বিজ্ঞান ও সাংস্কৃতিক আগ্ৰাসনের সূচনা
একথা আজ প্রতিষ্ঠিত সত্য যে আধুনিক ইতিহাসের গতি প্রকৃতি কয়েক শতাব্দীর ঔপনিবেশিকতার দ্বারা প্রভাবিত। আমরা পৃথিবীকে এমনকি নিজের দেশকেও যেভাবে দেখি বা দেখতে বাধ্য হই তা অনেকটাই নির্ভর করে পশ্চিমীয় জ্ঞানের উপর।
অনেকে বলেন উপনিবেশ স্থাপনের মাধ্যমে ইউরোপ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়েছিল বলেই আজ বিভিন্ন সভ্যতার মধ্যে সাংস্কৃতিক আদান প্রদান সম্ভব হয়েছে , ‘বিশ্বায়ন’ সম্ভব হয়েছে। উৎকৃষ্ট দর্শন কে যুক্তির মাধ্যমে মেনে নিয়ে বিজয়ী শক্তির বিজিতের সাংস্কৃতিক ধারাকে সুগম করার নিদর্শন ইতিহাসে বিরল।
বরং বিশ্বের ইতিহাসে বিজয়ীর পরাজিত শক্তির জ্ঞান-বিজ্ঞান , সংস্কৃতির গতি অবরুদ্ধ করার উদাহরণ প্রচুর। বিপক্ষের যুক্তি কে মান্যতা দেওয়ার উদারতা , সেই মহত দর্শন ভারতবর্ষের বাইরে কি কখনো উচ্চারিত হয়েছে ?
পুরাতন সভ্যতাগুলির রুদ্ধদ্বার ইউরোপীয় শক্তি ভেঙ্গে দিয়ে আধুনিকতার যুগ এনেছে– এ কথা কতটা সত্য ? আর ঘরে যদি অন্ধকার থাকে , বাইরের আলোর জন্য জানালা ভেতরের প্রয়োজনেই ভেতর থেকে খুলে দেওয়া হয় —- বাইরের তীব্র ঝোড়ো হাওয়া জানালা ভেঙে ঘরে প্রবেশ করলে তা ভেতরের প্রয়োজন না মিটিয়ে ঘরের পরিবেশকেই বিষম করে তোলে।
পৃথিবীর সমস্ত সংস্থা , শিক্ষার পাঠ্যক্রম , রাজনৈতিক , সামাজিক সমস্যা কে বোঝা এবং সমাধানের দৃষ্টিভঙ্গি পশ্চিমের সভ্যতা দ্বারা প্রভাবিত।
অর্থনৈতিক উন্নতি বলতে আজ আমরা যা বুঝি তা ইউরোপীয় দর্শন।উন্নয়নশীল দেশ যে সময়ে ইউরোপীয় চিন্তায় অর্থনৈতিক উন্নতিতে একটু অগ্ৰসর হয় , উন্নত দেশগুলো অর্থনৈতিক উন্নতির অন্য এক উচ্চতর সোপানে পৌঁছে যায় এবং এই দৌড় চলতেই থাকে।এই ইউরোপীয় অর্থনৈতিক উন্নতির তত্ত্ব উন্নয়নশীল দেশের নিজেদের জীবন পদ্ধতিকে হীন দৃষ্টি তে ভাবতে শেখায় এবং ইউরোপীয় জীবন পদ্ধতিকে আদর্শ হিসেবে তুলে ধরে।চিন্তার জগতে এ একধরনের ঔপ্যনিবেশিকতা নয় তো কি ?
তাই এই মুহূর্তে বিভিন্ন সামাজিক , রাজনৈতিক সংস্থা সর্বোপরি শিক্ষাঙ্গন এবং শিক্ষার বিষয়ের উপর ঔপ্যনিবেশিকতার প্রভাব জানা সবথেকে বেশি জরুরি যদি আমরা সেই প্রভাব থেকে মুক্ত হতে চাই।
বাণিজ্যিক স্বার্থে ও নিজেদের সংস্কৃতি , উপাসনা পদ্ধতি ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য ইউরোপের বিভিন্ন দেশের উপনিবেশ আমেরিকা , এশিয়া,আফ্রিকাতে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে প্রায় ৫০০ বছর আগে থেকে এবং তার পরের প্রায় ২০০ বছর স্থানীয় পুরাতন সভ্যতা , শিক্ষা, সংস্কৃতিকে ঔপ্যনিবেশিকতা ধীরে ধীরে গ্ৰাস করতে থাকে।
আমেরিকা ও অস্ট্রেলিয়া তে পুরাতন সভ্যতা সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস হয়ে যায়।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ‘ভারতবর্ষীয় সমাজ’ প্রবন্ধে উল্লেখ করেছেন…”আমেরিকা-অস্ট্রেলিয়ায় কি ঘটিয়াছে ? য়ুরোপীয়গণ যখন সেখানে পদার্পণ করিল , তখন তাহারা খ্রীস্টান , শত্রুর প্রতি প্রীতি করিবার মন্ত্রে দীক্ষিত । কিন্তু আমেরিকা-অস্ট্রেলিয়ার আদিম অধিবাসীদিগকে দেশ হইতে একেবারে উন্মুলিত না করিয়া তাহারা ছাড়ে নাই—- তাহাদিগকে পশুর মতো হত্যা করিয়াছে। আমেরিকা ও অস্ট্রেলিয়ায় যে নেশন বাঁধিয়াছে , তাহার মধ্যে আদিম অধিবাসীরা মিশিয়া যাইতে পারে নাই।”
দক্ষিণ আফ্রিকা , কঙ্গো তে ইউরোপিয়ানদের অধীনে কৃষ্ণাঙ্গরা অত্যাচারিত হয়।
ভারতবর্ষে ইংরেজরা ভারতবর্ষের আপন শিক্ষা পদ্ধতি পরিবর্তন করেছে যার মেকলীয় প্রভাব থেকে আমরা এখনো যে মুক্ত হতে পারি নি তা সর্বজনবিদিত। শিক্ষার মাধ্যমে নিজেদের সংস্কৃতি , উপাসনা পদ্ধতির প্রভাব বিস্তার করা হয়েছে বিভিন্ন পন্থায়।শিক্ষাক্ষেত্রের এবং শিক্ষার বিভিন্ন বিষয়ের এতো গভীরে ঔপ্যনিবেশিকতা প্রবেশ করেছে যে তা খুঁজে বের করাই একরকমের গবেষণা।
ঔপ্যনিবেশিকতার সুফল বলতে গিয়ে বলা হয় সমস্ত আধুনিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ইউরোপীয়দের অবদান। নিঃসন্দেহে আধুনিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ইউরোপীয় প্রভাব অনস্বীকার্য কিন্তু এর সুফল-কুফল নিয়ে আলোচনার কি প্রয়োজন নেই ?
ইউরোপের সাংস্কৃতিক আগ্ৰাসন পৃথিবীর পুরাতন সভ্যতাগুলোর শিক্ষা , সংস্কৃতি ও অন্যান্য যে ব্যবস্থাগুলো কে নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছে সেই পুরাতন শিক্ষা পদ্ধতিগুলো বিকশিত হওয়ার সুযোগ পেলে কি হতে পারতো বা যে শিক্ষা পদ্ধতি ও সামাজিক-রাজনৈতিক ব্যবস্থা কে ধ্বংস করে দেওয়া হলো ইউরোপের আধুনিকীকরণে তার কোনো অবদান আছে কি না সেই প্রশ্নের উত্তর কি খোঁজার চেষ্টা হয়েছে ? ঔপ্যনিবেশিকতার ফলে ইউরোপীয় দেশগুলো কি শুধুই জমি দখল করেছে না আরো অনেক কিছু পেয়েছে যা তারা অস্বীকার করে নিজেদের শ্রেষ্ঠত্বের দাবি কে বাচিয়ে রাখতে ?
আমাদের এ কথা মনে রাখা প্রয়োজন যে কোনো সভ্যতার জয়যাত্রা জ্ঞান , বিশেষত বিজ্ঞানের সমান্তরাল অগ্ৰগতি ছাড়া হতে পারে না।
এ দেশে ইংরেজরা ভারতবর্ষের সামাজিক , শৈক্ষিক , রাজনৈতিক ব্যবস্থা সম্পর্কে অধ্যয়ন করেছে ; ভারতীয় ভাষার ব্যাকরণ সম্পর্কে জেনেছে , প্রচুর সংস্কৃতে লিখিত বই এর অনুবাদ করেছে। ভারতবর্ষ কে জেনে শিক্ষাসহ সমস্ত ক্ষেত্রে ভারতীয় পদ্ধতিকে সরিয়ে ইউরোপীয় পদ্ধতির প্রসার করেছে । কেনো ?
কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘শিক্ষার বিরোধ’ প্রবন্ধের কিছু অংশ এই প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য….
“বস্তুতঃ, এ কথা বোঝা কি এতই কঠিন যে, বিজ্ঞানের যে শিক্ষায় মানুষ যথার্থ মানুষ হয়ে ওঠে, তার আত্মসম্মান জাগ্রত হয়ে দাঁড়ায়, সে উপলব্ধি করে সেও মানুষ, অতএব স্বদেশের দায়িত্ব শুধু তারই, আর কারও নয়,—পরাজিতের জন্য এমনি শিক্ষার ব্যবস্থা বিজেতা কি কখনও করতে পারে? তার বিদ্যালয়, তার শিক্ষার বিধি সে কি নিজের সর্বনাশের জন্যেই তৈরি করিয়ে দেবে? সে কেবলমাত্র এইটুকুই দিতে পারে যাতে তার নিজের কাজগুলি সুশৃঙ্খলায় চলে। তার আদালতে বিচারের বহুমূল্য অভিনয় করতে উকীল, মোক্তার, মুন্সেফ, হুকুম মত জেলে দিতে ডেপুটি, সব্ডেপুটি, ধরে আনতে থানায় ছোট-বড় পিয়াদা, ইস্কুলে ডুবালের পিতৃভক্তির গল্প পড়াতে দুর্ভিক্ষ-পীড়িত মাস্টার, কলেজে ভারতের হীনতা ও বর্বরতার লেকচার দিতে নখদন্তহীন প্রফেসার, আফিসে খাতা লিখতে জীর্ণ-শীর্ণ কেরানী,—তার শিক্ষাবিধান এর বেশি দিতে পারে এও যে আশা করতে পারে, সে যে পারে না কি আমি তাই শুধু ভাবি।”
‘শিক্ষা’ কে পরাধীন জাতি কে নিয়ন্ত্রণের এক পন্থা , তার সংস্কৃতি কে ধ্বংস করার এক মনস্তাত্ত্বিক হাতিয়ার হিসেবে প্রয়োগ সম্পর্কে সচেতন করতে তৎকালীন পরাধীন ভারতবর্ষে অনেকেই সোচ্চার হয়েছিলেন কিন্তু স্বাধীন ভারতবর্ষে এই নিয়ে চিন্তাভাবনা বিশেষ এগোয় নি।
‘শিক্ষা’র বিভিন্ন বিষয়ের মধ্যে ‘ইতিহাস’ এবং ‘বিজ্ঞান’ দুটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ‘ইতিহাস’ বিকৃত করে উপস্থাপিত করে কিভাবে একটি জাতির মনে তাঁর আপন সংস্কৃতি সম্পর্কে অবজ্ঞা ভরে দেওয়া যায় সে সম্পর্কে আলোচনা প্রায়শই হয় কিন্তু ‘বিজ্ঞান’ কে এবং ‘বিজ্ঞানের ইতিহাস’ কে ব্যবহার করেও যে পরাধীন জাতির সংস্কৃতি কে ধ্বংস করা যায় তা আমাদের কাছে অকল্পনীয়।
আজ এ কথা স্বীকার করতে হবে যে ‘বিশ্বায়ন’ হয়েছে ইউরোপীয় চিন্তার , ইউরোপীয় শিক্ষাপদ্ধতির এবং ইউরোপীয় ‘বিজ্ঞান’ এর। ইউরোপীয় ‘বিজ্ঞান’ কথাটি অনেককেই বিস্মিত করতে পারে , ‘বিজ্ঞান’ একটি সর্বজনীন বিষয় , তার আবার কোনো দেশ , কোনো সংস্কৃতির উপর নির্ভরতা কি থাকতে পারে ? ‘বিজ্ঞান’ যদি দেশ-কাল-পাত্রের উপর নির্ভরশীল না হয় তাহলে ‘বিজ্ঞান’ এর ক্ষেত্রে ‘আধুনিক’ বিজ্ঞান ও প্রাচীন ‘বিজ্ঞান’ এই প্রভেদ থাকে কেনো ?
ভারতীয় ‘গণিত’ প্রাচীন আর ইউরোপীয় ‘ম্যাথামেটিক্স’ আধুনিক ? ভারতবর্ষের রসায়ন ‘হিন্দু কেমিস্ট্রি’ ; জ্যোতির্বিজ্ঞান ‘হিন্দু এস্ট্রোনমি’ এবং গণিত ‘হিসাব-আল-হিন্দ’।
‘আধুনিক’ বিজ্ঞান এর সৃষ্টিকর্তা ইউরোপ এমনটি ভাবার কি কারণ ?
আমরা এ কথা প্রায়ই শুনে থাকি অমুক মতবাদ বা পদ্ধতি বিজ্ঞানসম্মত অর্থাৎ বিজ্ঞান আছে মানেই তার পেছনে একটা অকাট্য যুক্তি আছে। তাহলে কি এই আশঙ্কা মনে জাগতে পারে না যে , ইতিহাসের কোনো এক সময়ে কোনো মতবাদ , কোনো সংস্কৃতি কে মানবমনে জায়গা করে দিতে ‘বিজ্ঞান’ এর ‘সংজ্ঞা’ কেই পরিবর্তন করে দেওয়া হয়েছে সুবিধামতো ? এমন কি হয়েছে আপন সংস্কৃতির ছাঁচে ঢেলে ‘বিজ্ঞান’ কে বিশ্বের সামনে উপস্থাপন করা হয়েছে যাতে করে কোনো সভ্যতা- সংস্কৃতি ‘বিজ্ঞান’ এর নামে নিজেকে অবৈজ্ঞানিক মনে করে বদলে নিয়েছে ? ভারতবর্ষের দিকে তাকালে শেষ প্রশ্নের উত্তরটি পেতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়।
‘বিজ্ঞান’ কি তাহলে সাংস্কৃতিক আগ্ৰাসনের , আপন উপাসনা-পদ্ধতি (Religion) প্রসারের এক হাতিয়ার ? ‘বিজ্ঞান’ কে কি মনস্তাত্ত্বিক অস্ত্র হিসেবে প্রয়োগ করা হয়েছে ? যদি উত্তর হ্যাঁ হয় , তাহলে এ পদ্ধতির ইতিহাস আমাদের জানতে হবে , নাহলে এই আগ্ৰাসন থেকে মুক্ত হওয়া সহজ নয়।
আমাদের শেখানো হয়েছে ‘বিজ্ঞান’ বলতে আমরা আজ যা বুঝি তা ইউরোপের মস্তিষ্কপ্রসূত এবং ‘বিজ্ঞান’ এর যে কোনো বিষয়ের যাত্রা শুরু হয়েছিল গ্ৰীসে এবং কয়েক শতাব্দী পরে নবজাগরণের সময় ইউরোপে। কিন্তু এই দাবির স্বপক্ষে কি কোনো ঐতিহাসিক প্রমাণ আছে ?
‘বিজ্ঞান’ এর বিষয়গুলো পড়ার সময় বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আমাদের সামনে বিভিন্ন গ্ৰীক নাম চলে আসে যেনো গ্ৰীক সংস্কৃতিই পৃথিবীর সমস্ত জ্ঞানের জন্ম দিয়েছে এবং নবজাগরণের পরে ইউরোপে সেই জ্ঞান বিকশিত হয়েছে আর বাকি বিশ্বের জ্ঞান-বিজ্ঞান নিয়ে যেনো কোনো ধারণাই ছিল না।
ব্রিটিশ ম্যাথামেটিশিয়ান (Mathematician) Rouse Ball ‘A short account of history of mathematics’ এ বলেছেন ‘The history of mathematics can not with certainty be traced back to any school or period before…the.. Greeks….though all early races…know something of numeration….and…the elements of land-surveying ,yet the rules which they possessed were….founded only on …observation and experiment , and were neither deduced from nor did they form part of any science.
অর্থাৎ গণনা ও জমি জরিপ করার পদ্ধতি জানা থাকলেও পৃথিবীর অন্যান্য জাতি কোনো অঙ্ক জানতো না।জানতো কারা ? শুধু গ্ৰীক রা।
আর পর্যবেক্ষণ ও পরীক্ষা দ্বারা প্রাপ্ত নিয়ম কে অঙ্ক বা বিজ্ঞান বলা যাবে না যদি না সেটা কোনো law থেকে deduced হয়।
অর্থাৎ এটা ধরে নেওয়া হয়েছে যে পর্যবেক্ষণ ও পরীক্ষার দ্বারা প্রাপ্ত নিয়মের থেকে কোনো law থেকে পাওয়া deduction ‘বিজ্ঞান’ হিসেবে বেশি গ্ৰহণযোগ্য এবং শুধুমাত্র গ্ৰীকরা deduction জানতো।
পর্যবেক্ষণ ও পরীক্ষার থেকে ‘Deduction’ কে বেশি গুরুত্ব দিয়ে বিজ্ঞান সাধনার মিশরীয় ,ভারতীয় পদ্ধতিকে অস্বীকার করে গ্ৰিক তথা ইউরোপীয়দের উৎকৃষ্টতা প্রমাণ করার চেষ্টা হয়। ভারতবর্ষ কে অস্বীকার করে গ্ৰীসকে এক উৎকৃষ্ট সভ্যতা হিসেবে তুলে ধরাতে ইউরোপের কোন স্বার্থ কাজ করছে ?
রাজনৈতিক ইতিহাসের তুলনায় বিজ্ঞানের ইতিহাসের দ্বিচারিতা কে তুলে ধরা একটু কঠিন কারণ প্রথমতঃ বিজ্ঞানের দর্শন নিয়ে যে মিথ্যাচার সম্ভব এটা বিজ্ঞান-চর্চা যারা করেন না তাদের বোঝানো মুশকিল আর যারা বিজ্ঞান-চর্চা করেন তারা বিজ্ঞানের ইতিহাস ও দর্শন নিয়ে আগ্ৰহ দেখান না। ‘বিজ্ঞান’ হিসেবে স্কুল-পাঠ্যে যা তুলে ধরা হয় এবং বিজ্ঞানের যে ইতিহাস পড়ানো হয় সেটাই তারা শাশ্বত সত্য বলে মেনে নিতে থাকেন।
বর্তমানে ভারতবর্ষের বিদ্যালয়ের পাঠ্যপুস্তকে ‘বিজ্ঞান’ ও অঙ্কের বিভিন্ন আবিষ্কারক হিসেবে গ্ৰীকদের দেখানো হয়।
কিন্তু ইউরোপের ইতিহাসের একটু বিশ্লেষণ করলে খুব সহজেই সত্য আমাদের সামনে আসবে।
ইউরোপ তথা পৃথিবীর ইতিহাসে ক্রুসেড(১০৯৫-১২৯১ খ্রীঃ) একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। খ্রীষ্টিয় উপাসনা পদ্ধতির হৃত গৌরব ফেরানোর জন্য ইউরোপে খ্রীষ্টানদের লড়াই কে ক্রুসেড বলে। বিজ্ঞানে গ্ৰীকদের অবদানের সমস্ত কাহিনী ক্রুসেডের পরবর্তীকালের।এখন ক্রুসেডের তথা খ্রীষ্টিয় উপাসনা পদ্ধতির সঙ্গে বিজ্ঞানে গ্ৰিকদের অবদানের যে অতিরঞ্জিত কাহিনী তার কি যোগ আছে সেই আলোচনাই করবো।
খ্রীষ্টিয় উপাসনার ইতিহাস কে দুইভাগে ভাগ করা যেতে পারে—- ক্রুসেডের আগে এবং ক্রুসেডের পরে।
ক্রুসেডের আগে পর্যন্ত খ্রীষ্টান দুনিয়ার ‘অন্ধকার যুগ’ এর সময়কাল(৫০০-১০৬৬ খ্রীঃ)। চতুর্থ শতাব্দীতে(৩১২ খ্রীঃ) রোমান সম্রাট কনস্টানটাইন এর খ্রীষ্টের উপাসনা-পদ্ধতি(Religion) গ্ৰহণের মাধ্যমে রাজশক্তি ও চার্চের মধ্যে বন্ধন স্থাপিত হলো। এরপরে রোমান-খ্রীষ্টিয় সাম্রাজ্যে বই পুড়িয়ে দেওয়ার আদেশ , আলেকজান্দ্রিয়া লাইব্রেরী পুড়িয়ে দেওয়া(৩৯১ খ্রীঃ) এবং ৫২৯ খ্রীষ্টাব্দে জাস্টিনিয়ান এর স্কুল বন্ধ করে দেওয়া সহ বিভিন্ন ঘটনা খ্রীষ্টিয় দুনিয়ায় জ্ঞান-বিজ্ঞান এর ক্ষেত্রে এক শূন্যতার সৃষ্টি করে। ক্রুসেডের আগেও যে বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে খ্রীষ্টিয়-ইউরোপ খুব বেশি এগিয়ে ছিল তা বলা যাবে না।কারণ ইউরোপের ক্রুসেডের আগের সময়ের বিখ্যাত Mathematician পোপ দ্বিতীয় সিলভেস্টার (Gerbert of Aurillac , Pope Sylvester II) এর Mathematics ‘অ্যাবাকাস’এ(বর্তমানে কিন্ডারগার্টেন স্কুলে ‘অ্যাবাকাস’ এক খেলনা হিসেবে ব্যবহৃত হয়) সীমাবদ্ধ ছিল।
কিন্তু ক্রুসেড পূর্ববর্তী যে সময়ে খ্রীষ্টিয় ইউরোপের ‘অন্ধকার যুগ’ চলছে ঠিক সেই সময়ে ইসলামিক দুনিয়ার সুবর্ণ যুগ।
নবম শতাব্দীতে আব্বাসীয় খিলাফতের সময়ে বাগদাদে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে পাওয়া বইয়ের অনুবাদ হয় এবং খলিফা হারুন-আল-রাশিদ(৭৮৬-৮০৯ খ্রীঃ) এর উদ্যোগে এক লাইব্রেরী (Khizanat-al-Hakima )প্রতিষ্ঠিত হয়।তিন দশক পর এই লাইব্রেরী তে বইয়ের সংখ্যা এতো বৃদ্ধি পায় যে খলিফা আল-মামুন লাইব্রেরী কে আরো বড় করেন এবং নাম হয় ব্যাত-আল-হাকিমা(Bayt-al-Hakima) যা ইতিহাসে Baghdad House of Wisdom নামে সুপরিচিত।এই সময় বাগদাদে বইয়ের সংখ্যা এতো বেশি ছিল যে চীন থেকে কাগজ তৈরির পদ্ধতি জেনে বাগদাদে কাগজ তৈরির কারখানা স্থাপন করতে হয়।সেই সময়ের ইসলামিক দুনিয়ায় লাইব্রেরীর সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং দশম শতাব্দীতে উমাইয়া খিলাফতের সময়ে বর্তমান স্পেনের কর্ডোবায় এক সুবিশাল লাইব্রেরী গড়ে ওঠে। স্বাভাবিক ভাবেই ক্রুসেডের আগে ইউরোপ আরবীয়দের জ্ঞানচর্চার উৎকৃষ্টতা স্বীকার করতো।এর প্রত্যক্ষ প্রমাণ পাওয়া যায় ইউরোপীয়ান ম্যাথামেটিসিয়ান, পোপ সিলভেস্টার সেই সময়ের গ্ৰীক-খ্রীষ্টিয় বাইজানটিয়াম এর পরিবর্তে ইসলামীয় কর্ডোবার থেকে Mathematical numerals আমদানি করেছিলেন আর তাই এখনো আমরা ‘Arabic numerals’ কথাটি শুনতে পাই।ম্যাথামেটিক্সের জন্য পোপের গ্ৰীসের পরিবর্তে আরবীয় দুনিয়ার দিকে মুখ ফেরানোতেই স্পষ্ট হয় যে , ক্রুসেডের আগে বিজ্ঞানের সমস্ত ক্ষেত্রে গ্ৰীসের অবদানের গল্পের কোনো অস্তিত্বই ছিল না।
এখন প্রশ্ন ক্রুসেড এবং তার পরবর্তী সময়ে গ্ৰীসে বিজ্ঞানের উদ্ভবের গল্পের সৃষ্টি হলো কেমন করে এবং কেনো ?
পিন্টু সান্যাল