এই যন্ত্রের মন্ত্রে চলিত দুনিয়ায় যখন প্রায় হাঁপিয়ে উঠি তখন যে ধ্যানমৌন অশ্বত্থ গাছটি আমাদের ক্লান্তি জুড়িয়ে দেয় সাহিত্যের আঙিনায় তাঁরই নাম বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়।
বিভূতিভূষণ প্রায় অধিকাংশ রচনাতেই প্রকৃতিকে মানব জীবনের সাথে একত্র, সম্পৃক্ত করে দেখিয়েছেন। কখনো বা এই প্রকৃতিকে আধ্যাত্মনুভূতির আধার রূপে চিত্রিত করেছেন। মানুষ–প্রকৃতি–ঈশ্বর তিনে মিলে বিভূতিভূষণের সাহিত্যলোক গড়ে উঠেছে। কল্লোল যুগের স্বভাবসিদ্ধ রক্তমাংস প্রাণের ত্রিধাতু মিশ্রিত শারীর শবাসনে না বসেও তিনি তাঁর সৃষ্টিতে যেন সুদূর স্বর্গলোকের অমৃতগন্ধ বয়ে এনেছেন।
বিভূতিভূষণের সার্থকতম রচনা তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘পথের পাঁচালী’ (১৯২৯)। অপুর জীবনের পথ চলার কাহিনীই পথের পাঁচালী। আসলে উপন্যাসটাই মুগ্ধমনের যাত্রাপথের কাহিনী। জীবন পথের বিচিত্র আনন্দযাত্রার অদৃশ্য তিলক ললাটে এঁকে পথের আহ্বানে অপু এগিয়ে চলবে– এই আশ্বাসে পথের পাঁচালীর সমাপ্তি। এখানে দুর্গাকে লেখক প্রকৃতির সারল্য – মুক্তি ও আনন্দের প্রতিমারূপে উপস্থাপিত করেছেন। ইন্দিরা ঠাকুরণ প্রাচীনকালের প্রতিনিধি। হরিহর স্বপ্ন-বিলাসী, বাস্তববিমুখ, সংসারউদাসীন, ভ্রাম্যমান কথক। জীবনকে লেখক স্বীকার করেছেন এবং তার মাঝে স্থাপিত করেছেন অপুকে-
“এই অল্প বয়সেই তাহার মনে বাংলার মাঠ, নদী, নিরালা বন প্রান্তরের সুমুখ জ্যোৎস্না রাত্রির যে মায়ারূপ অঙ্কিত হইয়া গিয়াছিল, তাহার উত্তরকালের শিল্পী জীবনের কল্পনা মুহূর্ত গুলি মাধুর্য্যে ও প্রেরণায় ভরিয়া তুলিবার তাহাই ছিল শ্রেষ্ঠ উপাদান।”
পরবর্তীকালে রানুদিকে ও লীলাকে স্নেহ ও ভালোবাসার ভান্ডার রূপে পেয়েছে অপু। অপরদিকে পেয়েছে নিশ্চিন্দিপুরের গ্রাম প্রকৃতির প্রতিনিধি সর্বজয়ার মাতৃস্নেহ। একদিকে মৃত্যু, অপরদিকে জীবনের অঙ্গীকার-এই দুইয়ে মিলে ‘পথের পাঁচালী’।
পথের পাঁচালীর অপুর জীবন বৃত্ত সম্পূর্ণ হয়েছে ‘অপরাজিত’ (১৯৩২)-তে। এখানে অপু উপলব্ধি করেছে প্রকৃতি বিযুক্ত জীবন কত ভয়ঙ্কর, নির্মম ও শ্রীহীন। ‘অপরাজিত’-র জীবন জটিল ও বহুমুখী। এখানে অপু তার মায়ের প্রতীক রূপে অপর্ণাকে পেয়েছে, আবার হারিয়েছে। তাই বহির্বিশ্বে বন্ধন মুক্ত জীবন পথিক অপু এবার চলল অজানা দেশের পথে। জীবনের চলমানতা, প্রবাহমানতা, অবিচ্ছিন্নতার প্রতিনিধি অপুর ছেলে কাজল রানুদির কাছে রয়ে গেল-
“চব্বিশ বৎসরের অনুপস্থিতির পর অবোধ বালক অপু আবার নিশ্চিন্দিপুরে ফিরিয়া আসিয়াছে।”
পথের পাঁচালী এবং অপরাজিত ছাড়া বিভূতিভূষণের তিরিশের দশকের আর দুটি উপন্যাস হল – “দৃষ্টিপ্রদীপ’ (১৯৩৫), ‘আরণ্যক’ (১৯৩৯)। দৃষ্টিপ্রদীপ উপন্যাসের সাংসারিক রূঢ়তায় তার হাতে রূঢ়তার তালিকা প্রণয়ন হয়ে গেছে। মাঝে মাঝে অপ্রাকৃত দৃষ্টি শক্তির আলোকেও সে রূঢ়তা জনিত রসাভাসকে উত্তীর্ণ হতে পারেননি লেখক।
আরণ্যক উপন্যাসটি সম্পূর্ণ নতুন প্রকৃতির। প্রকৃতি এখানে মুখ্য, মানুষ গৌণ। সত্যচরনের দেখা এই প্রকৃতি কখনও পরি রাজ্যের মায়াময়, অপার্থিব স্বপ্ন সৌন্দর্য, কখনও প্রেতলোকের বিভীষিকায় আচ্ছন্ন। এই উপন্যাসটিতে লেখকের Cosmic Imagination স্ফূরিত হয়েছে। আদিম অরণ্য জাতির সংস্পর্শ একদিকে যেমন বন্য মহিষের রক্ষাকর্তা, ট্যাঁড়বারো দেবের কল্পনাকে রূপ দিয়েছেন, অন্যদিকে তেমনই যুগ-যুগান্ত প্রসারিত তাঁর ঐতিহাসিক কল্পনাকে প্রবুদ্ধ করেছে। আসলে এসবের পিছনে আছে বিভূতিভূষণের শিল্পী মন-
“দিকচক্রবালে দীর্ঘ নীল রেখার মত পরিধির সমান এই পাহাড় ও বন দুপুরে, বিকালে, সন্ধ্যায় কত স্বপ্ন আনে মনে।”
আরণ্যকের প্রাণ অরণ্য। তাই অরণ্যের মানুষ ভানুমতী ও দোবরুপান্না যেন অরণ্যের সৌন্দর্য ও মর্যাদার প্রতীক।
বিভূতিভূষণের চল্লিশের দশকের উপন্যাসগুলি হল-‘আদর্শ হিন্দু হোটেলে’ (১৯৪০), হোটেল পরিচলনার অতি জাগ্রত ব্যবসায়িক বুদ্ধির একটি সরস ও উপভোগ্য চিত্র আঁকা আছে। ‘বিপিনের সংসার’ (১৯৪১) উপন্যাসে নরনারীর প্রেমের চিত্র উপস্থাপিত করেছেন, যা তাঁর স্বভাব বিরুদ্ধ। তাই এ উপন্যাসে তিনি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেননি। ‘দুই বাড়ি’ (১৯৪১) এই ধরণেরই উপন্যাস। প্রতিদিনের জীবনের মধ্যে যে রোমান্সের রস এবং ইন্দ্রিয়াতীত উপলব্ধির রহস্যময় ব্যঞ্জনা রয়েছে বিভূতিভূষণ তার প্রতি তর্জনী তুলেছেন ‘দেবযান’ (১৯৪৪) উপন্যাসে। এই আধ্যাত্মিকতা প্রধান স্থানাধিকার করেছে ‘কেদাররাজা’ (১৯৪৫) উপন্যাসে। এই কালপর্বে লেখা ‘অনুবর্তন’ (১৯৪২), ‘অথৈজল’ (১৯৪৭) উপন্যাস দুটি উপন্যাস হিসাবে ততটা সার্থক নয়।
বিভূতিভূষণের শেষ জীবনে রচিত দুটি উপন্যাস হল-‘ইছামতী’ (১৯৫০), ‘অশনি সংকেত’ (মৃত্যুর পর প্রকাশিত, ১৯৫৯)। প্রকৃতি প্রেম, জীবনের প্রতি অনুরাগ আর সেই সঙ্গে গভীর ঈশ্বরপ্রেম তিনে মিলে সৃষ্টি হয়েছে ‘ইছামতী’। উপন্যাসের নায়ক পরিব্রাজক ভবানী বাঁড়ুয্যে গৃহী হয়েছে। কিন্তু তার অন্তরে যে অধ্যাত্মপিপাসা তা নষ্ট হয়নি। আসলে বিভূতিভূষণ এক অধ্যাত্মবিশ্বাসী, আদর্শবাদী শিল্পী। যিনি প্রকৃতি মুগ্ধতায় এবং গ্রাম জীবন ও পূর্বতন পারিবারিক জীবনের সারল্যে বিশ্বাস করেন। ‘ইছামতী’ সে বিশ্বাসের ছবি।
প্রকৃতি, মানুষ, ঈশ্বর-এই তিনটি স্তম্ভে বিভূতিভূষণের সাহিত্যলোক গঠিত। তাই তিনি লেখেন-
“ভবনী বাঁড়ুয্যে মুগ্ধ হয়ে ভাবেন কোন মহাশিল্পীর সৃষ্টি এই অপূরূপ শিল্প, এই শিশুও তার অন্তর্গত।”
বিভূতিভূষণ মহাকাব্যধর্মী আখ্যান নির্মাণে আগ্রহী ছিলেন। কিন্তু গঠনের নিরিখে তাঁর সব উপন্যাসই বহুলাংশে টুকরো কথার মালা গাঁথা-এপিসোডিক।
সাধারণভাবে তাঁর ভাষা বহুলাংশে বিবৃতিধর্মী বা Narrative।
বিভূতিভূষণের স্বপ্নে কখনও অতি রোমান্টিক, কখনও বা Mystic ধূসরতা লক্ষণীয়। অন্যপক্ষে তাঁর বস্তু চিত্রণে Naturalist-এর কঠোর, কঠিন, তাথ্যিক পরিকাঠামো লক্ষণীয়।
বিভূতিভূষণ বেদনার্ত প্রেমের রূপকার নন। তাই তিনি কল্যাণ কামনার পথে নারী প্রেমের উত্তরণ ঘটিয়েছেন।
রোমান্স তাঁর উপন্যাসে ভিড় করেছে।
বিভূতিভূষণ আমাদের পৃথিবীর অকিঞ্চিৎকর গাছপালা, ফলমূল, ধূলোমাটির উপকরণ নিয়ে আপন চৈতন্যের অলৌকিক শক্তি মাধুর্য্য মণ্ডিত করে সৃষ্টি করেছেন তাঁর সাহিত্যলোক। সারল্য ছিল তাঁর রচনার সাধারণ শৈলী। তাই প্রেয়সী নারীর প্রেমও তাঁর রচনায় প্রাকৃতিক পুষ্প-পত্রের মতই সহজ ও স্বয়ংপুষ্ট। আবার তিনি ছিলেন কল্লোল যুগের আঙ্গীক সচেতন, জীবন জটিলতায় ভারাক্রান্ত এক আনমনা পথিক। তিনি স্বপ্নলোকের ভারহীন স্বাদ আর অধরা সুরভিতে সমগ্র চেতনাকে খুশিতে ভরে বিদায় নিয়েছেন। আর তাই তিনি বিশ শতকীয় জীবনের পঙ্কপল্বলে মানব সরোবরের শিল্পদূত।