খ্রীষ্টানি নোংরামি যতদিন এই দেশ থেকে না নষ্ট হচ্ছে ততদিন কি লক্ষ্মণানন্দজীর বলিদানের যথার্থ বিচার হবে?

১৯২৪ খ্রীষ্টাব্দে ওড়িশার তালচের জেলায় জন্মগ্রহণ করা শ্রীমৎ স্বামী লক্ষ্মণানন্দজী মহারাজ তৎকালীন সামাজিক প্রথা অনুসারে অত্যন্ত অল্প বয়সে বিবাহ করেন। তাঁর দুইটি পুত্র ছিল। কিন্তু, প্রবল বৈরাগ্যের টান তাঁকে সংসার থেকে বিচ্ছিন্ন করে। মহাত্মা বুদ্ধের ন্যায় তিনি সমস্ত পারিবারিক বন্ধন উচ্ছিন্ন করে হৃষীকেশে গিয়ে তপস্যায় বসেন। ১৯৬০ খ্রীষ্টাব্দে হৃষীকেশ থেকে ফিরে এসে বিনোবা ভাবে প্রবর্তিত গোরক্ষা আন্দোলনে যোগদান করেন। ১৯৬৬ খ্রীষ্টাব্দের কুম্ভ মেলায় রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের জনৈক প্রচারক শ্রী ভূপেন্দ্রনাথ বসুর সহিত তাঁর সাক্ষাৎ হয়। ভূপেন্দ্রনাথ বসুর আগ্রহে তিনি ওড়িশার কন্ধমাল জেলার চকপড়া গ্রামে ফিরে আসেন। সেখানে জনজাতিদের মধ্যে খ্রীষ্টান মিশনারিরা খ্রীষ্টান মতের প্রচার করে আসছিল বহুদিন যাবৎ। তাদের সঙ্গে প্রত্যক্ষ যোগ রয়েছে মাওবাদী সন্ত্রাসীদের। খ্রীষ্টান মতের প্রচারের সঙ্গে সঙ্গে তারা মাওবাদীদের প্রত্যক্ষ সহযোগিতাও করত এবং মতান্তরিত জনজাতি মানুষদেরকে বাধ্য করত মাওবাদী সন্ত্রাসে যোগ দেওয়ার জন্য। এই দুই রাষ্ট্রবিরোধী, মানবতাবিরোধী গোষ্ঠীর বিচ্ছিন্নতামূলক কাজকর্মের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার সঙ্কল্প নিয়ে স্বামীজী জনজাতিদের সেবার জন্য বালিকা বিদ্যালয়, চিকিৎসালয় প্রভৃতির নির্মাণের সাথে সাথে প্রচুর যজ্ঞ প্রভৃতির আয়োজনে মনোনিবেশ করেন।
সরল জনজাতি মানুষদের মতান্তরিত করার প্রয়াসে চার্চের প্রচুর আর্থিক বিনিয়োগের সামনে স্বামী লক্ষ্মণানন্দ সরস্বতী যে পদ্ধতি নিয়েছিলেন সেটি হল জনজাতি মানুষদের মধ্য স্বাভিমান, নিজ পরম্পরা সম্বন্ধে শ্রদ্ধা জাগরণ। যারা কখনও ভয়ে বা লোভে মতান্তরিত হয়েছে, তাদেরকে তিনি পুনরায় নিজ মতে প্রত্যাবর্তন করান। সেই সময়ে ঘটনাচক্রে উগ্র মৌলবাদী মানসিকতা সম্পন্ন পেণ্টিকোস্টাল খ্রীষ্টানদের প্রবেশ ঘটে কন্ধমালে। ফলে লক্ষ্মণানন্দজীর সামনে নতুন চ্যালেঞ্জ উপস্থিত হয়। পেণ্টিকোস্টাল চার্চ বহু জায়গাতে জনজাতিদের জমি জোর করে কেড়ে নেয়। তথাকথিত সেকুলার সরকার এই বিষয়ে ছিল পুরোপুরি মূক দর্শক।
২০০৭ খ্রীষ্টাব্দে পেণ্টিকোস্টাল চার্চ খ্রীষ্ট মতে মতান্তরিতদের জন্য তফশিলি উপজাতির সংরক্ষণের দাবি নিয়ে আন্দোলন শুরু করে। নিয়মানুসারে কোন জনজাতীয় ব্যক্তি অন্য মতে মতান্তরিত হয়ে গেলে সে জনজাতিদের জন্য নির্দিষ্ট সংরক্ষণের অধিকার হারায়। এই আন্দোলনের বিরুদ্ধে সামাজিক প্রতিআন্দোলন গড়ে তোলেন।
তাঁর পবিত্র সেবামূলক ক্রিয়াকলাপের প্রভাবে কন্ধমাল জেলায় খ্রীষ্টান মিশনারি এবং মাওবাদীদের প্রভাব লক্ষ্যণীয় ভাবে কমতে শুরু করে। স্বামীজীকে দুই গোষ্ঠীই নানাভাবে বিব্রত করার চেষ্টা করে। তাঁর প্রাণনাশের হুমকিও দেওয়া হয়। কিন্তু, ঈশ্বরে সমর্পিতপ্রাণ মহাত্মাকে প্রাণের ভয় কি রুখতে পারে?
এর পর থেকেই মাওবাদী ও খ্রীষ্টানদের মিলিত প্রচেষ্টায় পুনঃপুনঃ আক্রমণ হতে থাকে স্বামী লক্ষ্মণানন্দ সরস্বতীজীর উপর। ২০০৭ খ্রীষ্টাব্দে ব্রাহ্মণীগাওঁতে স্থানীয় গ্রামবাসীদের দুর্গাপূজার স্থানটি স্থানীয় প্রশাসনের পরোক্ষ মদতে জোর করে দখল করে পেণ্টিকোস্টাল চার্চ। এর ফলে স্থানীয় হিন্দুদের সঙ্গে বিবাদ শুরু হয়। ২০০৭ খ্রীষ্টাব্দের ডিসেম্বরে এই বিষয়ে মধ্যস্থতা করার জন্য স্বামীজী সেখানে যাচ্ছিলেন। পথে দাড়িংবাড়ি গ্রামে তাঁর গাড়ির উপর হামলা চালায় খ্রীষ্টান ও মাওবাদী যুগ্ম গোষ্ঠী। তিনি ভয়ানক আঘাত পান। তাঁর গাড়ির চালক এবং নিরাপত্তারক্ষীরও প্রাণ সংশয় হয়। ঈশ্বরের কৃপায় তাঁরা সুস্থ হয়ে ওঠেন।
যেখানে এই আক্রমণ হয়েছিল সেটি ছিল কংগ্রেসের রাজ্যসভা সদস্য রাধাকান্ত নায়েকের এলাকা। রাধাকান্ত নায়েক ঘটনাচক্রে খ্রীষ্টান এভাঞ্জেলিকালদের সংগঠন World Vision-এর কর্তাব্যক্তি। লক্ষ্মণানন্দজী সরাসরি রাধাকান্ত নায়েককেই এই হামলার মূল চক্রী রূপে চিহ্নিত করেছিলেন। তিনি এই কথাও জানিয়েছিলেন যে, হামলাকারীরা হামলার সময়ে বলাবলি করছিল, “দিল্লীতে আমাদের সরকার আছে। আমরা যা খুশি তাই করতে পারি।”
এর পরেও স্বামীজীর মানব সেবার ব্রতে কিছু ন্যূনতা পরিলক্ষিত হয়নি। এর পরে আসে ২০০৮ খ্রীষ্টাব্দের ২৩ আগস্টের অভিশপ্ত কালো রাত্রি। খ্রীষ্টান ও মাওবাদীরা মিলিত ভাবে সমস্ত মানবতার মুখে চুনকালি লেপে দিয়ে, নৃশংসতার সমস্ত পর্যায়কে পার করে খুন করে স্বামীজী ও তাঁর কয়েকজন সহযোগীকে।
তাঁর উপর আক্রমণ এবং হুমকির কথা মাথায় রেখে স্থানীয় প্রশাসন তাঁর আশ্রমে নামমাত্র নিরাপত্তার ব্যবস্থা করেছিল। সেই নিরাপত্তারক্ষীদেরই একজনের জবানীতে সেই রাত্রির যে ঘটনার কথা উঠে এসেছে তাতে সভ্য সমাজ শিউরে ওঠে।
সেই দিন রাত্রিতে যে তিন জন নিরাপত্তারক্ষী আশ্রমে ছিল তারা ছিল নিরস্ত্র। (যদিও নিরস্ত্র নিরাপত্তারক্ষী প্রেষণের কোন যুক্তিগ্রাহ্য ব্যাখ্যা প্রশাসনের কাছ থেকে পাওয়া যায়নি।) কয়েকজন অস্ত্রধারী সন্ত্রাসবাদী আশ্রমে ঢুকে আসে। নিরাপত্তরক্ষীদের বন্দুকের নলের আগায় দাঁড় করিয়ে রেখে তারা তাদের রাক্ষসোচিত হত্যালীলা শুরু করে। লক্ষ্মণানন্দজী তখন নিজের ঘরের সঙ্গে সংযুক্ত স্নানঘরে ছিলেন। তাঁর ঘরে তখন তাঁর দুইজন সহযোগী শ্রীযুক্ত কিশোর বাবু এবং ভক্তিমাঈ মাতাজী ছিলেন। তাদের দুজনকেই গুলি করে মারা হয়। পাশের ঘরে বাবা অমৃতানন্দকেও গুলি করে মারা হয়। অতিথিশালায় ছাত্রীনিবাসে বসবাসকারী একজন বালিকার পিতা ছিলেন। তাকেও খুন করা হয়।
লক্ষ্মণানন্দজীর শরীরে অসংখ্য গুলি করা হয়। তার পরেও তার মৃত্য নিশ্চিত করার জন্য তার কবজি এবং গোড়ালির শিরাগুলিকে কাটা হয়।
এর পরে তারা যাওয়ার সময়ে নিরাপত্তারক্ষীর হাতে একটি কাগজ ছুঁড়ে দেয় এবং সেটি সাংবাদিকদের দিয়ে দিতে বলে। এদিকে ঘটনার কথা জানতে পেরে তৎক্ষণাৎ একজন স্থানীয় সাংবাদিক সেখানে পৌঁছান। তিনি বলেছিলেন, “চতুর্দিকে এত রক্ত এবং মৃতদেহের গন্ধ বেরোচ্ছিল যে মনে হচ্ছিল যে আমি কষাইখানায় ঢুকেছি।”
স্থানীয় সাংবাদিকরা নিজেদের প্রতিবেদনে জানিয়েছিলেন যে, পূর্বোক্ত রাধাকান্ত নায়েক এই ঘটনার কিছুক্ষণ আগেই কিছু খ্রীষ্টান প্রতিষ্ঠানকে অনির্দিষ্টকাল বন্ধ রাখার আদেশ দিয়ে ভুবনেশ্বর থেকে দিল্লীর উদ্দেশে উড়ে যায়।
এই ঘটনার পরেই ওড়িশা পুলিশ এই ঘটনার দায় চাপিয়ে দেয় মাওবাদীদের উপর। কিন্তু, চতুর্দিক থেকে সামাজিক চাপের ফলে সিআইডি এই খুনের তদন্ত হাতে তুলে নেয়। ডিসেম্বর মাসের মধ্যেই তারা মোটামুটি তদন্তের জাল গুটিয়ে আনে। তারা স্পষ্ট কোন নাম ঘোষণা না করলেও বিবৃতি দেয় যে, খুনের প্রধান ষড়যন্ত্রকারীকে চিহ্নিত করা গিয়েছে কিন্তু সে ওড়িশার বাইরে রয়েছে। স্থানীয় সংবাদমাধ্যম প্রচার করে যে, রাধাকান্ত নায়েকের বিরুদ্ধে পুলিশের নিকট পর্যাপ্ত প্রমাণ মজুদ রয়েছে।
তখন কেন্দ্রে UPA সরকারের শাসন। আদালতে এই মামলা চলতে থাকল গয়ংগচ্ছ ভাবে। ২০১৩-র অক্টোবরে সাতজনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়। এরা সকলেই মতান্তরিত খ্রীষ্টান এবং এদের মধ্যেই একজন মাওবাদী নেতা। প্রসিকিউশনের আইনজীবী স্পষ্ট শব্দে জানান যে, “দণ্ডাজ্ঞাপ্রাপ্ত সকলেই খ্রীষ্টান এবং তারা সকলেই স্বীকার করেছে যে, স্বামীজী খ্রীষ্টানদেরকে হিন্দুত্বের পথে ফিরিয়ে আনছিলেন বলেই তারা তাঁকে খুন করেছে।”
এই ভাবে কয়েকটি ব্যক্তিকে খুনের জন্য সাজা দেওয়া হলেও সমস্যার মূল কিন্তু আজও বিদ্যমান। কন্ধমাল জেলাতে লক্ষ্মণানন্দজীর মৃত্যুর পরে খ্রীষ্টানদের অমানবিক অত্যাচার অসম্ভব বৃদ্ধি পেয়েছে। কিছুদিন আগেও প্রায় ১২০০ খ্রীষ্টানের একটি দল এসে দাড়িংবাড়িতে একটি মন্দির ধ্বংস করে। এই ঘটনা ক্রমশঃ বাড়ছে। বর্তমানে কন্ধমাল জেলাতে প্রায় ১২০০ চার্চ বর্তমান। প্রতি ১২৫ জন মতান্তরিত খ্রীষ্টান পিছু একটি করে চার্চ সেখানে নির্মিত হয়। বিভিন্ন দেশের খ্রীষ্টান সংগঠন থেকে যে পরিমাণ অর্থ কন্ধমালে পাঠানো হয় তার পরিমাণ অকল্পনীয়। এই খ্রীষ্টানি নোংরামি যতদিন এই দেশ থেকে না নষ্ট হচ্ছে ততদিন কি লক্ষ্মণানন্দজীর বলিদানের যথার্থ বিচার হবে?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.