস যেনো সমার্থক। কিন্তু আলেকজান্দ্রিয়া লাইব্রেরী এবং এর প্রাচীন বই গুলিকে গ্ৰীসের সৃষ্টি বলে দাবি করার কি কোনো প্রমাণ আছে ?
আলেকজান্দ্রিয়া শহর কে গ্ৰীক ও মিশরীয় সংস্কৃতির যুগলবন্দী বলা যায়।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্যযোগ্য যে , আলেকজান্ডার বিনা রক্তপাতে মিশর জয় করেছিল এবং এর প্রতিদান হিসেবে মিশরীয়দের উপাসনার প্রতি সম্মান জানাতে মিশরীয় দেবতার প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিল। আলেকজান্ডারের মৃত্যুর পর টলেমী একইপথে হেঁটেছিল কারণ সে জানতো মিশরের ক্ষমতা , মিশরীয়দের সমর্থন ছাড়া ধরে রাখা যাবে না। কিন্তু মিশরীয় সংস্কৃতির প্রতি অত্যধিক ঝুঁকে পড়াও টলেমীর পক্ষে সম্ভব ছিল না কারণ তার সৈন্যবাহিনীর গ্ৰীক সৈন্যরা তা ভালোভাবে গ্ৰহণ করতো না। তাই টলেমী উভয় সংস্কৃতির জন্যই পথ খোলা রেখেছিল।
ভারতের মতো মিশরেও মন্দিরের সঙ্গেই গ্ৰন্থাগার থাকতো আর আলেকজান্দ্রিয়ার গ্ৰন্থাগারটি মিশরীয় দেবতা সেরাপিসের (Serapis) মন্দির সংলগ্ন ছিল।এই তথ্যগুলি প্রাচীন আলেকজান্দ্রিয়ার সংস্কৃতি সম্বন্ধে গুরুত্বপূর্ণ ধারণা দেয়।
কয়েক হাজার জনসংখ্যা বিশিষ্ট গ্ৰীসের পক্ষে আলেকজান্দ্রিয়া লাইব্রেরীর পাঁচ লক্ষেরও বেশি বই লেখা কি করে সম্ভব ? সেই সময় বই লেখা হতো প্যাপিরাসে।আর প্যাপিরাস আমদানি করতে হতো মিশর থেকে যার খরচ অত্যন্ত বেশি।প্যাপিরাস অত্যন্ত ভঙ্গুর হওয়ায় এর রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয়সাপেক্ষ এবং প্যাপিরাসে লিখিত বইগুলির পুনর্লিখন এর প্রয়োজন হতো।
তাছাড়া প্রতিনিয়ত যুদ্ধে রত গ্ৰীসের মানুষের এতো বই লেখার মতো অবসর থাকার কথা নয়।গ্ৰীক ঐতিহাসিক স্ট্রাবোর মতে গ্ৰীসে অ্যারিস্টটল প্রথম ব্যক্তি যার লাইব্রেরী ছিল অর্থাৎ আলেকজান্ডারের আগে গ্ৰীসের কোনো লাইব্রেরীর কথা জানা যায় না।প্লেটোর মতে , আলেকজান্দ্রিয়ার লাইব্রেরীর আগে গ্ৰীসে বিজ্ঞান বলে কিছু ছিল না। চাঁদ , পৃথিবীর অংশ– গ্ৰীসে এই সত্য বলাই ছিল সক্রেটিসের মস্ত বড় অপরাধ। এমনকি অ্যারিস্টটল কে বিজ্ঞান-চর্চার জন্য এথেন্স থেকে পালাতে হয়েছিল। এইরকম অসহিষ্ণু ও কুসংস্কারে পূর্ণ সভ্যতার বিজ্ঞান-চর্চা নিয়ে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক।গ্ৰীক ঐতিহাসিক হেরোডেটাসকে উচ্চশিক্ষার জন্য মিশরে যেতে হয়েছিল।হেরোডেটাসের মতে অনেক গ্ৰীক-দেবতা, মিশরীয় দেবতাদের অনুকরণমাত্র। আলেকজান্ডারের আগে গ্ৰীসের কোনো বিজ্ঞান চর্চা ছিল না।
বেশিরভাগ গ্ৰীক নাম যাদের সঙ্গে আমরা পরিচিত প্রত্যেকে আলেকজান্দ্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত , যেমন আর্কিমিডিস , ক্লডিয়াস টলেমী , ইউক্লিড – এদের কেউই গ্ৰীসের এথেন্স থেকে আসেন নি।
তাহলে বিশ্ব ইতিহাসের জ্ঞানকেন্দ্র হিসেবে আফ্রিকা মহাদেশের আলেকজান্দ্রিয়া কে গ্ৰীকদের কৃতিত্ব বলে দাবি করার কি কোনো যুক্তি আছে ? সেই জ্ঞান কে সম্পূর্ণভাবে গ্ৰীক-সংস্কৃতির গর্ভজাত বলা কি যুক্তিসঙ্গত ? কারণ আলেকজান্দ্রিয়ার উপর মিশরীয় প্রভাবের প্রমাণ যথেষ্ট আছে।
আলেকজান্ডারের পূর্বে গ্ৰীসে বিজ্ঞান চর্চা ও লাইব্রেরীর অস্তিত্ব না থাকলে , আলেকজান্দ্রিয়া লাইব্রেরীর এতো বই এলো কিভাবে ?
আমরা ইতিমধ্যেই জেনেছি কিভাবে ক্রুসেড পরবর্তী সময়ে খ্রীষ্টিয় ইউরোপ ; টলেডো লাইব্রেরী ও তার আরবীতে অনুবাদ করা মূল্যবান গ্ৰন্থসম্ভার নিজেদের দখলে নিয়েছিল। কিন্তু এইধরনের ঘটনা আরো কয়েক শতাব্দী আগেই শুরু হয়েছিল।মিশর , পার্সিয়া,ব্যাবিলন এর মতো পুরাতন সভ্যতাগুলির কয়েকশ বছরের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি , তাদের জ্ঞানচর্চা ও সেই জ্ঞান নথিবদ্ধ করার জন্য পর্যাপ্ত ছিল।পার্সিয়ার সম্রাট দারিয়ুস কে পরাজিত করার পর , পার্সিয়ার প্রচুর বই আলেকজান্ডারের দখলে চলে আসে কিন্তু এতো বইয়ের খুব অল্পই আলেকজান্ডারের পরামর্শদাতা অ্যারিস্টটল পর্যন্ত পৌঁছানো সম্ভব হয় আর বেশিরভাগই পড়ে থাকে বর্তমান মিশরের আলেকজান্দ্রিয়াতে।
এই প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘পারস্যে’ প্রবন্ধের কিছু অংশ উল্লেখযোগ্য….
“ডাক্তার বললেন, আলেকজাণ্ডার এই প্রাসাদ পুড়িয়ে ফেলেছিলেন সন্দেহ নেই। আমার বোধ হয় পরকীর্তি-অসহিষ্ণু ঈর্ষাই তার কারণ। তিনি চেয়েছিলেন মহাসাম্রাজ্য স্থাপন করতে, কিন্তু মহাসাম্রাজ্যের অভ্যুদয় তাঁর আগেই দেখা দিয়েছিল। আলেকজাণ্ডার আকেমেনীয় সম্রাটদের পারস্যকে লণ্ডভণ্ড করে গিয়েছেন।
এই পর্সিপোলিসে ছিল দরিয়ুসের গ্রন্থাগার। বহু সহস্র চর্মপত্রে রুপালি সোনালি অক্ষরে তাঁদের ধর্মগ্রন্থ আবেস্তা লিপীকৃত হয়ে এইখানে রক্ষিত ছিল। যিনি এটাকে ভস্মসাৎ করেছিলেন তাঁর ধর্ম এর কাছে বর্বরতা। আলেকজান্দার আজ জগতে এমন কিছুই রেখে যান নি যা এই পর্সিপোলিসের ক্ষতিপূরণ-স্বরূপে তুলনীয় হতে পারে। “
প্রাচীন গ্ৰীকদের সময়কাল খ্রীষ্ট ধর্ম প্রবর্তনের অনেক আগেই।তাই প্রাচীন গ্ৰীকদের সঙ্গে খ্রীষ্টানদের সরাসরি সংঘাতের সম্ভাবনা ছিল না। কিন্তু পরবর্তীতে আলেকজান্দ্রিয়ার থিয়ন(Theon) , প্রোক্লুস(Proclus) এর সঙ্গে চার্চের বিরোধ হয়। আলেকজান্দ্রিয়ার দার্শনিকদের জ্ঞানতত্ত্ব (epistemology) যাজকদের কর্তৃত্ব কে বিপদের মুখে ফেলে দিয়েছিল , যাজকরা সাধারণ মানুষের উপর তাদের নিয়ন্ত্রণ হারাতে বসেছিল।
দার্শনিকদের প্রশ্নের সামনে খ্রীষ্টান যাজকরা বিব্রত ও অসহিষ্ণু হয়ে পড়ছিল। ঐতিহাসিক গিবনের (Gibbon) মতে খ্রীষ্টান যাজক থিয়োফিলাস ( Theophilus) সেরাপিসের মন্দির ও তার সংলগ্ন আলেকজান্দ্রিয়া লাইব্রেরী ধ্বংস করে ।এই ঘটনার সঙ্গেই খ্রীষ্টিয় ইউরোপের অন্ধকার যুগ বলা যায় কারণ আপন মত প্রতিষ্ঠার জন্য যুক্তির বদলে শক্তির প্রয়োগ শুরু হলো।
এই অন্ধকার থেকে বের হয়ে ইউরোপের জ্ঞান-বিজ্ঞানের গুরুত্ব উপলব্ধি করতে লেগে গেলো প্রায় ৫০০ বছর – ইউরোপ নতুনভাবে জাগলো।
ইউরোপ জ্ঞান কে প্রাধান্য দিলো কিন্তু সেই জ্ঞান-বিজ্ঞানের উৎস সম্পর্কে সত্য বলতে কিংবা সেই জ্ঞানের জন্মদাতা সংস্কৃতি সম্পর্কে শ্রদ্ধাশীল হতে ইউরোপ কি পারলো ?
ইউরোপ কি জ্ঞানতত্ত্বের(epistemology) দর্শন কে নিজের মতো করে পরিবর্তন করলো শুধুমাত্র উপাসনা পদ্ধতির স্বার্থে ?
জ্ঞান-বিজ্ঞানের উৎস হিসেবে ভিন্ন সংস্কৃতি কে মান্যতা দিলে নতুন ইউরোপের লক্ষ্যপ্রাপ্তি তে বিঘ্ন ঘটতো । তাই ক্রুসেডের পরে ইউরোপ ঠিক করলো জ্ঞান-বিজ্ঞানের উৎস হিসেবে এমন সংস্কৃতি কে কৃতিত্ব দিতে হবে যাদের সঙ্গে ইউরোপের বর্তমানে সংঘাতের কোনো সম্ভাবনা নেই অর্থাৎ যে সংস্কৃতি আগেই তাদের রঙে রঞ্জিত হয়েছে।
গ্ৰীস কে সমস্ত জ্ঞানের উৎস হিসেবে দেখিয়ে সেই জ্ঞানের উত্তরাধিকারী হিসেবে ‘নবজাগরিত’ ইউরোপ নিজেকে দেখাতে শুরু করলো।
আমরা দেখলাম ইতিহাসের বিভিন্ন সময়ে ভিন্ন সংস্কৃতি কে ধ্বংস করতে কখনো লাইব্রেরী পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে নয়তো বিজেতার সংস্কৃতি কে পরাজিতের উপরে চাপিয়ে দিতে পরাজিতের জ্ঞানকে ভাষান্তর করে অন্যভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে।
বিজেতাগণ আপন কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য কখনো একটি বিশেষ উপাসনা-পদ্ধতি গ্ৰহণের মাধ্যমে জনসমর্থন আদায় করেছেন কখনো আপন উপাসনা-পদ্ধতির বিরুদ্ধাচরণ কে তার কর্তৃত্বের বিরোধিতা হিসেবে দেখেছেন।
পৃথিবীর ইতিহাস আমাদের দেখিয়েছে যে যেসব বিজেতাগণ , বিজিতের জ্ঞানকে ভবিষ্যতের সমৃদ্ধির উপযোগী মনে করেছে তারা বিজিতের কৃতিত্ব কে ইতিহাস থেকে যথাসম্ভব মুছে দিতে পরাজিতের সংস্কৃতির সমস্ত স্মৃতি চিহ্ন মুছে দিয়েছে। পৃথিবীর ইতিহাসের বিভিন্ন যুগ-সন্ধিক্ষণে ক্ষমতা পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে গ্ৰন্থাগার পুড়িয়ে দেওয়া বা গ্ৰন্থাগারের বিপুল পরিমাণ বইয়ের অনুবাদ আমরা দেখতে পাই ।
পরাধীন জাতিকে দীর্ঘকাল পরাধীন করে রাখতে হলে সেই জাতির নিজস্বতা কে নষ্ট করে দিয়ে জ্ঞানের ক্ষেত্রে তাদের চিন্তায় হীনমন্যতা ঢুকিয়ে দিতে পারলে পরাধীন জাতি , পরাধীনতাকেই শ্রেয় বলে মনে করে।
মিশরীয় সভ্যতা এই কৌশলেই আজ ধ্বংসপ্রাপ্ত , ভারতবর্ষ এখনো টীকে থাকলেও তাঁর শিক্ষা আপন সংস্কৃতি থেকে দূরে।আরবীয়রা পার্সিয়া জয়ের পর যা করেছিলো , খ্রীষ্টিয় ইউরোপ ক্রুসেডের সময় যা করেছিলো , গ্ৰীস মিশর জয়ের পর যা করেছিলো ইংরেজরা ভারতবর্ষে সেই একই কাজ করলো—- ভারতবর্ষের সংস্কৃতে লিখিত পুথিগুলির অনুবাদ এবং ভারতবর্ষের শিক্ষাব্যবস্থার সম্পূর্ণ বিনাশসাধন।
একদিকে ভারতীয় সংস্কৃতি থেকে ভারতবাসী কে দূরে নিয়ে যাওয়ার কাজে নেমে পড়লো মিশনারীরা আর অন্যদিকে ভারতীয় জ্ঞান পাচার হতে থাকলো ইউরোপে।
আমরা দেখলাম ,ভারতবর্ষ থেকে সংস্কৃতের পুঁথি পার্সিয়াতে অনুবাদ হয়। ব্যাত-আল-হাকিমা তে পার্সিয়া থেকে আরবী , আরবী থেকে ল্যাটিন ভাষায় টলেডো লাইব্রেরী তে। জ্ঞান-চর্চার জন্য প্রয়োজন একটি সুগঠিত সমাজব্যবস্থা , শিক্ষাব্যবস্থা । বর্তমানে বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক প্রমাণের ভিত্তিতে আর্য-আক্রমণ তত্ত্বের অসাড়তা প্রমাণ হওয়ার পর ভারতবর্ষে গড়ে ওঠা বৈদিক সভ্যতার প্রাচীনত্ব নিয়ে সন্দেহ থাকে না।বৈদিক সভ্যতার সময়কালে পৃথিবীর অন্যত্র বৈদিক সভ্যতার সমতুল্য জ্ঞানচর্চা হয়েছে কি না তা গবেষণার বিষয়। কিন্তু ভারতবর্ষসহ পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের সভ্যতা ও তার জ্ঞান-চর্চা কে বিঘ্নিত করে যারা ক্ষমতাশালী হয়েছে , তারা মানবসভ্যতাকে পিছনের দিকেই নিয়ে গিয়েছে।
আমরা সেইদিনের অপেক্ষায় নেই যেদিন বিশ্ব ভারতবর্ষের কৃতিত্ব কে স্বীকার করবে , আমরা সেদিনের অপেক্ষায় রইলাম যেদিন ভারতবর্ষ নিজস্ব শিক্ষাপদ্ধতি কে সগৌরবে বাস্তবায়িত করবে ।
ইতিহাস আমাদের এই শিক্ষায় দেয় যে ধন-সম্পদের মতো জ্ঞান-সম্পদের প্রবাহের অভিমুখ ঠিক করে কোনো একটি সভ্যতার অভ্যন্তরীণ শক্তি। জ্ঞানকে রক্ষা করতেও প্রয়োজন শক্তি।এক ঐক্যবদ্ধ শক্তিশালী সমাজ গঠনের মাধ্যমেই জ্ঞানচর্চা ও সেই জ্ঞান কে রক্ষা করা সম্ভব।
(চলবে)
(তথ্যসূত্র অন্তিম পর্বে দেওয়া হবে)
পিন্টু সান্যাল(Pintu Sanyal)