রাষ্ট্রপতি শাসন জারি করে রাজ্যে কোনভাবেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে শহিদ হতে দেওয়া যাবে না

কেমন আছে পশ্চিমবঙ্গ ?
লোকসভা ভোটের আগে এবং পঞ্চায়েত নির্বাচনের পরের সময়টুকুতে মানুষের উত্তর ছিল—ভালো নেই। গণতন্ত্র বিপন্ন। মানুষ বিপন্ন।
২০১৯-এর লোকসভা ভোট মিটে গেছে। সরাসরি কেন্দ্রীয় অসামরিক প্রতিরক্ষা বাহিনীর কঠিন প্রহরায়। এখন কেমন আছে পশ্চিমবঙ্গ ? উত্তর সেই একই—ভালো নেই। বরং আগের তুলনায় সমস্বরে মানুষের হাহাকারের তীব্রতা অনেক বেশি। এখন এ রাজ্যে শুধু গণতন্ত্রই বিপন্ন নয়, বিপন্ন সংবিধানও। বিপন্ন যুক্তরাষ্ট্রীয় গঠনতন্ত্র এবং দূরাগত হলেও এ লক্ষণ বেশ স্পষ্ট যে রাজ্যে রাষ্ট্রদোহের বীজও বোধহয় অঙ্কুরিত হতে চলেছে যেখান থেকে হয়তো একদিন দাবি উঠবে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের ‘বাংলা ভাষা ও বাঙ্গালিকে বাঁচানোর স্লোগান তুলে।
সকাল-দুপর-বিকেল-রাত—গোটা দিন এ রাজ্যের প্রতিটা জেলার প্রতিটি এলাকা তটস্থ কখন কী হয়ে যায়। বোমাবর্ষণ, গুলি চালনা, বাড়িতে আগুন লাগানো—এসব তো জলভাত। দিনদুপুরে পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জ থেকে গুলি করে মারা হচ্ছে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে। লোকসভা ভোটে জনগণ মুখ। ফিরিয়ে নিলেও শাসকদলের এখনও লক্ষ্য রাজ্যকে বিরোধীশূন্য করে তোলা। তাই টার্গেট শুধু বিজেপি নয়, সিপিআই(এম) এবং কংগ্রেসও। ২০০৯-১০ সালে বামফ্রন্ট প্রশাসনের অন্তিম লগ্নে রাজ্য যেমন পৌছে গিয়েছিল অরাজকতার শিখরে, এখনও রাজ্যের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতিটা ঠিক তেমনই। শুধু রাজনীতিই নয়, প্রশাসনের সর্বক্ষেত্রে চরম অস্থিরতা, মাৎস্যন্যায় চলছে। একটা রাজ্যে সাতদিন ধরে সমস্ত সরকারি হাসপাতাল বন্ধ থেকেছে—এমন নজির আছে। নাকি ভারতবর্ষে? পথ দেখিয়েছে পশ্চিমবঙ্গ। প্রশাসনের হুমকি, পুলিশের উৎপীড়ন, শাসকদলের সরাসরি অত্যাচারের মুখে জনগণের প্রশ্ন—এরপরও কি রাজ্য এভাবেই চলবে না কি জারি হবে সংবিধানের ৩৫৬ ধারা? সরাসরি রাষ্ট্রপতি শাসনে চলে যাবে পশ্চিমবঙ্গ?
এ প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার আগে দেখে নেওয়া যাক সংবিধানগত পদ্ধতি অনুসারে কখন একটি রাজ্যে ৩৫৬ ধারা প্রয়োগ করা যেতে পারে।
প্রথমত, রাষ্ট্রপতির শাসন জারি হবে তখনই যখন কোনো রাজ্যের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়।
দ্বিতীয়ত, এই কঠোর আইন প্রয়োগ করা। হবে, যদি রাজ্য সরকারের প্রশাসনের অবস্থা বেহাল হয়ে পড়ে।
তৃতীয়ত, যদি কোনো রাজ্য সরকার জাতীয় সংহতি বিরোধী কাজে লিপ্ত হয় এবং পৃথক সার্বভৌত্বের দাবি করে, তাহলে রাষ্ট্রপতিরশাসন জারি অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়ে।
চতুর্থত, যদি কোনো রাজ্য প্রশাসন রাজ্যের জনগণের মধ্যে রাজনৈতিক বিভেদপন্থা সৃষ্টি করে এবং সংবিধানকে অমান্য করে রাজ্যের গণতান্ত্রিক সামাজিক অনুশাসনকে ভঙ্গুর করে তুলতে চায়, তাহলেও সংবিধানের ৩৫৬ ধারা প্রয়োগ করা যেতে পারে।
সংবিধানের এই সূত্রগুলি অনুসারে পশ্চিমবঙ্গের এখন যে অবস্থা, তাতে রাষ্ট্রপতির শাসন প্রয়োগ করার পূর্ণ সমর্থনযোগ্য পরিবেশ রয়েছে। খুনখারাপি, রাজনৈতিক অস্থিরতা, বিরোধী দলগুলিকে হেনস্তা করা এসব তো আছেই। দেশদ্রোহ বা। রাজ্যের জনসংহতিনষ্টকরার প্রবণতাও রাজ্য প্রশাসনের মধ্যে স্পষ্টতই বিদ্যমান। হিন্দু-মুসলমান বিভাজন, বাঙ্গালি-বিহারি বিভাজন, পাহাড়ি জনজাতি বিভাজন, বনবাসী-জনজাতি বিভাজন সম্পর্কে আপত্তিকর মন্তব্য প্রকাশ করে ইতিমধ্যেই মুখ্যমন্ত্রী বুঝিয়ে দিতে চেয়েছেন তিনি কোন পথে এগোবেন। তাছাড়া, ২০১১ সাল থেকেই বাংলা বাঁচাও বাঙ্গালি বাঁচাও স্লোগান তুলে একদল মানুষ কারণে অকারণে রাজপথে মিছিল বের করে। বিভ্রান্তি ছড়ায়। মানুষকে ভুল বোঝায়। এমনকী স্বপ্ন দেখায় বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গ ফের এক হবে এবং স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবে। রাজনীতির সঙ্গে গভীরভাবে সম্পৃক্ত জনগণ জানে ওই গোষ্ঠীর পিছনেও শাসকদলের আশীর্বাদ আছে। কারণ গোটা দেশটাকেইনড়বড়ে করে দেওয়ার জন্য এর চেয়ে বড়ো অস্ত্র আর কিছু হতে পারে না।
কিন্তু তবুও মনে রাখা দরকার একটি গণতান্ত্রিক ভাবে নির্বাচিত সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করার ক্ষেত্রে এই সমস্ত সূত্রগুলো যতই সত্য হোক না কেন, চরম অনুশাসন প্রয়োগের আগে রাজ্যের রাজনৈতিক পরিস্থিতিটাও ভালভাবে অনুধাবন করে নেওয়া জরুরি।
এরাজ্যে মানুষ এখন শাসকদল এবং সরকার বিরোধী। সবাই না হলেও বেশিরভাগ মানুষই। কিন্তু মনে রাখতে হবে, এখনও ৪৩ শতাংশ ভোট রয়েছে শাসকদলের জিম্মায়। সুতরাং ৩৫৬ ধারা হঠাৎ প্রয়োগ বুমেরাং হয়ে যেতে পারে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো অত্যন্ত কৌশলী রাজনীতিবিদ প্রয়োজনে আবার ঘন ঘন মিথ্যে কথা এবং রাজ্যের মানুষের মন ভেজানো কথা বলে সহানুভূতির ভোটে জিতে যেতে পারেন।
দ্বিতীয়ত, বিজেপির উত্থান হয়েছে অতি সম্প্রতি। এরাজ্যে দলের ভোট এখনও ৪০ শতাংশ হলেও মনে রাখতে হবে এই ভোটের একটা অংশ এসেছে সিপিআই(এম) থেকে এবং কিছুটা এসেছে কংগ্রেস থেকে। এই ভোটগুলো যে কোনোসময় ঘুরে যেতে পারে কংগ্রেস এবং সিপিআই(এম)-এর দিকেই। সুতরাং দলের ভোটব্যাঙ্ককে আরও মজবুত না করা পর্যন্ত ৩৫৬ ধারার প্রয়োগ হবে চরম মূর্খামি।
তৃতীয়ত, সংবিধানের ৩৫৬ ধারা অনুযায়ী অভ্যন্তরীণ সমস্যা থেকে রাজ্যকে রক্ষার ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় সরকারেরও কিছু কর্তব্য রয়েছে। সুতরাং ৩৫৬ ধারা প্রয়োগের আগে কেন্দ্রকেও নিশ্চিত হতে হবে যে তাদের দায়িত্ব তারা পালন করছেন। চতুর্থত, তৃণমূল কংগ্রেস ভেঙে দলছুট যারা সরাসরি বিজেপি-তে যোগ দিচ্ছেন, তাদেরও বেশ কিছুদিন পর্যবেক্ষণে রাখা প্রয়োজন। তৃণমূল কংগ্রেসের ‘চর’ হিসেবে কেউ কেউ যে আসছেন না, তা জোর করে বলা যাবে না। সেক্ষেত্রে বিজেপি-র অভ্যন্তরীণ তথ্যাদি পৌঁছে যাবে তৃণমূল কংগ্রেসের কাছে যা কেন্দ্রীয় সরকারের চরম ক্ষতির কারণ হয়ে উঠতে পারে।
এই সঙ্গে এটাও মনে রাখা প্রয়োজন, ৩৫৬ ধারার প্রয়োগ এখন আর আইনি পর্যালোচনার বহির্ভুত বিষয় নয়। ১৯৯৪ সালেই সুপ্রিম কোর্ট নির্দেশ দিয়েছে, কোন রাজ্য সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করার আগে, সেই রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীকে সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রমাণের সুযোগ দিতে হবে। এরাজ্যে নতুন বিধানসভা নির্বাচন না হওয়া পর্যন্ত রাজ্য বিধানসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠতা তৃণমূল কংগ্রেসেরই রয়েছে। যদিও শক্তপোক্ত দেওয়ালের পলেস্তারা ধসে পড়ার মতো একটা দুটো করে বিধায়ক কমছে তৃণমূলের। কারণ তারা বিজেপি-তে যোগ দিচ্ছেন। সেজন্য একটু সময় নেওয়া প্রয়োজন। রাজনৈতিক পরিস্থিতি বুঝিয়ে দিচ্ছে, তারা খসা এখন চলতেই থাকবে। সুতরাং এমনটা হওয়াও আশ্চর্যজনক নয় যে তৃণমূল কংগ্রেস দলটিই আরও কয়েকমাসের মধ্যে ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যাবে। এমনও হতে পারে একদা নব কংগ্রেসের মতো নব তৃণমূল কংগ্রেস তৈরি হবে এবং বিজেপি-র সঙ্গে হাত মেলাবে।
সুতরাং রেকর্ড ভোটে পর পর দুবার জয়ী হওয়া একটা সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করার আগে দু’বার ভাবা দরকার। এটাও মনে রাখা দরকার, ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি-র ব্যাপক উত্থান এবং চরম তৃণমূল বিরোধিতার মধ্যেও সংখ্যালঘু ভোটব্যাঙ্ক উজার করে ভোট দিয়েছে তৃণমূল কংগ্রেসকে। সংখ্যালঘু ভোটব্যাঙ্কের কোনো কোনো লোকসভা কেন্দ্রে তৃণমূল বিরোধী প্রবণতা দেখালেও, বিজেপি-কে ওই ভোটব্যাঙ্ক কবজা করতে এখনও অনেক লড়াই করতে হবে। পশ্চিমবঙ্গের মতো রাজ্যে তাই নিজেদের শেকড় শক্ত করতে বিজেপি-কে আরও একটু সময় নিতে হবে।
কেন্দ্রীয় সরকার এবং বিজেপি-র কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব অবশ্যই এ ব্যাপারে যথেষ্ট সজাগ। পশ্চিমবঙ্গে এর আগেও চারবার (জরুরি অবস্থা বাদে) রাষ্ট্রপতির শাসন জারি হয়েছে। এরমধ্যে তিনবারই ৩৫৬ ধারা প্রয়োগ করা হয়েছে রাজনৈতিক কারণে। কোনোবারেই ফল কেন্দ্রের পক্ষে যায়নি। সংবিধান প্রণেতা বাবাসাহেব ভিমরাও আম্বেদকর নিজেই ৩৫৬ ধারাকে Dead Letter হিসেবে মর্যাদা দেওয়ার কথা বলেছিলেন। অর্থাৎ যতটা কম ব্যবহার করা যায়, ততটাই মঙ্গল।
এবারেও যদি সমস্ত পরিস্থিতি ৩৫৬ ধারার অনুকূলে থাকে তাহলেও অগ্র-পশ্চাৎ বিবেচনা করেই এগোতে হবে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে কিছুতেই শহিদ হতে দেওয়া যাবে না। সময় তাঁকে খুব তাড়াতাড়ি গ্রাস করে ফেলবে।
সুজিত রায়

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.