সাগরের অতলতলে দেবী গঙ্গার প্রবেশ, বরিশালের কামান ও সৈকত শহর দীঘার রহস্যজনক ভয়ঙ্কর শব্দ, সবকিছু কি একসূত্রে গাঁথা? বঙ্গোপসাগরের নীচে কি লুকিয়ে রয়েছে গভীর কোনো রহস্য, সাধারণ বুদ্ধিতে যার ব্যাখ্যা করা যায় না!
হিন্দু শাস্ত্রে বঙ্গোপসাগরের যে স্থানে গঙ্গা দেবী পাতালে প্রবেশ করেন বলে উল্লেখ করা হয়েছে, সেই স্থানকে “অতলতল” বলা হয়। বঙ্গোপসাগরের মালঞ্চ মোহনা ও রায়মঙ্গল থেকে দক্ষিণ দিকে ২১° – ২২° অক্ষরেখায় এই অতলতলের অবস্থান। তীরবর্তী অঞ্চল থেকে ১৫ মাইল দূরত্বে অবস্থিত এই স্থানের চারিদিকে জলের গভীরতা মাত্র ৫০-৬০ ফুট হলেও অতলতলের অতলস্পর্শী খাতের গভীরতা ১৭০০-১৮০০ ফুটেরও বেশি। গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র ব-দ্বীপের পশ্চিমে অবস্থিত এই গভীর খাতটি “গঙ্গা খাত” বা “Swatch of No Ground” নামে পরিচিত। স্থানীয় জেলেরা তাদের বাঁশের হিসাব “বাম” অনুযায়ী কোনো তল না পেয়ে এই অঞ্চলটির নাম রাখেন “নাই বাম” অর্থাৎ যার তল নেই। খাতটি লম্বায় প্রায় ৩০০ কিলোমিটার এবং চওড়ায় ২৫ কিলোমিটারের মতো।
এই অতলস্পর্শী খাতের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে এক অদ্ভুত ব্যাখ্যাতীত রহস্য। সুন্দরবন অঞ্চলে আষাঢ়-শ্রাবণ মাসের দিকে মাঝেমাঝে দক্ষিণ বা দক্ষিণ-পূর্ব কোণ থেকে কামানের আওয়াজের মতো একপ্রকার গুরুগম্ভীর জোরালো শব্দ শুনতে পাওয়া যেত। সেই ভয়াবহ শব্দে কেঁপে উঠত বাড়িঘর, পায়ের নিচের মাটি। কখনও কখনও একটি শব্দ শোনা যেত, আবার কখনও দুই বা তিনটি শব্দ একসাথে শোনা যেত। এই সম্পর্কে এদেশে বহু আজগুবি প্রবাদ প্রচলিত আছে। হিন্দুরা বলে, লঙ্কাদ্বীপে রাবণের প্রাসাদের বিশাল তোরণদ্বার খোলা বা বন্ধ করবার সময়ে এইরূপ শব্দ হয়।
১৮৭৬ খ্রীষ্টাব্দে অবিভক্ত বাংলার বরিশালের ম্যাজিস্ট্রেট হেনরি বেভারিজ তাঁর “The District of Bakerganj – It’s History and Statistics” গ্রন্থে সর্বপ্রথম এই রহস্যময় শব্দের বিষয়ে লেখেন। তাঁর লেখা থেকে জানা যায়, ফেব্রুয়ারি থেকে অক্টোবর মাসে বর্ষার প্রারম্ভে বরিশালের দক্ষিণ কিংবা দক্ষিণ পশ্চিমে বঙ্গোপসাগর থেকে অদ্ভুত কিছু ভয়ঙ্কর আওয়াজ শোনা যায়, যা অনেকটা কামানের গর্জনের মতো মনে হয়। তিনি এই শব্দকে “Guns of Barisal” বা “বরিশালের কামান” বলে উল্লেখ করেন।
এই শব্দ রহস্য উদঘাটনের চেষ্টা ব্রিটিশদের সময় থেকে শুরু হয়। ইংরেজদের প্রাথমিক ধারণা ছিল, ডাচ কিংবা পর্তুগিজ জলদস্যুরা সমুদ্রের কোথাও গোপন ঘাঁটি বানিয়ে ভয় দেখানোর জন্য এই আওয়াজ করছে। কিন্তু তন্নতন্ন করে খুঁজেও কোনো জলদস্যু জাহাজ বা ঘাঁটির খোঁজ পাওয়া যায়নি।
পরে ধারণা করা হয়, বঙ্গোপসাগরের গভীরে হয়তো কোনো আগ্নেয়গিরি রয়েছে আর এই আওয়াজ সেই আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎপাতের। কিন্তু অনুসন্ধানে এমন কোনো নজির পাওয়া যায়নি। আরেক দলের যুক্তি, সমুদ্রে কোথাও মৃত গ্যাসক্ষেত্র আছে এবং এই শব্দের উৎপত্তি সেখানে। এবারে ব্রিটিশরা উপকূল ঘেঁষে সন্ধান চালায় কিন্তু এমন কোনো গ্যাসক্ষেত্র খুঁজে পাওয়া যায় না। এরপরে ভাবা হয়, সমুদ্রের নিচে টেকটোনিক প্লেটের নড়াচড়ার ফলে এই শব্দ হয়। তবে জোরালো প্রমাণের অভাবে সেই যুক্তিও বাতিল হয়। এগুলি ছাড়াও অনেকের ধারণা ছিল ভূমিকম্প, কেউ বলত বজ্রপাত আবার কারো মতে মোহনার ঢেউয়ের আঘাত ইত্যাদি। কিন্তু উপযুক্ত প্রমাণের অভাবে কোনো যুক্তিই ধোপে টেঁকেনি।
শেষপর্যন্ত বেভারিজ সাহেব বহু গবেষণার পর স্থির করেন যে এই শব্দ বঙ্গোপসাগরের নীচের “গঙ্গা খাত” বা অতলতল থেকে উদ্ভূত হচ্ছে এবং বায়ুমন্ডলের কোনো বৈদ্যুতিক বিষয় এর সঙ্গে সম্পর্কিত।
বরিশালের কামান ও অতলতলের মধ্যে কার্যকারণ সম্পর্ক আছে কিনা তা নিশ্চিতভাবে বলা না গেলেও দুটি বিষয়েরই অস্তিত্ব প্রমাণিত। এই অমীমাংসিত রহস্য সম্পর্কে আরও বৈজ্ঞানিক গবেষণার প্রয়োজন।
সর্বশেষে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য, ২০১৭ খ্রীষ্টাব্দে এই ধরনের বিকট শব্দে কেঁপে উঠেছিল আমাদের সুপরিচিত সৈকত শহর দীঘা। ফাটল ধরেছিল মোহনার মাটিতে, ভেঙ্গে পড়েছিল হোটেলের কাঁচ। শব্দের তীব্রতা এতটাই বেশি ছিল যে তা শোনা গিয়েছিল ২০ কিলোমিটার দূরের তাজপুর, মন্দারমণি থেকেও। এই শব্দ কিসের ছিল বা তার উৎসস্থল কি তা আজও জানা যায়নি। তবে কি অতলতল থেকে উদ্ভূত এই সেই শব্দ, যা আজ থেকে ১৫০ বছর পূর্ব্বে হেনরি বেভারিজ সাহেব তাঁর গ্রন্থে উল্লেখ করেছিলেন?
নিশ্চিতভাবে বলা না গেলেও আপাতদৃষ্টিতে পারস্পরিক সম্পর্কবিহীন ঘটনাগুলি কিন্তু সেরকমই ইঙ্গিত দেয়। বিজ্ঞান অনেক কিছু জানলেও আজও সমাধান করতে পারেনি “বরিশালের কামানের” রহস্য থেকে হাল আমলের দীঘার রহস্যজনক শব্দের উৎপত্তি। তবে কি বঙ্গোপসাগরের নীচের “গঙ্গা খাত” বা অতলতলে লুকিয়ে রয়েছে গভীর কোনো রহস্য, সাধারণ বুদ্ধিতে যার ব্যাখ্যা করা যায় না?
© 2021 Temples with Atanu