“ফজরের থেকে প্ৰভাত ভাল। বলতেও শুনতেও“। কথাটির পাশে প্রভাতের স্নিগ্ধ ছবি। নিচে লেখা, “মোদের গরব মোদের আশা আ মরি বাংলা ভাষা। ২০শে সেপ্টেম্বর পশ্চিমবঙ্গ মাতৃভাষা দিবস।“
এভাবেই ফেসবুকে লাগাতার প্রচার শুরু করেছে জাতীয়তাবাদী গোষ্ঠী ‘পশ্চিমবঙ্গের জন্য‘। কোনও সচিত্র পোস্টে লেখা “দুয়া-র থেকে প্রার্থনা ভাল“। কোনওটিতে “গোস্ত-এর থেকে মাংস ভাল“। কোনওটিতে “পানির থেকে জল ভাল“। প্রতিটি পোস্টে সংশ্লিষ্ট ছবি এবং নিচে লেখা, “মোদের গরব মোদের আশা আ মরি বাংলা ভাষা। ২০শে সেপ্টেম্বর পশ্চিমবঙ্গ মাতৃভাষা দিবস।“
কেন এরকম প্রচার? উদ্যোক্তাদের দাবি, বাংলা ভাষায় ইসলামিকরণের আগ্রাসন রুখতে এটা খুব দরকার। ‘পশ্চিমবঙ্গের জন্য’ লিখেছে— “কোন দেশেতে তরুলতা- সকল দেশের চাইতে শ্যামল?”
- ছোটোবেলায় ছন্দের যাদুকর সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের সেই বিখ্যাত কবিতাটি অনেকেই পড়েছেন। আর
এবার বাঙ্গলায় কবিতার প্রথম বাক্যটি লিখে গুগুলে খুঁজুন তো! পাবেন না পুরোটা। শেষের দুটি স্তবক পাবেন না। গুগুলে বাঙ্গলা ভাষায় যারা লেখালেখি করে তাদের মধ্যে হিন্দু সংখ্যালঘু। তাই হিন্দুয়ানীর গন্ধওয়ালা ‘চণ্ডীদাসের—রামপ্রসাদের— কণ্ঠ কোথায় বাজে রে ?’ বাদ। বাংলাদেশে বাউল স্বরে মধুর গান’ আজ আর শোনা যায় না। তাই বাদ।“
এখানেই শেষ নয়, লেখা হয়েছে, “আর শেষের স্তবকটি তো আরো মারাত্মক।
‘মোদের পিতৃপিতামহের—
চরণ ধূলি কোথা রে?
সে আমাদের বাংলাদেশ,
আমাদেরি বাংলা রে।’
বাঙ্গালী হিন্দুকে তাদের ‘পিতৃপিতামহের চরণ ধূলি’ কোথায় ছিল, এ কথা স্মরণ করানো ঘোরতর পাপ। ও দেশটা যে তাদেরও ছিল, সে কথা বারবার উচ্চারিত হলে ‘সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি’ লঙ্ঘিত হওয়ার প্রবল সম্ভবনা। হিন্দুরা ঘুমিয়ে আছে। অতীত ভুলে গেছে। শ্মশানের শান্তি বঙ্গভূমিতে। তাই তাদের জাগানো হয় না।“
সদ্য প্রকাশিত (২০ ভাদ্র ১৪২৮ ।। ৬ সেপ্টেম্বর ২০২১ সংখ্যা) ‘স্বস্তিকা’ ‘পশ্চিমবঙ্গের ভাষাদিবস’ শিরোনামে সম্পাদকীয়তে লিখেছে, “পৃথিবীর প্রতিটি মানবগোষ্ঠীরই একটি মাতৃভাষা রহিয়াছে। সেই ভাষা তাহাদের চেতনার ভাষা। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলিয়াছেন, মাতৃভাষা মাতৃদুগ্ধ সম। মাতৃদুগ্ধ ছাড়া যেমন শিশুর বিকাশ সম্ভব নয়, ঠিক তেমনই যেকোনো জাতির উদ্ভব, বিকাশ ও প্রকাশের ক্ষেত্রে মাতৃভাষার গুরুত্ব অনস্বীকার্য। মাতৃভাষা যেকোনো জাতির সাহিত্য-শিল্প-সংস্কৃতির ধারক ও বাহক। যেকোনো জাতিকে জানিতে হইলে, তাহার শিকড়কে জানিতে হইলে, সেই জাতির মাতৃভাষাকে জানা একান্ত প্রয়োজন। ভাষার শুদ্ধতা জাতিকে সমৃদ্ধ করে। বাংলাভাষা বাঙ্গালি জাতির প্রাণের ভাষা। বাঙ্গালির জাতিসত্তা রক্ষার ভাষা। কবি অতুলপ্রসাদ সেন বলিয়াছেন, ‘ মোদের গরব মোদের আশা আ-মরি বাংলাভাষা’। মধুকবি বলিয়াছেন, ‘ হে বঙ্গ ভাণ্ডারে তব বিবিধ রতন’। সেই বাংলাভাষার উপর আক্রমণ নামিয়া আসিয়াছে বহু পূর্বেই।
আরবীকরণের চক্রান্তে বাংলাভাষার বৈশিষ্ট্য লুপ্ত হইতে বসিয়াছে। ইহাতে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ক্ষুব্ধ হইয়াছিলেন। পশ্চিমবঙ্গের বাঙ্গালিদের ইহাতে কিন্তু ভ্রূক্ষেপ নাই। তাহারা অন্য দেশের ভাষা আন্দোলনের দিনটি লইয়া মাতিয়া ওঠেন। যে একুশে ফেব্রুয়ারি লইয়া পশ্চিমবঙ্গের তথাকথিত বুদ্ধিজীবীরা নাচানাচি করিতেছেন তাহার সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের কোনোপ্রকার সম্পর্ক নাই। কেননা বাংলাদেশের আরবি-আধিক্য বাংলায় পশ্চিমবঙ্গের বাঙ্গালিরা কথা বলেন না।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশ গঠিত হইবার পর বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলনের প্রচার হইয়াছে বিশ্বময়। পশ্চিমবঙ্গের একটু শিক্ষিত বাঙ্গালিরা সালাম, বরকত, আবুল, জব্বারদের নাম জানেন। কিন্তু পূর্ববঙ্গে বাংলাভাষার দাবিতে যিনি সর্বপ্রথম সরব হইয়াছিলেন, যাঁকে সপরিবারে পাকিস্তানি খানসেনারা নৃশংসভাবে হত্যা করিয়াছে, সেই ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের নাম কেউ স্মরণ করেন না। ১৯৬১ সালে অসমের শিলচরে বাংলাভাষার জন্য ১১ জন প্রাণবলিদানকারীর নাম পশ্চিমবঙ্গের খুব কম মানুষই জানেন। পশ্চিমবঙ্গের তথাকথিত বুদ্ধিজীবী ও সংবাদপত্রগুলি এই বিষয়ে একেবারেই নীরব।
ভাষাদিবস রূপে যদি পালন করিতেই হয় তাহা হইলে ২০ সেপ্টেম্বর পশ্চিমবঙ্গের বাঙ্গালিদের স্মরণীয় ও পালনীয় দিন। এই দিন বাংলাভাষার উপর উর্দু আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করিয়া বাঙ্গালি ছাত্রদের প্রাণ বলিদানের দিন। ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসে উত্তরদিনাজপুর জেলার দাড়িভিট উচ্চ বিদ্যালয়ে ছাত্র ছাত্রীরা বাংলাভাষার শিক্ষকের দাবিতে আন্দোলন শুরু করে। বাংলাভাষার শিক্ষক না থাকা সত্ত্বেও বাংলাভাষার শিক্ষক নিয়োগ না করিয়া উর্দুভাষার শিক্ষক নিয়োগ করা হয়। এইরূপ অন্যায়ের প্রতিবাদে মাতৃভাষাপ্রেমী ছাত্র-ছাত্রী, প্রাক্তন ছাত্র-ছাত্রী এবং গ্রামবাসীরা বিক্ষোভে শামিল হন। উর্দু-আরবিপ্রেমী রাজ্য সরকারের পুলিশ সেই শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে গুলি চালিয়ে রাজেশ সরকার ও তাপস বর্মন নামে দুই ছাত্রকে হত্যা করে। দশম শ্রেণীর এক ছাত্রও পায়ে গুলিবিদ্ধ হয়। লাঠির আঘাতে বহু ছাত্র-ছাত্রী জখম হয়। পশ্চিমবঙ্গের জাতীয়তাবাদী মানুষ রাজ্য সরকারের এইরূপ বর্বরোচিত আচ গর্জে ওঠেন। জাতীয়তাবাদী সংগঠন অখিল ভারতীয় বিদ্যার্থী পরিষদ ইহার প্রতিবাদে বৃহত্তর আন্দোলন সংগঠিত করে। কিন্তু দুঃখের বিষয়, রাজ্য সরকার অদ্যাবধি কোনোরূপ সদর্থক পদক্ষেপ গ্রহণ করে নাই। বাংলাভাষার উপর উর্দুর আগ্রাসনের প্রতিবাদে ছাত্রদের প্রাণবলিদানের দিনটি স্বভাবতই পশ্চিমবঙ্গের নিজস্ব ভাষা আন্দোলনের দিন। ২০ সেপ্টেম্বর বাংলাভাষাকে রক্ষার অঙ্গীকারের দিন। তাই নিশ্চিতভাবেই ২০ সেপ্টেম্বর পশ্চিমবঙ্গের ভাষাদিবস।“
‘স্বস্তিকা’-র এই বিশেষ সংখ্যায় প্রবীর ভট্টাচার্য একটি পৃথক নিবন্ধে লিখেছেন, “বাংলাভাষার মাস। রাজেশ তাপস এই সেপ্টেম্বরের বিশ তারিখে নিজের জীবন দিয়ে আরও একবার প্রমাণ করে দিয়েছে বীরভূমির বাঙ্গালি মাথা নত করতে জানে না।“
যদিও এই মতের বিরোধিতা করেছেন প্রবীন শিক্ষাবিদ তথা প্রাক্তন উপাচার্য ডঃ পবিত্র সরকার। এই প্রতিবেদককে তিনি বলেন, আরবীকরণের চক্রান্তে বাংলাভাষার বৈশিষ্ট্য লুপ্ত হওয়ার আশঙ্কা আমি একেবারেই বিশ্বাস করিনা। মুসলমানরা তাঁদের জীবনের সঙ্গে যুক্ত বা কাছের শব্দ ব্যবহার করতেই পারেন। কেউ ফুফু, খালা বললে আমাদের আপত্তির কী আছে? এটা কোনও একটি বিশেষ রাজনৈতিক দলের প্রচার। এটিকে আমি গুরুত্ব দিতে রাজি নই।“
বিজেপি রাজ্য কমিটির সদস্য তথা বিজেপি-র উদ্বাস্তু বিষয়ক কমিটির আহ্বায়ক ডঃ মোহিত রায় বলেন, “দাড়িভিটের প্রতিবাদ জন্ম দিয়েছে পশ্চিমবঙ্গের নিজস্ব ভাষা আন্দোলন। দাড়িভিট আমাদের সুযোগ দিয়েছে বাংলা ভাষা ও বাঙালির নতুন পরিচয়কে সবার সামনে তুলে ধরতে। বাংলাভাষী হলেই সে বাঙ্গালী হয় না, তাঁকে পাঁচ হাজার বছরের ভারতীয় সংস্কৃতির উত্তরাধিকার স্বীকার করতে হয়। দাড়িভিটের ঘটনা থেকে শুরু হতে পারে রাজ্য জুড়ে মাদ্রাসা বন্ধের আন্দোলন, মাদ্রাসায় আরবি শিক্ষা বন্ধের আন্দোলন। ২০শে সেপ্টেম্বর পশ্চিমবঙ্গ মাতৃভাষা দিবস।“
বরিষ্ঠ ভাষা শিক্ষিকা সুপর্ণা চক্রবর্তীর মতে, “বাংলাদেশ, বাঙালি জাতি ও বাংলা ভাষা একে অপরের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গী ভাবে জড়িত। দেশ কালের ক্ষুদ্র সীমানায় তাকে বাঁধা যায় বলে আমি মনে করি না। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের গুরুত্ব কেবল একটি ভাষার মর্যাদা রক্ষার আন্দোলন মাত্র ছিল না। তার সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ব্যাপ্তি ছিল গভীর। সারা পৃথিবী বিস্মিত হয়ে দেখেছিল একটি ভাষার মর্যাদা রক্ষার জন্য রক্তে রাঙা হয়ে গেছে ভূমিতল ! সেই গৌরবকে পূর্ববঙ্গ ,পশ্চিমবঙ্গের সীমারেখায় আলাদা করা যায় না! সেটি শুধু বাংলাদেশের নয় আপামর বাঙ্গালীর গর্ব। তাই একুশে ফেব্রুয়ারি চিরকালের মাতৃ ভাষা দিবস।“
অশোক সেনগুপ্ত