অসংলগ্ন কাব্য অসীম রায়ের উপন্যাস। নায়ক সূর্য। স্ত্রী আর মায়ের অনুযোগ শুনতে শুনতে ক্লান্ত হয়ে সহকর্মী শ্রমিক নেতার কাছে সমাধান চেয়েছিল। সেই নেতা ভদ্রলোক ছিলেন সি পি আই ঘরানার। উপায় বাৎলেছিল – জিভে তো হাড় নেই, মায়ের কাছে মায়ের মত, স্ত্রীর কাছে তার মনের মত কথা বলাই সমাধান। শ্রমিক আর মালিক পক্ষের মাঝখানে অমনি করে ঝোপ বুঝে কোপ মারাই হবে ট্রেড ইউনিয়ন নেতার স্বাভাবিক পরামর্শ। কথাগুলি শুনে মনে হল অধ্যাপক অমর্ত্য সেনের ‘জয় শ্রীরাম’ ধ্বনি বিষয়ে মত প্রকাশ আর তার ব্যাখ্যা প্রদানে।
উনি শ্রদ্ধেয় অধ্যাপক অর্থনীতির দিগগজ নোবেল জয়ী ‘ভারতরত্ন’ – তাঁর মতামত নিয়ে আমার ভিন্ন মত নানাভাবে ব্যক্ত করেছি।উনি দু তিনটি কথা বলেছিলেন। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর আপত্তি ছিল স্পষ্ট –
১. ‘জয় শ্রীরাম’ ধ্বনির সঙ্গে বাঙ্গালীর সাংস্কৃতিক সম্পর্ক নেই। এটি অন্য ধর্মের মানুষকে আক্রমণ করতে চায়। অতএব একে ধর্মীয় ধ্বনি বলে গ্রহণ করা যাবে না।
২. রাম নবমী বাঙ্গালীর উৎসব নয়। রামকেন্দ্রিক সংস্কৃতি বহিরাগত।
৩. রামচন্দ্র নয় বরং বাঙ্গালির ধর্ম ধ্বনি ‘জয় মা দুর্গা’ বিদায়কালীন সম্ভাষণ ‘দুগগা দুগগা’।
ইতোমধ্যে পশ্চিমবঙ্গের নানা স্থানে অধ্যাপক অমর্ত্য সেনের ছবি সমন্বিত ব্যানার চোখে পড়েছে। কারা এটি প্রচার করল তা জানা যাচ্ছে না। অধ্যাপক সেনের নিশ্চয় জানা আছে – না জানা থাকলে সাংবাদিকদের খোঁজা উচিত। পশ্চিমবঙ্গবাসী হিসাবে এই সচেতন নাগরিক প্রচারকদের পরিচয় পেলে খুশিই হব। কিন্তু যেটুকু জানা গেল এই ‘রাম বিরোধী অমর্ত্য বাহিনী’ নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক। তাতেই সন্দেহ হচ্ছে অধ্যাপক সেন কি পশ্চিমবঙ্গের শাসক দলে নাম লেখাচ্ছেন? না তো। যেভাবেই দেখি এরকম মেঘের আড়াল থেকে ছদ্ম যুদ্ধ রামায়ণ কথাকে পশ্চিমবঙ্গে রামযাত্রার চেয়ে মনোরম এক মজাদার ব্যাপারে পরিণত করেছে।
‘ রামযাত্রা’ অধ্যাপক অমর্ত্য সেন হয়তো দেখেন নি। উত্তর ভারতে ‘রামলীলা’ – “নৌটঙ্কি” জাতীয় লোকনাটক – খুবই জনপ্রিয় আমরা ছোটবেলায় দেখেছি। রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী বলেছিলেন, ‘ যাহা পড়িতে হয় না – তাহাই মহাকাব্য’। ঠিক কথা আমরা যারা প্রান্তিক গ্রামীণ সহজ জীবন পরিধির মানুষ – রামায়ণ মহাভারত আমাদের পড়তে হয়নি; মায়ের কাছে, পিতার কথায়, প্রতিবেশীর পাঠে আর রামযাত্রায় জেনে গেছি। হতে পারে, অধ্যাপক সেন অতি বিশিষ্ট তিনি রামায়ণ কথা জানেন নি। এখন তিনি নিজে এবং তার সমর্থক মেঘনাদরা যুদ্ধে নেমেছেন – রামচন্দ্রের বিরুদ্ধে।
সবাই আড়ালে নেই। চন্দ্রকোনা রোডে মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী ‘জয় শ্রীরাম’ শোনার সঙ্গে সঙ্গে গাড়ি থেকে নেমে হুঙ্কার দিয়েছেন। দু তিনজন তরুণ নিছক গলার আওয়াজকে হাতিয়ার করে শ্রীমতি বন্দ্যোপাধ্যায়কে এতটা আক্রমণ করলেন যে অধ্যাপক সেন ও তাঁর বাহিনী একে অসহিষ্ণুতার চূড়ান্ত বলে উঠলেন । ওই তরুণদের শ্রীঘর ঘুরে আসতে হল। কী আক্রমণাত্মক দেশ বিরোধী কাণ্ড। ভারতবর্ষের বিবেক অধ্যাপক সেন স্বভাবতই যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একে আক্রমণাত্মক বলে চিহ্নিত তো করবেনই। আবার সেদিন অবাধ্য ভাটপাড়ায় যাত্রা করে মাননীয় মুখ্যমন্ত্রী যখন শুনলেন ‘জয় শ্রীরাম’ তখন তাঁর মনে হল কেউ তাঁকে গালাগালি দিচ্ছে। এত সাহস। যথারীতি আবার চলন্ত গাড়ি থেকে নেমে এসে স্বভাবসিদ্ধ ভাষা ব্যবহার করে ‘নাকা চেকিং’ শুরু করলেন। বললেন, ওই অঞ্চলের সবাই তাঁরই খায় ও পরে – তবু এত সাহস। কথাগুলি রাবণ রাজা যদি কালনেমি বা বিভীষণকে বলতেন লাগসই হত। তবে অমর্ত্য সেন ও বঙ্গের উচ্চ স্তরীয় বিদ্যাকেন্দ্র যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালইয়ের জনতার করতালিতে অনুমোদিত – সুতরাং এই হুঙ্কার প্রদান অবশ্যই গণতান্ত্রিক এবং অবশ্যই ফ্যাসিবাদ বিরোধী ।
এতদূর ঠিকই ছিল। বাদ সাধল আজকে প্রকাশিত সাক্ষাৎকারে। রাজা ক্যানিউট সমুদ্র শাসন করতে চেয়েছিলেন – অধ্যাপক অমর্ত্য সেন নিশ্চয় বুঝেছেন রাম বিরোধী যুদ্ধযাত্রায় খুব লাভ নেই। তাই ‘জয় শ্রীরাম’ ধ্বনি সম্পর্কে আগের অবস্থান থেকে একটু সরে এসেছেন। এটি যেন বিশেষত মুসলমানদের বিরুদ্ধে ব্যবহৃত না হয়, শুধু এই কথাই তাঁর বক্তব্য। রণধ্বনি হিসাবে ‘আল্লাহু আকবর’ সম্পর্কে তাঁর কী বক্তব্য জানতে ইচ্ছা করে। এই রনধ্বনি ভারতকে ভাগ করেছে। পাকিস্তান বা বাংলাদেশে রামভক্ত বা দুর্গভক্ত কেউ থাকতে পারেন নি। কেন তারা বাস্তুহারা হতে বাধ্য হয়েছেন? ‘আল্লাহু আকবর’কে কি অত্যন্ত বন্ধুত্বপূর্ণ সুমধুর মনে করেন অধ্যাপক অমর্ত্য সেন? খুব স্পষ্ট না হলেও আজকের সাক্ষাতকারে তিনি পূর্ব পাকিস্তানে দেশ ভাগের অর্থনৈতিক ফল হিসাবে মুসলমান প্রজাদের হাতে কৃষিযোগ্য জমি হস্তান্তরিত হওয়ার ফল তিনি মনে করেছেন। অর্থাৎ ‘আল্লাহু আকবর’ রণধ্বনি হিসাবে তেভাগা বা অপারেশন বর্গার মতই প্রগতিশীল। হয়তো তাই মাননীয় মুখ্যমন্ত্রী হিজাব পরে পরম উৎসাহে এই ধ্বনি দিয়ে থাকেন।
বাঙ্গালী মধ্যবিত্ত এখন গণ্ডারের চামড়া অর্জন করেছে। আমরা কোন সহজ সাধারণ ঘটনায় প্রতিক্রিয়া জানাই না। জানাতে ভয় পাই। কথা শুনি হাততালি দিই আর হিসাব করি। পশ্চিমবঙ্গের বৃদ্ধাশ্রম; নতুন প্রজন্ম রাজ্যের অসাধারণ শিল্প উন্নয়নের ধাক্কায় রাজ্য বা দেশ ছাড়া – অন্নরা ছন্নছাড়া রাম বিরোধী ‘অমর্ত্য বাহিনীতে’ নাম লিখিয়েছে। উত্তরবঙ্গে বাম কংগ্রেস আর তৃণমূল একসঙ্গে মিছিল করছে। বিধানসভায় সভায় রাজ্যের নাম বদল থেকে শুরু করে জয় শ্রীরাম বিরোধী যুদ্ধে মাইক্রোফোন হাত বদল করে রণহুংকার চলছে। মেঘনাদরা আড়ালে থেকে এক মহাকাব্যিক মহা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত। অভিনন্দন জানাই অধ্যাপক অমর্ত্য সেন – আপনি ক্রমেই অর্থপূর্ণ হয়ে উঠছেন আপনাকে শ্রদ্ধা জানাই।