এভাবেও মানুষকে খুন করা যায় ? তাও এই কলকাতা শহরে ? একবিংশ শতাব্দীতে ?
মিডিয়াতে কাঁকুরগাছির অভিজিৎ সরকারকে গলায় ফাঁস দিয়ে পরেশ পাল আর স্বপন সমাদ্দারের বাহিনী কি ভাবে খুন করেছিল তাই শুনেছিলাম, পড়েছিলাম । আজ তাঁর পারলৌকিক কাজে গিয়ে বুঝে এলাম কি ভয়ানক ছিল সেই খুন, সেই সংগঠিত হত্যা ।
মা তাঁর ছেলের খুন দেখেছে, সামনে থেকে । সেই মায়ের মুখের বর্ণনা ……..
২ রা মে, দুপুর আড়াইটে, চারিদিকে উৎসবের বোম ফাটছে । হঠাৎই ছেলে দুটো আমার ঘরে ঢুকে এল । গলি দিয়ে দেখলাম রে রে করে তেড়ে আসছে সবুজ আবির মাখা হাতে বড় বড় লাঠি নিয়ে ছেলের দল । বাইরে থেকে চিৎকার….. আয় বেরিয়ে আয় ….আর বি জে পি করবি, আয় । উল্টোদিকের তৃণমূল করা পরিবার দেখিয়ে দিল আছে, আছে, বাড়িতে আছে । আটকাতে চেষ্টা করেছিলাম প্রাণপন । চোখের সামনে কেড়ে নিয়ে গেল অভিজিৎকে । তারপর গলির কেবল লাইনের তার ছিঁড়ে গলায় ফাঁস বেঁধে দু দিক দিয়ে টানছে দু দল । আমি মা হয়ে পাগলের মত চেঁচিয়ে যাচ্ছি, আমার বড় ছেলে বিশ্বজিৎ দৌড়ে গিয়ে গলির মুখে দাঁড়িয়ে থাকা নারকেল ডাঙ্গা পুলিশকে বলছে আপনারা বাঁচান ভাইটাকে ।
পুলিশ দাঁড়িয়ে দেখল আমার ২৫ বছরের ছেলেটা দম বন্ধ হয়ে মারা যাচ্ছে । মাটিতে পড়ে যাওয়ার পর ইঁট দিয়ে মাথা থেঁতলে দিল । রক্তে ভেসে গেল গলি । ওরা দৌড়ে মমতা ব্যানার্জি জিন্দাবাদ, তৃণমূল কংগ্রেস জিন্দাবাদ স্লোগান দিতে দিতে উল্লাস করতে করতে পুলিশের সামনে দিয়ে বেরিয়ে গেল ।
পুলিশ এবার দৌড়ে এল । বলল – মাসিমা চট করে একটা চাদর আনুন । দৌড়ে গেলাম ভাঙচুর হওয়া ঘরে । নিয়ে এসে দেখলাম – একটা প্লাস্টিক মুড়ে ছেলেটার মৃত দেহ নিয়ে চলে গেল পুলিশ । পাশের বাড়ির কল থেকে জল নিয়ে একদল পুলিশ পাগলের মত রক্ত ধুয়ে সাফ করে চলে গেল ।
আমি তখন বিধ্বস্ত । চোখের সামনে দেখলাম ভেঙে পড়া বড় ছেলে বিশ্বজিৎকে তুলে নিয়ে পুলিশ চলে গেল । তারপর বার বার ফোন করতে লাগলাম ওকে । ফোন বেজে গেল কেউ ধরল না । পরে শুনেছি বড় ছেলের ফোনটা কেড়ে নিয়ে পুলিশ ওকে লক আপে রেখে দিয়েছে । বলেছে লক আপে থাকলে তুমি বাঁচবে ।
তারপর সন্ধ্যে নামতে নারকেল ডাঙ্গা থানা থেকে এস আই রত্না সরকার এল আমার কাছে । বলল ছোট ছেলের চিকিৎসা হবে বড় হাসপাতাল অ্যাপোলোতে । এই কাগজটাতে সই করে দিন । সাদা কাগজে সইটাও করে দিলাম । তখন বাজে সাত’টা । মা’র মন তো । ভাবছি যদি ছেলেটা আমার বেঁচে ওঠে । দুপুর আড়াইটেতে যাকে চোখের সামনে মরতে দেখেছি । গলায় ফাঁস বেঁধে, মাথা থেঁতলে রক্তে ভেসে যেতে দেখেছি যাকে । সেই আমার অভিজিৎ টা যদি বেঁচে ওঠে ! সেই আশায় থেকেছি ।
তারপর ১৩০ দিন বাদে দেহটা এল বাড়িতে । প্লাস্টিকে মুড়ে । মুখটাও আর দেখতে পেলাম না ।
বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়লেন শীতলা তলা লেনের বৃদ্ধা । বড় ভাই তখন গলির চাতালে ভাইয়ের শ্রাদ্ধ মন্ত্র উচ্চারণ করছেন কাঁপা কাঁপা গলায় ।
আজ এই দৃশ্য দেখলাম, শুনলাম কাঁকুরগাছির গলিতে দাঁড়িয়ে । উৎসবের আনন্দে খুন হওয়া অভিজিতের পার্টি অফিসে রাখা কুকুর বাচ্চা গুলোকেও মেরে দিয়ে গেছে মমতা ভক্তরা । সেই বাচ্চা গুলোর মা টাও আজ করুন চোখে বসে আছে অভিজিতের শ্রাদ্ধ বাসরে । সেও সন্তান হারা ।
ওদিকে নারকেল ডাঙ্গা থানার ওসি প্রমোশন পেয়ে বদলি হয়েছেন । রত্না সরকার সাসপেন্ড হন নি, বহাল তবিয়তে বসে আছেন থানায় ।
বৃদ্ধা মা এখনোও কেঁদে চলেছেন । অভিজিতের সেবা পাওয়া রাস্তার কুকুরের খাবারের ব্যবস্থা করে চলেছেন দু বেলা । নিজে খাওয়া প্রায় ছেড়েই দিয়েছেন । বড় ভাই বিশ্বজিৎ দাঁতে দাঁত চেপে আইনি লড়াইটা লড়ছেন । চোখে তাঁর আগুন ।
ফিরে আসছি যখন বিশ্বজিতের চোখের কোণে জল । মা কে লুকিয়ে এখনও কেঁদে চলেছেন অঝোরে ভাইটার জন্য ।
ভবানীপুরের মানুষ দেখতে বা শুনতে পাচ্ছেন কি এই সন্তান হারা মায়ের কান্না ? তিনি, খুন হওয়া অভিজিতের মা তো এই বাংলারই “মা” !
সন্ময় বন্দ্যোপাধ্যায় ( ৯৮৩০৪২৬০৭৮)
লেখাটি উৎসর্গ করলাম এ বি পি আনন্দের সুমন দে, নিউজ ১৮ এর বিশ্ব মজুমদার, ২৪ ঘণ্টার মৌপিয়া নন্দীকে ।।