কথাটা দারুণ বিতর্ক তৈরি করেছে। জয়। শ্রীরামে’র সঙ্গে বাঙ্গালির সম্পর্ক দেখতে পাননি নোবেল পুরস্কার প্রাপ্ত ‘ভারতবত্ন’ বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক অমর্ত্য সেন। জয় শ্রীরাম’ নাকি আক্রমণাত্মক অন্যকে অত্যাচার করার জন্য তৈরি করা শব্দ। কথাটি কত দূর গ্রহণযোগ্য বলা কঠিন। করণ বঙ্গদেশের সঙ্গে রামচন্দ্রের সম্পর্ক কয়েক শতাব্দীর প্রাচীন। অধ্যাপক সেন কথাগুলি বলার পর প্রবল উৎসাহে পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতি ক্ষেত্রে অর্ধশিক্ষিত নেতা-নেত্রী থেকে সংবাদপত্রের মসীজীবী উচ্চশিক্ষিতরা ক্রোঙ্কারধ্বনি শুরু করেছেন। তারা তাকিয়ে দেখার দরকার বোধ করছেন না এই ‘জয় শ্রীরাম’ ধ্বনিটি সত্যিই অন্যকে অপর (outsider) করার ষড়যন্ত্র কিনা।
ড. অমর্ত্য সেন নিশ্চয় রবীন্দ্রনাথের ব্যাখ্যায় সন্তুষ্ট হবেন। তার নামই তো কবিগুরু-প্রদত্ত! যখন তিনি লেখেন ‘রণজয়ী ক্ষত্রিয়েরা আর্যাবর্ত হইতে অরণ্যবাধা অপসারিত করিয়া পশু সম্পদের স্থলে,কৃষিসম্পদকে প্রবল করিয়া তুলিলেন, তখন রামায়ণের যে ব্যাখ্যা, যে ‘রণজয়ী’ রামচন্দ্রকে দেখানো হলো, তিনি কি অধ্যাপক অমর্ত্য সেনের তীব্র প্রতিবাদের লক্ষ্যই থেকে যাবেন? ‘উদ্বোধন’ পত্রিকার আশ্বিন ১৩৪৫ বঙ্গাব্দের একটি প্রবন্ধ ‘রাম ও তাঁহার চরিত্র’ দেখলে সারা দেশে শ্রীরামচন্দ্রের চরিত্রকথা কেমন করে ছড়িয়ে পড়েছে তা তিনি দেখতে পেতেন। বলে রাখি লেখাটি তার মাতামহ ক্ষিতিমোহন সেন শাস্ত্রী বিরচিত। এই ভারত কেন সমগ্র দক্ষিণ এশিয়ায় ছড়িয়ে পড়া রাম কাহিনির প্রতিপত্তি সম্পর্কে ক্ষিতিমোহন সেনের পূর্ণ ধরণা ছিল। তার ভাষা : ‘ব্রহ্মদেশ, শ্যামদেশ, কাম্বোডিয়া, যবদ্বীপ, বালিদ্বীপ প্রভৃতি স্থানে রামায়ণের বহুবিধ রূপ পাওয়া যায়। যবদ্বীপের মন্দিরে ও লোকমধ্যে যে রামায়ণ কথা আছে তাহা ৫টি কাব্যের সঙ্গে মেলে। বঙ্গদেশ ভারতের পূর্ব সীমায়। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় রামের জয়ধ্বনি এদেশকে সম্পূর্ণ এড়িয়ে— তাম্রলিপ্ত বন্দর বাদ দিয়ে নিশ্চয় পৌঁছয়নি! যুক্তিবাদী মহাপণ্ডিত অধ্যাপক সেন কী বলেন?
বঙ্গদেশে রামচন্দ্র দশ অবতারের অন্যতম। একাদশ শতকে বাদাল, ধামোর হাট, নওগাঁও-রাজশাহীতে দশাবতারে রামচন্দ্র স্বাভাবিক ভাবেই আছেন। দশম শতাব্দীতে ধরমপুর দক্ষিণ দিনাজপুরে মিলেছে আরেকটি দশাবতার মূর্তি। দ্বাদশ শতাব্দীতে পরিসন, ভানোর রাজশাহীর দশাবতার মূর্তি ও উল্লেখযোগ্য। একাদশ শতাব্দীতে সোনারং, মুন্সিগঞ্জ, ঢাকায় মিলেছে রামচন্দ্রের ধনুর্ধর অপূর্ব মূর্তি। বলে রাখি এই মূর্তিটি পাওয়া গেছে অধ্যাপক সেনের পূর্বপুরুষদের গ্রামের কাছাকাছি। গণেশপুর, মণ্ডা, নওগাঁ-রাজশাহীতে প্রাপ্ত ত্রয়োদশ শতাব্দীর রাম-লক্ষ্মণ-সীতা-মূর্তি অপূর্ব। মানুষ স্বভাবতই বিস্মরণশীল। মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী লিখেছেন ‘বাঙ্গালি ইতিহাস বিস্মৃত জাতি। রামের নামে জয়ধ্বনি বঙ্গদেশে বহিরাগত হলে এসব মূর্তি এল কী করে? গড়লেন কারা?
খ্রিস্টীয় ৬ষ্ঠ-৭ম শতাব্দীতে ভট্টি কাব্য জনপ্রিয় হয়। কাব্যটির নাম রাবণবধ’, তবে তা ভট্টি কাব্য নামেই বেশি পরিচিত ছিল। কবির পরিচয় ভালো মতো জানা যায় না। এই কাব্য বঙ্গদেশে ব্যাপক ভাবে পরিচিত ছিল। তৃতীয় শতাব্দীতে ভাসের প্রতিমা নাটক’ও ‘অভিষেক নাটক’ রামচরিত্র কেন্দ্রিক। সপ্তম শতাব্দীতে ভবভূতি লেখেন ‘মহাবীর চরিত’ আর ‘উত্তর রামচরিত’। ঊনবিংশ শতাব্দীর বঙ্গভাষীরা এই দ্বিতীয় নাটকটির প্রতি বিশেষ ভাবে আকৃষ্ট হয়েছিলেন। বিদ্যাসাগর মহাশয় উত্তর রামচরিতের অংশ বিশেষ সহজ স্বচ্ছন্দ বঙ্গানুবাদ ‘সীতার বনবাস’নামে প্রকাশ করেন। ১৮৬২-র সেই গ্রন্থ অবলম্বনে বাঙ্গালা ভাষায় কিছু রচনা ছাপা হয়। ১৮৬৫-তে উমেশচন্দ্র মিত্র এর নাট্যরদপ দেন। ১৮৬৬-তে কেদারনাথ গঙ্গোপাধ্যায় লেখেন, “সীতার বনবাস’-নাটক। ১৮৬৮-তে রাসবিহারী মুখোপাধ্যায় একই গ্রন্থনির্ভর একটি গদ্য আখ্যান লেখেন। ১৮৮৮-তে গিরিশচন্দ্র ঘোষ লেখেন “সীতার বনবাস’। সেটি বঙ্গ রঙ্গমঞ্চে অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়েছিল।
নবম শতাব্দীতে অভিনন্দ রচনা করেন ‘রামচরিত’। এখানে রাবণ বধের কামনায় দুর্গার অকাল বোধনের কথা লেখা হয়েছে। তবে পূজা দিয়েছেন সঙ্কটমোচন রামচন্দ্র। এই গ্রন্থ বঙ্গদেশে রচিত প্রাচীনতম রামায়ণ-নির্ভর নাটক। ১০ম-১১শ শতাব্দীতে সন্ধ্যাকর নন্দী লিখেছিলেন রামচরিত’। এই রচনা রূপকধর্মী। কৈবর্ত বিদ্রোহের সময় সন্ধ্যাকর নন্দী তার পোষক পাল রাজা রাম পালকে নায়ক করে এই কাব্য লেখেন। বিদ্রোহের সময় সাময়িক ভাবে রামপাল রাজলক্ষ্মীকে হারিয়ে ফেলেন। ঘটনাটি সীতা হরণ ও রাবণ বধের কাহিনিতে রূপান্তরিত করে আশ্চর্য দক্ষতায় লেখেন সন্ধ্যাকর নন্দী। রামকথা বঙ্গদেশে জনপ্রিয় না থাকলে ওই লেখা সম্ভব হতো না।
পঞ্চদশ শতাব্দীতে আবির্ভূত কৃত্তিবাস ওঝা রামায়ণের জনপ্রিয় বঙ্গানুবাদ ‘শ্রীরাম পাঁচালি’ রচনা করেন। তাঁর রচনায় বহু জানা না জানা কবি ও গায়েনদের রচনা ঢুকে পড়েছিল। সামান্য কয়েকজনের নাম লিখছি। কৃষ্ণদাস রচিত ‘রামনাম উপাসনা’র পুঁথি লেখা হয় ১৭১৭ শকাব্দে (১৭৮৫ খ্রিস্টাব্দে); পঞ্চানন চক্রবর্তী লেখেন ‘রামরসায়ন’, নটবর দত্ত লেখেন ‘রামজন্ম পালা’, অদ্ভুতাচার্যের ‘অযোধ্যা-অরণ্য-আদি-উত্তরাকাণ্ডে’র বহু পুঁথি পাওয়া গেছে, অখণ্ডদাস বা অনন্ত পণ্ডিত, অনন্তরাম দ্বিজের বহু রামায়ণ পালা পাওয়া গেছে। উৎসবানন্দ লিখেছিলেন, ‘লবকুশ যুদ্ধ’ ,‘সীতার বনবাস’,কংসারি পণ্ডিত, কণ্ঠমণি দাস, কণ্ঠহার দ্বিজ ছিলেন বিখ্যাত রামায়ণ গায়ক। কবিচন্দ্র দ্বিজ ছিলেন বিষ্ণুপুর রাজসভার কবি। তিনি বিষ্ণুপুরী রামায়ণ’ লিখেছেন সপ্তদশ শতাব্দীর শেষ দিকে। কমললোচন দত্ত, কল্যাণ দে, কালিদাস, কালীকিঙ্কর দেবদাস, কালীচরণ ভট্ট, কুমুদ দত্ত, কেশব মিত্র, কৈলাস বসু, খোসাল শর্মা, গঙ্গাদাস সেন, গৌরীকান্ত, ঘনশ্যাম, চন্দ্রকিশোর দাস, জগৎবল্লভ, জগন্নাথ দাস, জয়চন্দ্র নরপতি, জীবন চক্রবর্তী, তিলকচন্দ্র আচার্য, দয়ারাম, দুর্গাচরণ দ্বিজ, দুর্লভ দ্বিজ, দুলাল দ্বিজ, দেবানন্দ দ্বিজ, দেবীদাস, দেবীনন্দন, ধনঞ্জয় দ্বিজ, ধর্মদাস, নারায়ণ দাস, নিধিরাম দ্বিজ, পঞ্চানন দ্বিজ, প্রসাদ দাস, ফকিররাম কবিভূষণ, বংশীমোহন, ব্রহ্মাসুন্দর দ্বিজ, ভবানন্দ, ভবানী দাস, রামপ্রসাদ, রামমোহন, রামশঙ্কর, রামানন্দ ঘোষ, রামানন্দ যতি, রুদ্রসেন শর্মা, লক্ষ্মণ দ্বিজ, লক্ষ্মীরাম, লোকনাথ সেন, শঙ্কর, শম্ভ সুত, শিবরাম, শ্যামাচরণ খাস্তগির, শ্রীধর বানিয়া, ষষ্ঠীচরণ মজুমদার, ষষ্ঠীধর সেনগুপ্ত, সঞ্জয়, সত্যানন্দ, সম্পদ রায়, সাফল্য দ্বিজ, হটুশর্মা, হরেন্দ্র নারায়ণ মহারাজা। সবার কথা লিখলে মহাকাব্য হয়ে যাবে। এর পরও বলা হবে রামচন্দ্র বঙ্গদেশে বহিরাগত!
তিনজনের কথা লিখে প্রসঙ্গ বদলাব। জগদ্ৰাম রায় বঙ্গদেশে বিশেষ ধরনের রামভক্তিবাদ প্রচার করেন। তিনি দামোদরের দক্ষিণে মেজিয়ার নিকটবর্তী আধগাঁ-ভুলুই গ্রামে বাস করতেন। তিনি ও তার পুত্র রামপ্রসাদ রচনা করেন রামায়ণ’আর ‘দুর্গা পঞ্চরাত্রি’(সর্বপ্রাচীন পুঁথি ১৭৭১ খ্রি:)। রামচন্দ্রের অকাল বোধনের তাত্ত্বিক কাঠামো এই শেষোক্ত গ্রন্থে স্পষ্ট। প্রকৃত সত্য হলো কৃত্তিবাসী রামায়ণে অকালবোধন প্রসঙ্গ প্রক্ষিপ্ত হয়েছে। রাম ভক্তিবাদের ব্যাপক জনপ্রিয়তার পরে এই বিষয়টি রামায়ণের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে থাকবে। জগদ্ৰাম রায় প্রতিষ্ঠিত দুর্গোৎসব রায় বঙ্গের একটি ব্যতিক্রমী উৎসব।
‘চন্দ্রাবতী’ রামায়ণ পাওয়া গেছে পূর্ববঙ্গে। পিতা দ্বিজ বংশী দাস। চন্দ্রাবতী মধ্যযুগের প্রথম মহিলা কবি। তাঁর রচনা ছোটো। আর এই রামায়ণটি অধ্যাপক অমর্ত্য সেনের পূর্বপুরুষের বাড়ির কাছে মোটামুটি জনপ্রিয় ছিল।
বরেন্দ্র অনুসন্ধান সমিতি, রাজশাহীতে সংগৃহীত আছে ছাদেক আলীর রামায়ণ। ‘রামচন্দ্রের বনবাস’ লিখেছিলেন তিনি। এটি সংগ্রহ করেন আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদ। পুঁথিটি অসম্পূর্ণ। ভণিতায় আছে ‘শ্রীরামের বনবাস…ছাদেক আলি কহে।কেন ছাদেক আলি রামায়ণ কথা লিখলেন? আসলে বঙ্গদেশে মুসলমানরা প্রথমদিকে ওয়াহাবি বা ফরাজি ভাবাদর্শে বিশ্বাসী ছিল না। তারা দেশীয় সংস্কৃতির ধারাবাহিকতাকে অস্বীকার করেনি।
কালের বিচারে পূর্ব ভারতে রামায়ণের প্রভাব পড়েছে তুলসী দাসের ‘রামচরিত মানস’ রচনার বহুপূর্বে। কৃত্তিবাসের ‘রাম পাঁচালী’রচিত হয় দেড়শো বছর আগে। চতুর্দশ শতাব্দীতে রচিত তার কাব্য। একই কথা অসম ও ওড়িশায়। অসমীয় ভাষায় চতুর্দশ শতাব্দীতে লেখা হয় দুর্গাবরের ‘গীতরামায়ণ। মহামাণিক্য মাধব কন্দলীর রামায়ণ — এটিও সমসাময়িক। মহাপুরুষিয়া মতের শঙ্করদেব গদ্যে রামায়ণ অনুবাদ করেন সপ্তদশ শতাব্দীতে। তিনি ‘রামবিজয় নাটকও রচনা করেন। শঙ্করদেবের শিষ্য মাধব দেব, তিনি রামায়ণের আদিকাণ্ড অনুবাদ করেছিলেন। ওড়িয়া ভাষায় বলরাম দাসের রামায়ণ ‘জগমোহন রামায়ণ’ বা ‘দণ্ডী রামায়ণ’ নামে পরিচিত। বিশিষ্ট ওড়িয়া সাহিত্যিক ফকিরমোহন সেনাপতি গত শতাব্দে পদ্যচ্ছন্দে সম্পূর্ণ রামায়ণ রচনা করেছেন। এর পরও পণ্ডিত আর মূখ এক কাতারে দাঁড়িয়ে রাজনীতির কারণে রামনামের বিরোধিতা করবেন ?
বঙ্গদেশের রামভক্তিবাদের ইঙ্গিত পাওয়া যায় শ্রীচৈতন্যের পরিব্রাজক জীবন কথায়। তার সহপাঠী মুরারি গুপ্ত ছিলেন রামভক্ত। নিজেকে ভাবতেন হনুমান। তিনি গৌরাঙ্গকে কৃষ্ণাবতার ভেবে আত্মদ্বন্দ্বে আত্মহত্যায় উদ্যত হন। গৃহদেবতা রামকে অসম্মানও করতে পারেন না, অথচ প্রত্যক্ষ ‘অভিনব হেম কল্পতরু’ অবতীর্ণ কৃষ্ণকেও অসম্মান করবেন কি করে !শ্রী গৌরাঙ্গ তাকে গঙ্গাকূলে রামরপে দেখা দিলেন। বললেন, ত্রেতায় তিনিই দশানন রাবণকে পরাস্ত করেছিলেন!
মুরারি দেখয়ে রঘুনাথ পরতেক।।
দূর্বাদল শ্যাম দেখে সেই বিশ্বম্ভর।।
বীরাসনে বসিয়াছে মহাধনুর্ধর।।
জানকী লক্ষ্মণ দেখে বামেতে দক্ষিণে।
চৌদিকে করয়ে স্তুতি বানরেন্দ্র গণে।।
এসব রচনা বঙ্গদেশের ঘরে ঘরে প্রচলিত। নাগরিক মতিছন্ন বিদেশি ভাবাদর্শের তারা ধার ধারেন না। শ্রীচৈতন্য সন্ন্যাস যাত্রার সময় রামনাম নিয়েই পর্যটন শুরু করেছিলেন— সেকথা কি এইসব প্রগম্ভ সবজান্তারা জানেন? তিনি বলে চলেন : রাম রাঘব রাম রাঘব রাম রাঘব রক্ষমাম্।
কৃষ্ণ কেশব কৃষ্ণ কেশব কৃষ্ণ কেশব পাহিমাম্।।
শ্রীরাম ও শ্রীকৃষ্ণকে পৃথক করা অন্যায়, শ্রীরামকে বঙ্গদেশে বহিরাগত বলা চরম অপরাধ।
শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের গৃহদেবতা রঘুবীর, একথা ভুলে যেতে হবে? তাঁর স্বহস্ত লিখিত রামায়ণ কথার পুঁথি—‘যোগাদ্যার পালা’ ‘সুবাহুর পালা’র কথা ভুলে যেতে হবে? ভুলে যাব সদ্য-উপবীত সংস্কার হওয়া গদাধর চট্টোপাধ্যায় লিখেছেন ‘মহীরাবণ পালা’? ‘সুবাহুর পালা’র শেষে আছে :
শ্রী গদাধরকে বর দিবে ওহে গুণনিধি।
কল্যাণে রাখিবে রাম তোমায় নিবেদি।।
এসব কথা না জানা অজ্ঞতা। আর তাকেই উপদেশের বিষয় করা অজ্ঞানের আস্ফালন ছাড়া কী বলব?
বঙ্গদেশের নানা প্রান্তে ৩৫টি তারিখযুক্ত রামমন্দির থাকা সত্ত্বেও রামকে বরিরাগত বলার পিছনে যুক্তি ও বিবেচনার সীমা পরিসীমা নেই।
বাঙ্গালির নামে রাম-সীতার অভাব নেই। জনমদুখিনী সীতার নাম দেবার প্রবণতা একটু কম, তা থেকেও বোঝা যায় রামায়ণ আমাদের কতখানি প্রভাবিত করেছে। রবীন্দ্রনাথ রামায়ণ-সংস্কৃতির দ্বারা নিষ্ণাত ছিলেন। তার মনে হয়েছিল ‘রামায়ণ’ ঘরের কথাকে বড়ো করে তুলে ধরেছে। কৃত্তিবাসের রাম ‘ভক্তবৎসল রাম’। শুধু কি তাই, বহু কবিতায় রবীন্দ্রনাথের ভাবনা রাম-নির্ভর। বাল্মীকি প্রতিভা’ নাটকে রামায়ণ কথা প্রত্যক্ষ। ‘রক্তকরবী’র কাহিনি ব্যাখ্যায় রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, যক্ষপুরীর রাজা ‘এক দেহে রাবণ ও বিভীষণ’।
শেষ করব বর্ধমান জেলার দক্ষিণ দামোদরের কৃষ্ণপুর গ্রামবাসী ধর্মমঙ্গলের কবি ঘনরাম চক্রবর্তীর ভণিতায় পাওয়া একটি পুঁথির কথা বলে। এক দুপুরে কবি বসে আছেন। এক। অসাধারণ সুদর্শন যুবক এলেন। জানতে চাইলেন জগন্নাথের পুরী কোন দিকে? ঘনরাম দেখিয়ে দিলেন। তারপর এক অপূর্ব সুন্দরী গৃববধূ এলেন। তিনিও একই প্রশ্ন করলেন। ঘনরাম পুরুষোত্তম তীর্থের পথ দেখিয়ে অপার্থিব এই দিব্য সৌন্দর্যে ঘনরামের মন পবিত্রভাবে বিহুল হলো। আবার এক স্বর্ণাভ রূপবান যুবক এলেন— একই প্রশ্ন করলেন। যন্ত্রবৎ ঘনরাম দেখালেন জগন্নাথের পথ। এবার এক হনুমান এলে ঘনরাম তাকে দেখে প্রশ্ন করলেন, আপনি নিশ্চয় বজাঙ্গলী রামভক্ত হনুমান। স্মিত হাসলেন হনুমান— কেন? সামনে যাঁরা গেলেন তারা নিশ্চয় শ্রীরাম সীতা আর শ্রী লক্ষুণ! হায় হায় করতে থাকলেন তিনি। হনুমান তাকে মৃদু তিরস্কার করে চলে গেলেন। আজকের পশ্চিমবঙ্গে রামচন্দ্র সম্পর্কে যাঁরা অজ্ঞতা প্রকাশ করছেন তাদের জন্য এই রূপক-কাহিনিটি হয়তো কোনো অন্য অর্থ ও তাৎপর্য বহন করবে।
ড. অচিন্ত্য বিশ্বাস

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.