“স্পর্শ সম্বন্ধ ন বিদ্যতে “
স্বল্প কথায় অস্পর্শ যোগের মূল ভাবটি এভাবেই প্রকাশ করেছিলেন আদি শংকরাচার্য, গৌড়পাদাচার্যের মান্ডুক্য কারিকের বিষয়ে লিখতে গিয়ে।গৌড়পাদাচার্য যে আসলে বাঙালী এবং মাছভক্ত গৌড় সারস্বত ব্রাহ্মণরা মূলতঃ বঙ্গজ তার পক্ষে-বিপক্ষে বিস্তর তর্ক আছে।সে যাই হোক, বাঙালীর বহু বিদ্যেই যে জিনস, জেলাতো আর ওলিপাবের ভিড়ে হারিয়ে গেছে সেটা অনস্বীকার্য; তার মধ্যে অন্যতম হলো বাঙালীর একান্ত আপন তন্ত্রোক্ত রাজযোগ, যা আজ প্রায় লুপ্ত বিদ্যা(সম্পূর্ণ নয়, সে প্রসঙ্গ পরের জন্য তোলা থাক)।
বোধয় জগন্মাতার ইচ্ছায় ঢেউ, মানুষ বা পরিস্থিতির মতো বিদ্যাও ডুবতে ডুবতে ভাসে, ভাসতে ভাসতে ডুবে যায়।নবীন চন্দ্র চট্টোপাধ্যায় অর্থাৎ তিব্বতিবাবার কথাই ধরা যাক, অমার অতি সীমিত দেখা-জানার মধ্যে ইনি ছিলেন গীতার ভাষায় 'সঃ মহাত্মা সুদুর্লভ'। জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাস এঁর সম্পর্কে লিখেছিলেন "কাশী অবস্থানকালে ভেলুপুরায় তিলভাণ্ডেশ্বর নামক স্থানে জনৈক প্ৰাচীন বৈদান্তিক সন্ন্যাসীর সহিত তাহার সাক্ষাৎ হয়। এই বৃদ্ধ সন্ন্যাসী ভিন্ন ভিন্ন দেশে বিভিন্ন নামে পরিচিত। তঁহার জন্ম শ্ৰীহট্টে।............এইরূপে কোথাও তিব্বতী বাবা, কোন স্থানে ফুঙ্গি বাবা, কোথাও পাগল পরমহংস এবং কোথাও বা পরমহংস বাবা বলিয়া তিনি পরিচিত |"
বেছে বেছে এঁর সম্পর্কেই বা কেন সেকথা বলছি? যোগী হিসেবে বহু বাঙালী শরীর যথেষ্ট খ্যাতিলাভ করেছেন।
উত্তর হলো এঁর মার্গের বৈশিষ্ট্যে, তিব্বতি বাবা বা নবীন চন্দ্র চট্টোপাধ্যায় দীর্ঘকাল যাবৎ সিদ্ধভূমিতে যে সাধনমার্গ অবলম্বন করে সিদ্ধ হন তাই বহু পূর্বে গৌড়পাদের উল্লেখিত অস্পর্শ যোগ, যাকে আজ সমগ্র বিশ্ব চেনে Dzogchen বলে।চীনের তিব্বত অক্রমণ ও দখলের পর থেকে তিব্বতি লামারা বিশ্বের নানা জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকার দরুন আর তাঁদের সাধনবিদ্যাগুলি অনেক ক্ষেত্রেই গোপন রাখতে সমর্থ হননি, তারই অন্যতম মহাসিদ্ধ নরোপার ষড়ঙ্গযোগ এবং তার চরম উৎকর্ষ Dzogchen বা অস্পর্শ যোগ|
তা এ এমন কি আছে যা অন্যান্য সাধনমার্গে নেই? এর উত্তর বোধয় Bönরা সংক্ষেপে সবচেয়ে বিস্তারে বুঝিয়েছেন : কিছুই না।
তা তিব্বতি বাবার ষড়ঙ্গ যোগ সিদ্ধির বিষয়ে খুঁটিনাটি তো সোহম স্বামী ছাড়া বিশেষ কেউই জানতেন না, আমি কিকরে স্থির সিদ্ধান্তে উপনীত হচ্ছি?
তার সূত্র ওনার প্রামান্য জীবনীর মধ্যেই আছে : তিনি বাঙলায় নিজের শিষ্যদের সামনে যখন প্রকট হন তাঁর শরীর ছিলো এক ভুটানী রাজপুরুষের, পূর্বের
বাঙালী হিন্দু শরীরটি বার্ধক্যে জীর্ণ হওয়ার দরুন ত্যাগ করে তিনি এক সদ্যমৃত ভুটানী কায়া ধারণ করেন, তাঁর পরবর্তীকালের শিষ্যরাও তাঁর চেহারার সঙ্গে মুখের ভাষা প্রথমে কিছুতেই মেলাতে পারতেন না, কোনো খাস Drukpa কিকরে অবিকল সিলেটি বাংলায় কথা বলতে পারে?
এর উত্তর লুকিয়ে আছে নরোপার ষড়ঙ্গযোগে এবং লামা জে সংখাপার(১৩৫৭ - ১৪১৯) রচিত বর্তিকায়, মৃত্যুর ঠিক আগে সারিবদ্ধ দেহস্থ চক্রসমূহ ও পদদ্বয়কে সমান্তরাল রেখে তন্ত্রোক্ত রাজযোগের ক্রীয়ায় বাহ্যবায়ুর থেকে পৃথকীকৃত প্রাণবায়ুকে ব্রহ্মরন্ধ্রের থেকে নির্গত করানো যায়, আবার গুণকর্ম বিচার করে অন্য শরীরে প্রবেশ করানোও যায়, যা শ্রী নবীন চন্দ্র চট্টোপাধ্যায় করে দেখিয়েছিলেন।
সূক্ষ্মবুদ্ধির পাঠকের কাছে তাঁর জীবনই তাঁর শিক্ষা।
দেবানঞ্জন মুখার্জি