১৯৪২ এর ভারত ছাড়ো আন্দোলন প্রসঙ্গে কমিউনিস্টদের কিছু মিথ্যাচার রয়েছে।আজ সেই বিষয়টির উপর আলোকপাত করব।
৪২ এর ভারত ছাড়ো আন্দোলন শুরু হলে তা ক্রমশই স্বতঃস্ফূর্ত আকার ধারণ করেছিল।কমিউনিস্টরা বলে থাকেন শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় এই আন্দোলনের বিরোধিতা করেছিলেন।এ প্রসঙ্গে প্রথমেই একটি চিঠির উল্লেখ করব।১২-৮-১৯৪২ হিন্দুমহাসভার নেতা শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় লিনলিথগোকে একটি চিঠি লেখেন।তিনি লেখেন,”যে দাবী কংগ্রেসের বিগত প্রস্তাবে উত্থিত হয়েছে তা কার্যত সমগ্র ভারতবর্ষের জাতীয় দাবি।এই সংকটের সময় দমন কোনও প্রতিকার হতে পারে না।ব্রিটিশ গভর্নমেন্টের পক্ষে সবচেয়ে দুর্ভাগ্যজনক সিদ্ধান্ত হল মহাত্মা গান্ধীর সঙ্গে যোগাযোগ না করা,বিশেষ করে তিনি যখন পরিস্কারভাবে জানিয়েছিলেন যে সম্মানজনক মীমাংসার সব রকম চেষ্টা করার আগে তিনি আন্দোলন শুরু করবেন না।”
শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় ভারত ছাড়ো আন্দোলনে যোগদান করেছিলেন,সেই ইতিহাসও বামপন্থী ইতিহাসবিদরা চেপে রেখেছেন।এ প্রসঙ্গে আলোকপাত করা যেতে পারে ফজলুল হকের ‘বেঙ্গল টুডে’ গ্রন্থটির উপর।গ্রন্থটি থেকে জানা যায় যে,ভারত ছাড়ো আন্দোলন চলাকালীন তমলুক মহকুমায় বিপ্লবী এবং সাধারণ মানুষের উপর ব্রিটিশ পুলিশ অমানবিক নির্যাতন শুরু করে।শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় হক-মন্ত্রীসভার সদস্য হিসাবে সেখানে যান সরেজমিনে অবস্থা দেখতে।শ্যামাপ্রসাদ সীমা পরিসীমাহীন নির্যাতনের ঘটনাবলী শুনে এতটাই স্তম্ভিত হয়েছিলেন যে,তিনি মেদিনীপুর শহরে একটি প্রকাশ্য জনসভায় এই নির্যাতনের তীব্র নিন্দা করেন।মেদিনীপুর থেকে ফেরার পথে শেষ রাতে কোলাঘাট স্টেশনে ট্রেনের মধ্যে পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করে গভর্নর স্যার জন হারবার্ট এর নির্দেশে।
শ্রী নৃপেন্দ্র নাথ সিংহ তাঁর “ভারত ছাড়” গ্রন্থে লিখেছেন, ভারত – বরেণ্য নেতা ডঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী ভারত গভর্নমেন্টের দমননীতির প্রতিবাদে ও মন্ত্রীদের প্রত্যেক কাজে বাংলার গভর্নরের হস্তক্ষেপের প্রতিবাদে মন্ত্রীত্ব ত্যাগ করিয়া গভর্নরের কাছে ১৯৪২ সালের ১৬ ই নভেম্বর এক পত্র দেন। তাতে তিনি মেদিনীপুরের অফিসারদের জুলুম সম্বন্ধে ও গভর্নমেন্টের দমননীতির সম্বন্ধে ভীষণ প্রতিবাদ করেনঃ-
“প্রিয় স্যার জন,
আমার পদত্যাগের দুইটি কারণঃ- প্রথমতঃ বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্বন্ধে ব্রিটিশ গভর্নমেন্টের ও ভারত গভর্নমেন্টের নীতি আমি অনুমোদন করি না। দ্বিতীয়তঃ আপনি অকারণে মন্ত্রীদের কাজে হস্তক্ষেপ করিয়া প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনকে প্রহসনে পরিণত করিয়াছেন। আপনি বাংলায় বিশ্বাস ও সহযোগিতার নীতি অবলম্বন করিতে পারিতেন।যখন কংগ্রেস নেতৃবৃন্দের গ্রেপ্তারের বহুপূর্বে আপনি ভারত গভর্নমেন্টের বর্তমান দমননীতির সংবাদ পাইয়াছিলেন তখন বিশ্বাস করিয়া প্রধানমন্ত্রী ছাড়া অন্য মন্ত্রীদের সহিত পরামর্শ করিতে সাহস করেন নাই যদিও আপনি অনেক সরকারি কর্মচারীদের সহিত পরামর্শ করিয়াছিলেন। আপনি কংগ্রেস নেতৃবৃন্দের গ্রেপ্তারের পর ৯ ই আগস্ট আমাদিগকে হয় ভারত গভর্নমেন্টের দমননীতি অনুমোদন করিতে না হয় মন্ত্রীত্ব হইতে পদত্যাগ করিতে বলেন। আপনি যৌথ দায়িত্বের ভিত্তিতে আমাদিগের সাহায্য আশা করেন অথচ এইরূপ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আপনি আমাদিগকে বিশ্বাস ও পরামর্শ করিতে অস্বীকার করেন।আমার সেই সময় দৃঢ় ধারণা হইয়াছিল ভারত গভর্নমেন্টের নিষ্ঠুর দমননীতি অবলম্বন না করিয়া সমস্যার একটি শান্তিপূর্ণ ও সম্মানজনক মীমাংসা করা উচিত ছিল। আমি ব্রিটিশ গভর্নমেন্ট ও বড়লাটকে সেই উদ্দেশ্যে পত্র দিই।……ইহা এখন সুস্পষ্ট যে বর্তমান অচল অবস্থা দূর করিবার সদিচ্ছা গভর্নমেন্টের নাই।ইত্যবসরে আমি বিশিষ্ট রাজনৈতিকদের সঙ্গে পরামর্শ করিয়াছি।গান্ধীজী ও কংগ্রেসের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে সাক্ষাতের অনুমতি বড়লাট আমাকে দেন নাই।( এখানে ডঃ শ্যামাপ্রসাদ ভারতে জাতীয় গভর্নমেন্ট স্থাপনের যুক্তি দেখান)।
” বর্তমান অচল অবস্থা অবসান করার দায়িত্ব ভারত সরকারের হস্তে।যতদিন পর্যন্ত ভারতীয়দের হাতে ক্ষমতা না দেওয়া হয় ততদিন পর্যন্ত অচল অবস্থার সমাধান হইবে না।
“…..ইংরেজরা তাহাদের জন্মভূমিতে যেরূপ স্বাধীনভাবে থাকিতে ইচ্ছা করে আমরা আমাদিগকে সেইরূপ স্বাধীনভাবে আমাদের ভাগ্য নিয়ন্ত্রণ করিবার অধিকারী বলিয়া মনে করি। ভারতীয়দের একতার অভাব ব্রিটিশের মিথ্যা অজুহাত।
“ব্রিটিশরা যদি ডিভাইড এন্ড রুল এর পুরাতন খেলা না খেলিয়া প্রকৃত ক্ষমতা হস্তান্তর করিবার মনস্থ করে তবে ভারতে সমস্ত দল নিজেদের স্বার্থের খাতিরে একত্র হইবে। আসল কথা ইংরাজরা যে কোন উপায়ে ভারতকে পরাধীন রাখিবে পরাধীন।পরাধীন জাতি কোন মহৎ উদ্দেশ্যের জন্য প্রাণ দিয়া লড়াই করিতে পারে না। ভারত স্বাধীন হইয়া অন্যান্য স্বাধীন জাতির সহিত একযোগে একসিস শক্তির কবল হইতে মানব জাতিকে মুক্ত করিতে চায়।….সকলের চেয়ে দুঃখজনক ব্যাপার এই যে এই সঙ্কটজনক মুহূর্তে যখন ব্রিটিশ শক্তি এশিয়ার পূর্বাঞ্চলে ইহার অধীনস্থ বৃহৎ ভূখণ্ডের প্রত্যেক দেশের অধিবাসীদের মনে স্বাধীনতা রক্ষার নিরতিশয় আগ্রহ সঞ্চার় করিতে না পারায় সেই সকল ভূমিখণ্ড ইহার হস্তচ্যুত করিতেছে তখন ভারতের ব্যাপারে সেই ভুল নীতি অনুসরণ করিবার একগুঁয়েমি দেখানো হইতেছে। যদি নিজের দেশকে স্বাধীন দেখিবার ও বৈদেশিক প্রভুত্ব অবসান করিবার আকাঙ্ক্ষা পোষণ করা অপরাধ হয় তবে প্রত্যেক আত্মমর্যাদাসম্পন্ন ভারতবাসীই অপরাধী। ভারতের অনেক শাসনকর্তা ভারতের শহর ও গ্রামের রাস্তাঘাটে পঞ্চম বাহিনীকে ঘুরিয়া বেড়াইতে স্বপ্ন দেখেন।…. আমরা চাই আপনারা যথাসম্ভব শীঘ্র নিরাপদে নিজের দেশে চলে যান।এখন ইহা আপনাদের ভাবা কি যু্ক্তিসঙ্গত যে,যে জাতি বিরাট ভূমিখণ্ড অধিকারের অতৃপ্ত বাসনা ও উদ্যম হৃদয়ে পোষণ করে সেই নূতন(জাপানী) প্রভুকে আমরা ভারতে আহ্বান করিব? আমরা এই ভারত ভূমিকে আমাদের নিজস্ব করিতে চাই এবং আমরাই ইহাকে শাসন করিতে চাই।…. ইংরেজরা ভারতের হিতৈষী অছিস্বরূপ-এই নীতির মুখোশ খুলিয়া গিয়াছে এবং আপনারা আমাদের চক্ষে আর ধূলি নিক্ষেপ করিতে পারিবেন না।……..
“ভারতবাসী যদি মনে না করে তাহারা স্বাধীন এবং যে কোন মূল্য দিয়া স্বাধীনতা রক্ষা করিতে হইবে তবে ভারতবাসীকে চীন ও রাশিয়ার মত লড়াই করিতে উদ্বুদ্ধ করা যাইবে না-এই বিষয়টি ব্রিটিশরা উপলব্ধি করিতে পারেন নাই।
“স্বাভাবিক ও ন্যায়সঙ্গত উপায় অবলম্বন না করিয়া বিপ্লব দমন করিবার জন্য এই তিন মাস গভর্নমেন্ট দমননীতির শাসন চালাইয়াছে।… এই তিন মাসে জনসাধারণ বুলেটের ভয় হারাইয়াছে।ভারতকে পদানত রাখিবার পরবর্তী কি উপায় হইবে? আজ ভারতের সর্বত্র অসন্তোষ ও তিক্ততা বিরাজ করিতেছে। একটা নিরস্ত্র ও আত্মরক্ষার উপায়হীন জাতির সহিত লড়াই করা জগতের সর্বাপেক্ষা সোজা কাজ।আজ অনেক ব্রিটিশ প্রতিনিধি- বক্তা মনে করেন বর্তমানে ভারতবর্ষ কিংবা ইহার কোন অংশ ব্রিটিশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করিয়াছে। যদি তাহাদের এই বিশ্বাস হয় তবে ভারতবাসীকে অস্ত্র সরবরাহ করা হ’ক এবং সমত্বের ভিত্তিতে যুদ্ধ হ’ক। ঘটনা বিপর্যয়ে জনসাধারণ এত সম্পূর্ণভাবে হতাশ হইয়াছে যে বর্তমান অত্যাচারের হাত হইতে মুক্তি পাইতে তাহারা যে কোন পরিবর্তন সাদরে অভ্যর্থনা করিবে।
“রাজনৈতিক বিজ্ঞতার অভাবে ভারতীয়দের সদিচ্ছা ও সাহায্য অবিশ্বাসে ও তিক্ততায় পরিণত হইয়াছে।আমি একথা বলছি না যে গত তিন মাসের বিবেচনাহীন ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আনয়ন করিবে।অরাজকতা বন্ধ করিতেই হইবে।কিন্তু তাহাই একমাত্র সমস্যা নয়।….আপনারা ভারতীয় অসন্তোষের গোড়ার কারণ বুঝিতে পারেন নাই।যদি ভারতে শান্তি স্থাপন করিতে হয় তবে স্বাধীনতার ক্ষুধা মিটাইতে হইবে।ভারতের ন্যায়সঙ্গত আকাঙ্ক্ষা পূরণের জন্য গঠনমূলক নীতি অবলম্বন না করিয়া কেবল শক্তির সাহায্যে অরাজকতার বহিঃপ্রকাশ প্রতিরোধ করিলে ব্রিটেন ও ভারতবর্ষের মধ্যে বিবাদ বাড়িয়া যাইবে।ইচ্ছার বিরুদ্ধে ভারতবাসীকে শুধু বেয়নেটের ভয়ে পদানত রাখা যাইবে না।
” গত জুলাইতে লিখিত পত্রে আপনি যে প্রণালীতে বাংলা প্রদেশ শাসন করিতেছেন তাহাতে আমি আমার অসন্তোষ ও নৈরাশ্য জ্ঞাপন করিয়াছি।আপনি একটার পর একটা গুরুতর ভুল করিতেছেন।বাংলায় এই প্রথম হিন্দু-মুসলমানের বৃহৎ অংশ দ্বারা পরিচালিত মন্ত্রীমণ্ডল গঠিত হইয়াছে।যে দল বা ব্যক্তি রাজনৈতিক ও সাম্প্রদায়িক কারণে পরস্পরের প্রতি ভীষণভাবে বৈরীভাবাপন্ন ছিলেন তাহারা জনসাধারণের কল্যানকল্পে একত্র মিলিত হইয়াছেন।বিলাতের ও ভারতবর্ষের অনেক উচ্চপদস্থ কর্মচারীরা হিন্দু-মুসলমানের এই সুদৃঢ় মিলন পছন্দ করেন না।আপনিও আমাদের এই মিলিত সহযোগিতায় সাড়া দেন নাই।….আপনি গোড়া হইতেই শাসনতন্ত্র মানিয়া চলেন নাই।আপনি সর্বদাই প্রতিক্রিয়াশীল অবিচক্ষণ স্থায়ী I.C.S অফিসার দ্বারা পরিচালিত হইতেছেন।
“আপনি মন্ত্রীদের অবিশ্বাস ও সন্দেহ করেন।আপনি মন্ত্রীমণ্ডলের সর্ববাদিসম্মত অনেক প্রস্তাব যথা বাংলার সৈন্য গঠন,হোম গার্ডকে জনপ্রিয়করণ,পার্লামেন্টারিস সেক্রেটারি নিয়োগ, আমাদের পূর্ণ দায়িত্ব লওয়া সত্ত্বেও রাজনৈতিক বন্দীদের মুক্তিদান -প্রত্যাখান করিয়াছেন।আপনি পদে পদে মন্ত্রীদের কাজে বাধা দিয়াছেন।নতুন অফিসার নিয়োগে আপনি মন্ত্রীদের পরামর্শ ছাঁটিয়া ফেলিয়াছেন।মন্ত্রীদিগের তাহাদের নিজেদের বুদ্ধি বিবেচনা অনুসারে কাজ করিতে আপনি সুযোগ দেন না।
“আগস্ট বিপ্লব দমনের নীতি সংক্রান্ত ব্যাপারে দারুণ অবস্থার সৃষ্টি হইয়াছে।…..গভর্নমেন্টের কোনরকমেই অফিসারগণকে জনসাধারণের উপর অত্যাচার করিতে কিংবা নির্দোষী লোককে প্রহার করিতে উৎসাহ দেওয়া উচিৎ নয়,কিন্তু আমাদের যথাসাধ্য চেষ্টা সত্ত্বেও বেপরোয়া গ্রেপ্তার চলিয়াছেম,নির্দোষী লোককে প্রহার দেওয়া হইয়াছে এবং গুলি করিয়া হত্যা করা হইয়াছে। কোন সভ্য গভর্নমেন্টের পক্ষে কদাচ প্রশংসনীয় উপায়ে অত্যাচার চালান হইয়াছে।….আপনি বরাবরই উৎপীড়নের অভিযোগ তদন্ত করিতে দৃঢ়তার সঙ্গে প্রত্যাখ্যান করিয়াছেন এবং সঠিক সংবাদ প্রকাশ বন্ধ করিবার সহায়তা করিয়াছেন।
” মেদিনীপুরের কতকাংশে রাজনৈতিক আন্দোলন খুব সাংঘাতিক আকার ধারণ করে।এইসব অপরাধীদের আইনসঙ্গত উপায়ে দমন করার বিরুদ্ধে কাহার কিছু বলিবার নাই।কিন্তু জার্মানির অধিকৃত অঞ্চলে যেরূপ নৃশংস দমনকার্য চলিয়াছিল সেইরূপ মেদিনীপুরে চলিয়াছে।সশস্ত্র সৈন্য ও পুলিশ দ্বারা শত শত গৃহ জ্বালাইয়া দেওয়া হইয়াছে।স্ত্রীলোকের উপর পাশবিক অত্যাচারের সংবাদ আমরা পাইয়াছি।হিন্দুদিগের বাড়ী লুঠতরাজ করিতে মুসলমানদিগকে উৎসাহ দেওয়া হইয়াছিল।অনেক ক্ষেত্রেই পুলিশই এই কার্য করিয়াছে।কলিকাতা হইতে এই আদেশ জারি করা হয় যে পুলিশ দ্বারা ঘরবাড়ী পোড়ান গভর্নমেন্টের নীতি নয়।আমার কাছে উপযুক্ত প্রমাণ আছে যাহার দ্বারা আমি দেখাইতে পারি যে ঐ আদেশ মান্য করা হয় নাই।এমন কি ১৬ ই অক্টোবরের ঝড়ের পরও এবং তাহার এক পক্ষকাল পরে আমাদের সফরের পরও গৃহলুন্ঠন ও গৃহদাহ চলিতে থাকে।
” গভর্নমেন্টের লোকদের এই সব অত্যাচার অতি ঘৃণিত। স্বেচ্ছাসেবকদের দ্বারা অনুষ্ঠিত অরাজকতার সর্বতোভাবে আমরা নিন্দা করি।কিন্তু এই অপরাধের জন্য শান্তিরক্ষকদের নির্দোষী লোককে আতঙ্কগ্রস্ত ও উৎপীড়ন করার পক্ষে কোন যুক্তি নাই।সরকার কর্তৃক এক পক্ষকাল ঝড়ের সংবাদ এবং সাহায্যের আবেদন গোপন রাখা অমার্জনীয় অপরাধ।ঝড়ের পর কতকগুলি অফিসারের ঔদাসীন্য ও হৃদয়হীনতার তুলনা কোন সভ্য গভর্নমেন্টের ইতিহাসে পাওয়া যায় না।জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের উপস্থিতিতে আমরা অভিযোগ পাইয়াছি যে বাড়ীর ছাদ বা গাছ হইতে লোকদিগকে উদ্ধার করিবার জন্য নৌকা ব্যবহার করিতে দেওয়া হয় নাই(বঞ্চনানীতি অনুসারে নৌকাগুলি পূর্বেই বাজেয়াপ্ত হইয়াছিল)।একজন ভদ্রলোক একটি হৃদয়বিদারক বিবরণ দেন।তিনি ও অন্যান্য ভদ্রলোক কয়েকজন নরনারী ও শিশুকে নিকটস্থ জলে নিমজ্জিত অঞ্চল হইতে উদ্ধার করিবার উদ্দেশ্যে একখান ভাসমান নৌকা মাত্র কয়েকঘন্টার জন্য অফিসারদের নিকট হইতে চান।এই প্রার্থনা সরাসরি নামঞ্জুর হয়।বিপদগ্রস্ত লোকগুলি জলস্রোতে ভাসিয়া চলিয়া যায়।।ইহাদিগকে আর জীবন্ত অবস্থায় পাওয়া যায় নাই।ঝড়ের পরও যে সকল অঞ্চলে জনসাধারণ সহযোগিতা করিতে চাহে,সেখানেও সান্ধ্য আইন বলবৎ থাকে।
“আমাদের হস্তক্ষেপেও কোন ফল হয় নাই।বন্যায় শতকরা ৭৫-৮৫ গবাদি পশু মারা যায়।বাকী দুগ্ধবতী সবৎসা গাভীগুলির অধিকাংশ ভারতরক্ষা আইনানুসারে সৈন্যদিগকে খাওয়াইবার জন্য জোরপূর্বক লইয়া যাওয়া হয়। এইরূপ অমানুষিক নির্দরতার তুলনা মিলে না।একজন অফিসার গভর্নমেন্টের নিকট রিপোর্ট পাঠান যে বিপ্লবের জন্য লোকদিগকে স্থায়ী শিক্ষার দিবার উদ্দেশ্যে একমাস সরকারি বা বেসরকারি সাহায্য বন্ধ রাখা উচিৎ।কলিকাতা হইতে মেদিনীপুরে প্রেরিত প্রকৃত সাহায্যকারীগণকে ভারত রক্ষা আইনানুসারে আটক রাখা হয়।মন্ত্রীদের পক্ষ হইতে এইসব অফিসারকে বদলি করা বা অভিযোগের তদন্ত করার কোন সম্ভাবনা নাই কারণ বলা হ’বে ইহাতে গভর্নমেন্টের ইজ্জতের হানি হইবে।
” যতদিন না ঈশ্বরের কোপ বর্ষিত হয় ততদিন দেশের লোককে পুলিশের অত্যাচার নীরবে সহ্য করিতে হইবে।
“মেদিনীপুরের কংগ্রেসসেবী সহ অধিকাংশ লোক শান্তি স্থাপন করিতে চাহে।জেলের ভিতরের ও বাহিরের লোকের সঙ্গে আলোচনা করিয়া আমার ধারণা হইয়াছে যে যদি সরকারী কর্মচারীরা সহানুভূতি ও বিবেচনার সহিত ব্যবস্থা পরিচালনা করিতেন তবে আন্দোলন বন্ধ হইত এবং মেদিনীপুরবাসীরা গভর্নমেন্টের সহিত একযোগে বন্যাবিধ্বস্ত অঞ্চলে সাহায্য দামে ব্রতী হইত।স্থানীয় কর্মচারীদের শৈথিল্য ও দীর্ঘসূত্রতার জন্য এবং কলিকাতার আইন ও শৃঙ্খলা রক্ষা-বিভাগের প্রতিবন্ধকতার জন্য এক মাস সময় নষ্ট হইয়াছে।ইতিমধ্যে লোক আহার,আশ্রয়,ঔষধ, বস্ত্র ও পানীয় জলের অভাবে কষ্ট পাইতেছে।অত্যাচার,উৎপীড়ন ও সাহায্য দানে উদাসীনতা খুব নিষ্ঠুর ও মারাত্মক ব্যাপার। কতকগুলি অফিসারকে জেলা হইতে বদলি না করিলে অবস্থার উন্নতি হইবে না কিন্তু আমরা একবারে ক্ষমতাহীন। আপনিও এই বিষয়ে আমাদের পরামর্শ গ্রহণ করিতে অস্বীকার করেন।আপনি বাংলায় গভর্নর হিসাবে ঝড় ও বন্যাপ্রসূত অভুতপূর্ব ক্ষতির জন্য সময়মত একটি সহানুভূতির বাণী দিতে পারিতেন না কি? নিরপেক্ষ তদন্তের আদেশ দিবার সৎসাহস কি আপনার আছে?
” পাইকারী জরিমানা ধার্যের নীতি কঠোর সমালোচনার যোগ্য।কেবল হিন্দুদের উপরই পাইকারী জরিমানা ধার্য হয় ইহা পুরাতন জিজিয়া করের ব্রিটিশ সংস্করণ।প্রধানমন্ত্রী এইরূপ কর ধার্যের বিরোধী এবং তিনি জরিমানা ধার্যের কয়েকটি নীতি প্রবর্তন করিতে চাহেন কিন্তু আপনি তাহাতে আপত্তি করেন।বেপরোয়াভাবে জরিমানার পরিমাণ ধার্য করা হইয়াছে।মোট ক্ষতির সহিত ইহার কোন সামঞ্জস্য নাই।আমি কয়েকটি দৃষ্টান্তের কাগজপত্র খুব সতর্কতার সহিত পরীক্ষা করিয়াছি এবং জরিমানার পরিমাণের ভীষণত্ব আমাকে স্তম্ভিত করিয়াছে।আমি জোর করিয়া বলিতে পারি যে কোন নিরপেক্ষ বিচারকের নিকট সমস্ত কাগজপত্র উপস্থিত করিলে অধিকাংশ ক্ষেত্রে তাঁহার রায় হইবে যে জরিমানা অর্ডিন্যান্স অনুসারে মোটেই ধার্যযোগ্য নয়,কিংবা জরিমানার পরিমাণ ক্ষতির পরিমাণের সহিত অসামঞ্জস্যপূর্ণ।……
” প্রধানমন্ত্রীকে জানিতে না দিয়া অনেক অনেক ক্ষেত্রে জরিমানা ধার্য করা হইয়াছে।সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী প্রস্তাব করিয়াছেন যে জরিমানা আদায় এক সপ্তাহ মুলতুবি রাখা হউক এবং মন্ত্রীদের সভায় জরিমানা আদায়ের নীতি বিবেচনা করা হইবে।মন্ত্রীদের সভার অনুষ্ঠান করিতে আপনার কোন আপত্তি ছিল না কিন্তু আপনি আগেই মন্ত্রীদের প্রতি অসম্মানজনক অসৌজন্য প্রদর্শন করিয়া যথেষ্ট স্পষ্টতার সঙ্গে বলিয়াছিলেন যে অবিলম্বে জরিমানা আদায়ের জন্য আপনার নিজস্ব বিবেচনাতে যে কোন উপায়েই হুকুম জারি করবেন।
“বড়ই আশ্চর্য যে জনসাধারণের অধিকার ও স্বাধীনতা সংক্রান্ত বা জাতিগত বৈষম্য সংক্রান্ত প্রত্যেক বিষয়ে আপনি এই প্রদেশের জনগণের প্রকৃত স্বার্থের প্রতি অসাধারণ ঔদাসীন্য দেখাইয়া কার্য করিতেছেন।সহানুভূতি ও সদিচ্ছা বোঝবার আগ্রহ দেখাইলে বর্তমান কঠি সঙ্কট অবস্থা অনেকটা প্রশমিত হইত।
“আপনি যাহা করিয়াছেন তাহা শত্রুকে(জাপানীদের)সাহায্য করিবে।সামরিক কোন ব্যাপার মন্ত্রীদের ঘুণাক্ষরেও জানিতে দেওয়া হয় না।আমরা এখনও আশা করি ভারতবর্ষ ও বাংলা সাফল্যভাবে রক্ষিত হইবে।”
উপসংহারে শ্রী নৃপেন্দ্র নাথ সিংহ লিখেছেন,ডঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় ভারতের একজন সর্বজন বরেণ্য নেতা।তিনি দায়িত্বশীল মন্ত্রী হিসাবে তথ্য সংগ্রহ করিয়া মেদিনীপুর সম্বন্ধে যে সব উক্তি করিয়াছেন তাহা বর্ণে বর্ণে সত্য বলিয়া আমরা নিঃসন্দেহে বিশ্বাস করিতে পারি।
এবার আলোচনা করব সেইসময় কমিউনিস্টদের ভূমিকা নিয়ে।সোভিয়েত-ইংল্যান্ড মিত্রতা হওয়ার পরে ভারতের কমিউনিস্টরা ইংরেজ বন্ধুতে পরিণত হয়েছিল।ঠিক সেই সময়ে সোভিয়েত রাশিয়ার নির্দেশে ইংরেজ ভক্ত ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির ক্যাডারবাহিনী এবং বুদ্ধিজীবীরা বাংলার প্রাদেশিক সরকারের জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের অফিসগুলিতে A.R.P. Warden অর্থাৎ Air Raid precaution (শত্রুপক্ষের বিমান আক্রমণের সতর্কতা গ্রহণ সংক্রান্ত)ব্যবস্থা তদারকির মজুরিগিরি করে ভাতা বাবদ পেত দৈনিক এক টাকা করে।
ইংরেজ শাসকদের অর্থানুকূল্যে প্রকাশিত হতে আরম্ভ করল কমিউনিস্টদের খবরের কাগজ ও প্রচারপত্র-‘people’s war’,’জনযুদ্ধ এবং স্বাধীনতা’ ইত্যাদি।এগুলির একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল ভারত ছাড়ো আন্দোলনের বিরোধিতা করা। অরুণ শৌরী লিখিত The only Fatherland : communists,’ Quit India’ and the soviet union,kindle edition,location 1299 থেকে জানা যায়, ‘people’s war’ ১৯৪২ সালের সেপ্টেম্বর সংখ্যায় ভারত ছাড়ো আন্দোলনের তীব্র বিরোধিতা করে বলে,’ ভারত ছাড়ো আন্দোলন ভারতকে নৈতিক ও বাস্তবিক ভাবে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাচ্ছে।’
ভারত ছাড়ো আন্দোলনের সময় সি.পি.আই এক অভিনব প্রস্তাব গ্রহণ করে। এই প্রস্তাবে সাম্রাজ্যবাদী দমননীতিকে কিঞ্চিৎ নিন্দা করা হয় এবং একই সাথে মুক্তি সংগ্রামীদের ‘উন্মাদ দেশপ্রেমিক’ হিসাবে আখ্যায়িত করা হয়।১৯৪৩ সালের মে- জুন মাসে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির প্রথম কংগ্রেসে যে রাজনৈতিক প্রস্তাব গৃহীত হয়েছিল তাতে কংগ্রেসকে ‘ভারত ছাড়ো’ প্রস্তাব গ্রহণের জন্য নিন্দা করা হয়।এই রাজনৈতিক প্রস্তাবের নাম ছিল Forward to unity in Action.
শুধু তাই নয় জেল থেকে পালানো জয়প্রকাশ নারায়ণ,অচ্যুত পট্টবর্ধন,অরুণা আসফ আলি,রামমনোহর লোহিয়া প্রমুখকে পুলিশে ধরিয়ে দেওয়াটা ছিল কমিউনিস্টদের মহান আন্তর্জাতিক কর্তব্য।কেবল তাই নয়,বহু কমিউনিস্ট ক্যাডার বিপ্লবী সেজে আন্দোলনকারীদের গুপ্ত সংগঠনে ঢুকে গিয়ে প্রকৃত ত্যাগী বিপ্লবীদের পুলিশের হাতে ধরিয়ে দিত এবং মামলার সময় রাজসাক্ষী হয়ে যেত।এম এন রায়ের নির্দেশে শ্রমিকরা ইংরেজদের বিরুদ্ধে ধর্মঘট হতে বিরত থেকেছিল।
রণদিভে ১৯৪৮ সালে কলকাতার সি.পি.আই.- এর দ্বিতীয় কংগ্রেসে পার্টির নেতিবাচক অবস্থান গ্রহণের কথা স্বীকার করেন।রণদিভে তাঁর প্রতিবেদনে বলেন যে,সরকারের সহিত সহযোগিতার নীতি গ্রহণের ফলে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি সংগ্রাম বিমুখ হয়ে পড়েছিল এবং জনসাধারণ তাদের প্রতি আস্থা হারায়।
✍️সন্দীপ মুখোপাধ্যায়।
গ্রন্থসূত্র-
ভারত ছাড়- নৃপেন্দ্র নাথ সিংহ।
আধুনিক ভারত- শুচিব্রত সেন, অমিয় ঘোষ- (৪৪৭-৪৪৮ পাতা)।
জ্যোতিবসুকে চিনেছিলেন শ্যামাপ্রসাদ -সুখরঞ্জন সেনগুপ্ত(২১-২৪ পাতা)।
ভারতীয় রাষ্ট্রচিন্তা পরিচয় – অশোক কুমার মুখোপাধ্যায় (৪৭৭ পাতা)।
আধুনিক ভারত ২ য় খণ্ড- প্রণব কুমার চট্টোপাধ্যায় -(২২৪-২২৬ পাতা)।
কে এই শ্যামাপ্রসাদ- কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায় ও পিনাকী পাল(১৭ পাতা)।