ভাষা নীতি নিয়ে অযথা শোরগোল, শিক্ষা নীতির খসড়া প্রশংসার দাবি রাখে

আক্ষরিক অর্থেই ভারতের শিক্ষা ব্যবস্থা ও প্রণালীর ভুল ত্রুটি নিয়ে কয়েকশো নিবন্ধ লেখা হয়ে গেছে। একই সঙ্গে এ নিয়ে বই-পত্তর, চলচ্চিত্র, টিভি শো কিছুই বাদ যায়নি। সবেরই উপজীব্য ভারত ও তার শিক্ষাগ্রহণ পদ্ধতি। অবশ্যই আমরা শিক্ষানীতির গলদগুলি চিহ্নিত করে তার দূরীকরণ সম্পর্কে কেউই দ্বিমত নই। কিন্তু যেই মাত্র কেউ বেড়ালের গলায় ঘন্টা বাঁধার মতো প্রয়োজনীয় সংশোধনের কোনো প্রচেষ্টা নেয় তখনই আমরা তার ভুল ধরতে আদাজল খেয়ে লেগে পড়ি। প্রস্তাবিত পরিবর্তনগুলি সম্পর্কে এক ধরনের উন্নাসিকতা প্রকাশ ও সন্দেহ প্রবণতা আমরা চেপে রাখতে পারি না।
ঠিক এরকমটাই ঘটেছে কয়েক সপ্তাহ আগে। সরকারের নিযুক্ত একটি কমিটি তাদের বিচার বিবেচনার পর একটি জাতীয় শিক্ষা নীতির দিকনির্দেশ দিয়ে ৪৮৪ পাতার খসড়া প্রস্তাব প্রকাশ করেছে। প্রস্তাবে চলতি ব্যবস্থার গলদগুলি স্বীকার করে নিয়ে সমাধান সূত্র বের করার নির্দেশ আছে। প্রস্তাবে নানা ভাগে ছাত্র-ছাত্রীদের ভাগ করা হয়েছে এবং সেই অনুযায়ী মান যাচাইয়ের ক্ষেত্রে বিভিন্ন grade-এর প্রস্তাবনা আছে। একই সঙ্গে সমস্যাবহুল শিক্ষা ব্যবস্থাকে খানিকটা সঠিক পথে আনার একটি রোডম্যাপ তারা দিয়েছেন। এটি কখনই স্বয়ংসম্পূর্ণ নিখুঁত প্রস্তাবনা নয়। আর ঠিক সেই কারণেই এটি উৎসাহী ব্যক্তিদের কাছ থেকে উপযুক্ত পরামর্শ নিয়ে যাতে ছাত্রোপযোগী করা যায় সেই উদ্দেশ্যেই খসড়া হিসেবে প্রকাশ করা হয়েছে। নতুন ও কার্যকরী প্রস্তাব নাগরিকদের কাছ থেকে আহ্বান করা হয়েছে। এমন একটা উল্লেখযোগ্য প্রয়াস নিয়ে নিজস্ব চিন্তাভাবনা শুরু না করে খসড়া প্রস্তাব থেকে প্রধানত তিন ভাষানীতি সংক্রান্ত মনোমতো কয়েকটা লাইন তুলে নিলাম। এর পরই যুগযুগান্ত ধরে বহু চর্চিত পচনধারা উত্তর-দক্ষিণ বিভাজনের তাসটি খেললাম। দক্ষিণের রাজ্যগুলির ওপর জোর করে হিন্দি চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে বলে একটি ত্রাহি রব তুলে লোক খেপাতে শুরু করলাম। একটা হৈ হট্টগোলের পরিস্থিতি তৈরি হয়ে গেল। সকলেই জানেন ভারতে উত্তর-দক্ষিণের মধ্যে বাস্তবে একটা বিভাজন আছেই। আর এই বিভাজনটি নিয়ে সার্বিক রাজনৈতিক খেলা খেলতে পারলে লাভের সম্ভবনাও প্রবল (দক্ষিণের বহু রাজনৈতিক উত্থান পতনের উৎস ভাষা ভিত্তিক নানা আন্দোলন)। এই কৌশলে মত্ত থেকে NEP (National Education Policy)-এর মূল প্রতিবেদন ও প্রস্তাবের গুরুত্বপূর্ণ অংশগুলি আমরা বেমালুম ভুলে গেলাম। যে সমস্ত ব্যক্তি অত্যন্ত অধ্যাবসায় ও পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে শিক্ষা ব্যবস্থার গেড়ে বসে থাকা দীর্ঘদিনের সমস্যাগুলির সমাধানের প্রচেষ্টা করছিলেন। তাদের কোনো উৎসাহ না দিয়ে গোটা বিষয়টিকে হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুত্ব বা বিজেপি’র অ্যাজেন্ডা অনুসরণ করা দানব ইত্যাদি আখ্যা দিয়ে হাত ধুয়ে ফেললাম। সম্পূর্ণ ন্যক্কারজনক কাজ।
NEP সংক্রান্ত কয়েকটি ভালো দিক নিয়ে আমরা আলোচনা করব। প্রথম মনে রাখা দরকার এই কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন স্বনামধন্য ISRO-এর ভূতপূর্ব প্রধান কে, কস্তুরীরঙ্গম। আচ্ছা, আমাদের ভবিষ্যৎ সন্তানসন্তুতিরা কী পদ্ধতিতে পড়াশোনা করবে সেটা নির্ধারণের ক্ষেত্রে তার থেকে উপযুক্ত ব্যক্তি আর কেউ আছে কি? শ্রীরঙ্গমের সঙ্গে আছেন আরও দশজন শিক্ষাজগতের বিদগ্ধ পণ্ডিত। এই রিপোর্টের মুখবন্ধে একটি অসাধারণ দূরদৃষ্টি সংবলিত প্রস্তাবনা রয়েছে। ভারতের নতুন শিক্ষা পদ্ধতি এমনভাবেই নিরূপিত হওয়ার কথা বলা হয়েছে যাতে তা দেশের প্রত্যেক নাগরিকের জীবনযাত্রাকে ছুঁয়ে যেতে পারে। নাগরিক জীবনের সঙ্গে শিক্ষাপ্রণালীর এই একাত্মতায় সে নিজে দেশের পক্ষে প্রয়োজনীয় নানা উন্নয়নমূলক কাজে তার অবদান রাখার পাশাপাশি একটি ন্যায়পরায়ণ ও সকলের সমান অধিকারের সমাজ প্রতিষ্ঠার সহায়ক হবে। এর চেয়ে সুসংবদ্ধভাবে কি বিষয়টা কেউ উপস্থাপন করতে পারবে? শিক্ষানীতির রূপ ব্যাখ্যা করে বলা হয়েছে—(১) শিক্ষা হবে সকলের, (২) শিক্ষা এমন হবে যাতে ভারত বিশ্বে এগিয়ে যেতে পারবে। (৩) অধিকার ভোগের ক্ষেত্রে আরও সুষম ও নাগরিকের সমান অধিকারের সমাজ সৃষ্টির সহায়ক হবে। যখন সত্যিই কোনো বিষয় প্রসংসার দাবি রাখে তখন আমরা তা করতে পিছপা হই কেন? আমাদের মনোভাব আচরণ কি সব সময়। নেতিবাচক হবে? কেবলই সমালেচনা আর বিরূপ ব্যাখ্যার মাধ্যমে দীর্ঘদিনের কোনো সমস্যা সমাধানের প্রয়াসকে সূতিকাগারেই মেরে ফেলবে? মনে করার কোনো কারণ নেই আমি হঠাৎ করে সরকার প্রকাশিত কোনো খসড়া দলিলের তুষ্টিকরণ করতে নেমেছি। অতীতে সরকারের তরফে প্রকাশিত বহু খসড়া দলিল দেখার সুবাদে এটিকে অত্যন্ত সহজভাবে উপস্থাপিত কিন্তু সরাসরি সমস্যার মূলে পৌছতে নেমেছে বলেই আমার ধারণা। খসড়া দলিলটি সুন্দরভাবে tarmating করা হয়েছে এবং সকলের বোঝার উপযুক্ত ইংরেজিতে লেখা হয়েছে। এবারে খসড়াটির যে বিষয় নিয়ে সমালোচনা করে রাজনৈতিক ঝড় তোলা হয়েছে সেটি বিশ্লেষণ করা যেতে পারে। প্রস্তাবনা অনুযায়ী এক জন ছাত্রকে তিনটি ভাষা আবশ্যিকভাবে শিখতে হবে। এগুলি হবে ইংরেজি, যেখানে পড়াশোনা করা হচ্ছে। সেই আঞ্চলিক ভাষা (যেখানে স্কুল অবস্থিত) ও তিন নম্বরে রয়েছে। যে কোনো আর একটি ভারতীয় ভাষা শিক্ষা। এর একটা কারণ ভারতের নানা ভাষার প্রসার ঘটানো। দ্বিতীয়ত ফলশ্রুতি হিসেবে জাতীয় সংহতি বৃদ্ধি। এছাড়া চাকরির ক্ষেত্রে এক রাজ্যের নাগরিক ভিন্ন রাজ্যে চাকরি সূত্রে গেলে যদি সেখানকার ভাষাটা আয়ত্তে থাকে তা বিরাট কাজ দেবে।ভবিষ্যৎ উন্নতির ক্ষেত্রেও এই বাড়তি ভাষাজ্ঞান সুবিধে করে দেবে।
উদাহরণ এরকম হতে পারে। দিল্লির এক ছাত্র ইংরেজি শিখছে, হিন্দি শিখছে, আবার সঙ্গে তৃতীয় ভাষা হিসেবে সে তামিল শিখতে পারে। চলতি শিক্ষা ব্যবস্থায় এটা ভাবাই যায় না। কিন্তু সত্যিই যদি একটি উত্তর ভারতীয় ছেলে তামিল শেখে বা একটি গুজরাটি মেয়ে বাঙ্গলা শেখে তা হবে অসাধারণ অভিজ্ঞতা। তাদের এই দক্ষতা তারা চাকুরি ক্ষেত্রে কাজে লাগাতে পারবে। তাদের ভবিষ্যৎ নিয়োগকর্তাদের কাছেও তাদের গুরুত্ব বাড়বে।
কিন্তু একটা জায়গায় NEP-র একটু ভুল পা পড়ে গেছে। দক্ষিণ ভারতে ভাষা-ফর্মুলা লাগু করার ক্ষেত্রে ইংরেজি যেমন থাকার থাকছে সঙ্গে স্থানীয় ভাষাটি তো আবশ্যিক বটেই তবে এর সঙ্গে উল্লেখ করা হয়েছে তৃতীয় ভাষা হিসেবে হিন্দি বাধ্যতামূলক। গণ্ডগোলটা এখানেই হল। হিন্দির কথা সরাসরি না বলে যদি অন্য যে কোনো ভারতীয় ভাষা বলে ছেড়ে দেওয়া হতো সেক্ষেত্রে হল্লা করার সুযোগ অনেক কমে যেত। উত্তর ভারতের ক্ষেত্রে তৃতীয় ভাষাটি কিন্তু বাঁধাধরা নয়, সেখানে অসমীয় থেকে গুজরাটি হয়ে তামিল সবই নেওয়ার সুযোগ আছে। কিন্তু দক্ষিণে হিন্দির নামটি উচ্চারিত হয়ে গেল। দক্ষিণের লোক সর্বাঙ্গীণ সুবিধে পাওয়ার জন্য নিজেরাই হয়তো হিন্দিটিকে বেছে নিত।
তবে NEP কোনো বিধিবদ্ধ আইন নয়, তাই একে চাপিয়ে দেওয়ার প্রশ্নও উঠে না। তবুও দক্ষিণের লোকেদের হিন্দি শেখাটা দরকার। এই ধরনের লোকেদের হিন্দি শেখানো দরকার এই ধরনের কোনো ইচ্ছে জোর দিয়ে বলাটাই অবান্তর। এর ফলে দক্ষিণীদের অসন্তোষ বাড়ল, হিন্দি ভাষাকে খাটো করে দেখার সুযোগ তৈরি হলো। সর্বোপরি NEP এর সৎ উদ্দেশ্যও সন্দেহের মুখে পড়ল। তিন ভাষার প্রচলনের উদ্যোগ ভারতের শিক্ষাক্ষেত্রে নতুন নয়। শিক্ষানীতির ক্ষেত্রে বহু দশক ধরে এর প্রয়োগ করার চেষ্টাও চলে আসছে। কিন্তু প্রয়োগ প্রক্রিয়াটি সঠিক হয়নি। এখন যদি আমরা তিন ভাষাশিক্ষার ক্ষেত্রটিকে যথাযথভাবে ছাত্রোপযুক্ত করে তুলতে পারি তাহলে পড়ুয়ারাও অনায়াসে বুঝতে পারবে কোথায় তাদের সর্বাপেক্ষা বেশি সুবিধে হবে একই সঙ্গে তা দেশের পক্ষেও হিতকারী হবে।
ব্যক্তিগত ভাবে আমি মনে করি একজন উদার ভারতীয়ের পক্ষে দক্ষিণের তামিলভাষা শেখা নিশ্চিতভাবে শুধু নম্বর বাড়াবার জন্য সংস্কৃত শেখার থেকে অনেক বেশি বাস্তবসম্মত। শিক্ষা ব্যবস্থা বা ভাষা শিক্ষা উদ্দেশ্য নিয়ে অনাবশ্যক রাজনীতি করার কোনো প্রয়োজন নেই। NEP-কে পরিবর্তন পরিমার্জন করা যায়, করা উচিতও এবং একথা বলতে পারি যে তা করা হবে। কিন্তু তা করতে গিয়ে আমরা ভারতীয় ছাত্র-ছাত্রীদের শিক্ষাকেই সর্বোতোভাবে অগ্রাধিকার দেব। রাজনীতিকে কখনই নয়।
চেতন ভগত

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.