অনেক বাঙ্গালি পণ্ডিত বলেছেন রাম নাকি বাঙ্গলার সংস্কৃতির অঙ্গ নন। বাঙ্গলার সংস্কৃতি বলতে তারা কী বোঝেন সে কথায় পরে আসছি, কিন্তু বাঙ্গলার সংস্কৃতির সঙ্গে মর্যাদা পুরুষোত্তম রামচন্দ্রের যে ওতপ্রোত সম্পর্ক তা পুঁথিগত প্রমাণ ছাড়াও অন্যভাবে বোঝা যায়। শহরে বসে হয়তো ততটা বোঝা যাবে না, কিন্তু গ্রামে-গঞ্জে দৈনন্দিন জীবনে রামায়ণ পাঠের যে চল রয়েছে, আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা যাতে নিয়ম করে অংশগ্রহণ করে। শহরে যে যৌথ পরিবারগুলি এখনও টিকে রয়েছে, সেখানেও বিস্মৃত-যুগের মানুষ হয়ে বেঁচে থাকা ঠাকুমাদিদিমার কাছে রামায়ণের গুরুত্ব রয়েছে। মুজতবা আলি কবেই বলে গেছেন, সেই ট্রাডিশন সমানে চলছে। ‘রামায়ণ-পাঠের এই প্রবহমানতা তো আজকের নয়, আজ থেকে পাঁচশো বছরেরও বেশি সময় আগে মূল সংস্কৃত থেকে বাল্মীকি রচিত রামায়ণ পাঠ বাঙ্গালি বাড়ির পুরুষ-মহিলা নির্বিশেষে সবার পক্ষেই কিছুটা দুরূহ ছিল। তাদের জন্য বরাদ্দ থাকতো কৃত্তিবাসী রামায়ণ।
যে রামায়ণের রচয়িতা কৃত্তিবাস ওঝার জন্মসাল নিয়ে কিছু বিতর্ক আছে, তবে তিনি যে পঞ্চদশ শতকের ব্যক্তি তাতে সন্দেহ নেই। কবির আত্মবিবরণ থেকে জানা গিয়েছে তার বাবার নাম বনমালী, ঠাকুরদার নাম মুরারী, মায়ের নাম মেনকা। তারা ছয়-সাত ভাই, এক বোন। বারো বছর বয়সে তিনি উত্তরবঙ্গে শিক্ষা নিতে যান, শিক্ষান্তে চলে যান গৌড় রাজসভায় রাজা দনুজমর্দন কংস বা গণেশের (মতান্তরে তাহেরপুরের রাজা কংসনারায়ণের) কাছে। কৃত্তিবাসের কাব্য প্রতিভায় গৌড়েশ্বর আকৃষ্ট হন এবং তাকে রামায়ণ রচনার আদেশ দেন। এরই কারণে কৃত্তিবাস ওঝা ‘শ্রীরাম পাঁচালী’রচনা করেন।
তিনি পাঁচটি পর্যায় বা কাণ্ডে’এই পাঁচালী রচনা করেন। এর মধ্যে একমাত্র উত্তরকাণ্ড বাদে আর কোনোটিরই প্রাচীন পুঁথি পাওয়া যায়নি। কিন্তু বাঙ্গলার মধ্যযুগে কৃত্তিবাসী রামায়ণ অসম্ভব জনপ্রিয় হয়ে ওঠায় পাঁচালীকারদের পক্ষে মূল রামায়ণের প্রতিরূপটি সবসময় ফুটিয়ে তোলা সম্ভব হয়নি। কৃত্তিবাসী রামায়ণের একটি সংস্করণ শ্রীরামপুরের মিশনারিরা ছাপিয়ে ছিল ১৮০২-০৩ সালে, কারণ তারাও দেখেছিল নেটিভদের মধ্যে প্রবেশ করতে গেলে কৃত্তিবাসী রামায়ণের জনপ্রিয়তাকে কাজে লাগাতে হবে। তবে এখানে কৃত্তিবাসের ‘শ্রীরাম পাঁচালী’র মূল পুঁথিনা পাওয়া যাওয়ায় প্রচলিত পাঁচালীকারদের ভাষ্যকেই গ্রহণ করা হয়েছিল। ১৮৩০-৩৪ সালে জয়গোপাল তর্কালঙ্কারের সম্পদনায় দু’খণ্ডে কৃত্তিবাসী রামায়ণের যে দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হয়। তাতে রচনাটির আদি রূপ ফিরিয়ে দেওয়ার কিছুটা চেষ্টা হয়। পরবর্তীকালে নলিনীকান্ত ভট্টশালী এই কাজই আরও বিশদে করেন।
বাল্মীকি রামায়ণকে অনেকাংশে ভেঙে গড়ে বাঙ্গালিদের উপযোগী করার চেষ্টা করেছিলেন কৃত্তিবাস ওঝা। বাঙ্গালি জাতিকে রামনামে মাতোয়ারা করাতে তাঁর অবদানই সবচেয়ে বেশি। ভাষাবিদ সুকুমার সেনের বক্তব্য : ‘কৃত্তিবাসের কাব্য সম্বন্ধে এইটুকু বলিলেই পর্যাপ্ত হইবে যে, পঞ্চদশ শতাব্দীর মধ্যভাগ হইতে আরম্ভ করিয়া আজ অবধি ইহা সমগ্র বাঙ্গলার আবালবৃদ্ধ-বণিতাকে তাহাদের দুঃখে-সুখে, উত্থানে পতনে ভোগে ত্যাগে, কর্মে অবসরে- সর্ববিধ অবস্থায় সমান আনন্দ জোগাইয়া আসিতেছে। কাব্যের উৎসর্ষ এবং কবির সৌভাগ্য ইহা হইতে আর অধিক কী হইতে পারে?
বাঙ্গলার গল্প-উপন্যাস-প্রবন্ধেও তাই কৃত্তিবাসী রামায়ণের প্রসঙ্গ বার বার এসেছে। নদীয়া জেলার ফুলিয়ায় যেখানে কৃত্তিবাস জন্মেছিলেন সেই স্থান আজ তীর্থক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। আসলে কৃত্তিবাস তার ‘শ্রীরাম পাঁচালী’তে চলমান ভারতীয় জীবন-দর্শনকেই ফুটিয়ে তুলেছিলেন। রাম’ ভালো, ‘জয় শ্রীরাম’ খারাপ গোছের থিওরি যারা বাজারে আমদানি করতে চাইছেন, তাদের জেনে রাখা ভালো মর্যাদা পুরুষোত্তম রামচন্দ্রকে ‘শ্রীরাম’ নামে অভিহিত করার কাজটিও কৃত্তিবাস ওঝারই করা। শুধু কৃত্তিবাসই বা কেন তারও আগে একাদশ শতাব্দীর শেষভাগে পালবংশের রাজা রামপালদেবের পুত্র মদনপালদেবর মন্ত্রী সন্ধ্যাকর নন্দী রামচরিত রচনা করেছিলেন, এই বাঙ্গলারই বুকে বসে। এ আজ থেকে প্রায় হাজার বছর আগের ঘটনা।
সুতরাং বাঙ্গলার সংস্কৃতিতে রামের অস্তিত্ব নেই বলে যাঁরা দাবি করেন তাদের অশিক্ষিত কিংবা মূখ বললে, “অশিক্ষিত’দেরই অপমান করা হয়। এরা আসলে ধূর্ত ও শয়তান। মার্কস – লেনিনের আদর্শে ভারতবর্ষের সর্বনাশ ও ক্ষতিসাধন যাদের একমাত্র লক্ষ্য তারা আজ বাঙ্গালি সংস্কৃতির ধুয়ো তুলবে নিজেদের স্বার্থেই, বিদ্যাসাগরের মূর্তি ভাঙার অর্ধশতাব্দী পালন যাদের গোপন অভিলাষ, বাঙ্গলাকে ভারত থেকে বিচ্ছিন্ন করা যাদের রাজনৈতিক অ্যাজেন্ডা, সাতের দশকের নকশাল আন্দোলন থেকে আজও তারা প্রেরণা নিয়ে বাঙ্গালির তথাকথিত ‘সংস্কৃতি’র নিজস্ব প্রোপাগাণ্ডা গড়ে তুলবে। সময় এসেছে ছয়ের-সাতের দশকের সেই ধ্বংসাত্মক নকশালি ও স্বাধীনতা আন্দোলনের বিশ্বাসঘাতক কমিউনিস্ট সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে এসে বাঙ্গলার সনাতনী পরম্পরাকে তুলে ধরার। কৃত্তিবাস ওঝা তারই প্রতিরূপ।
অভিমন্যু গুহ
2019-07-19