ছ’ফুট দু’ ইঞ্চি লম্বা, একশো বত্রিশ কিলো ওজন, আটচল্লিশ ইঞ্চি বুকের ছাতিসম্পন্ন এই বিশ্বজয়ী বাঙালি পালোয়ান গোবর গোহ-র আসল নাম যতীন্দ্রচরণ গোহ। বিশ্ব কুস্তির মানচিত্রে ভারতের উজ্জ্বল উপস্থিতি প্রথম যাঁর একক প্রচেষ্টায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, তাঁর কুস্তিতে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হওয়ার শতবর্ষ পূর্ণ হচ্ছে আগামী কাল। ১৯২১ সালের ঠিক এই তারিখে অলসপ্রকৃতি, ভাতঘুমপ্রিয়, শক্তিহীন বাঙালি জাতির সমস্ত অপবাদ ঘুচিয়ে বিশ্বের দরবারে এই বাঙালি পুরুষের উত্থান। শুধু ভারত নয়, তিনিই প্রথম এশীয় মল্লবীর, যিনি মার্কিন মুলুকে ইউরোপীয়দের নাকে ঝামা ঘষে বিশ্ব কুস্তির আখড়ায় প্রাচ্যের জয়ধ্বজা উড়িয়েছিলেন। তাঁর মৃত্যুর অর্ধশতক পরেও তাঁর বহু সাফল্য ও কৃতিত্ব এ দেশের কেউ ছুঁতে পারেননি। অলিম্পিক্স-সহ আন্তর্জাতিক কুস্তির এরিনায় দেশের বহুবিধ সাফল্যের মধ্যেও স্মৃতিতে বার বার একটা নামই উঠে আসে— গোবর গোহ।
আখড়ার মাটি ও গোবর
১৮৯২ সালের ১৩ মার্চ কলকাতার গোহ পরিবারে জন্মেছিলেন গোবর গোহ। পরিবারটিই ছিল কুস্তিগিরের। কনিষ্ঠ পুত্রের অত্যধিক শারীরিক ওজন, তার ওপর কালো দলাপাকানো চেহারা দেখে এই অদ্ভুত নাম রেখেছিলেন পিতা রামচরণ। এই নামের আড়ালেই চিরতরে হারিয়ে যায় যতীন্দ্রচরণ। শুধু কি তার চেহারাই তার নামকরণের জন্য দায়ী? পিতা রামচরণ হয়তো চেয়েছিলেন তাঁর আখড়ার গোবর, মাটির সংস্পর্শে অনুশীলন করে তৈরি হোক তাঁর ছেলে। নামের সামঞ্জস্যে আখড়া এবং পারিবারিক কসরতের সঙ্গে ছেলের একটা চিরস্থায়ী সম্পর্ক তৈরি করে দিয়ে যেতে চেয়েছিলেন তিনি।AdvertisementAdvertisement
কুস্তির আখড়ার মাটি তৈরি অতি গুরুত্বপূর্ণ। মাটি মেখেই প্যাঁচপয়জার, মাটিতেই গড়াগড়ি। আবার যে মাটিতে পতন, সেই মাটিতে ভর দিয়েই উঠে দাঁড়ানো। কাজেই মাটি হতে হবে একেবারে নিখুঁত। আর এই মাটি তৈরিতে গোবর অপরিহার্য, তাও প্রচুর পরিমাণে। বিশেষ করে এরিনার চার দিকের বাঁধকে শক্তপোক্ত করতে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়া হয় গোবর। এরিনার ভিতরের মাটি বাইরে বেরিয়ে যাওয়া রদ করতেই এই ব্যবস্থা। গোহ-পরিবার তাঁদের আখড়াকে দেবতা জ্ঞানে পুজো করতেন। আখড়া তাঁদের কাছে শারীরিক উপাসনার মন্দির। অক্লান্ত পরিশ্রম এবং একনিষ্ঠ সাধনায় আখড়া নির্মাণ করতেন গোহরা। দীর্ঘ সময়, মেহনত ও অভিজ্ঞতার মিশ্রণে তৈরি হত আখড়ার মাটি। একটাও কাঁকর, পাথর, ইটের টুকরো যাতে মাটির সঙ্গে না থাকে সে দিকে সদা সতর্ক নজর থাকত তাঁদের। মাটিকে নমনীয় রাখতে প্রতি দিন কুস্তিগিররা নিজেরাই কোদাল চালাতেন। পরম যত্নে মাটির সঙ্গে মেশাতেন সরষের তেল, নিমপাতা, কাঁচা হলুদ। সেই জন্যই ক্রমশ আখড়ার মাটির রং হয়ে উঠত হলদেটে। শুধু তাই নয়, মিশ্রিত অনুপানের গুণে এই মাটি অ্যান্টিসেপটিকের কাজ করত। পালোয়ানরা অভ্যেস বা লড়াইয়ের সময় এই মাটি গায়ে মাখতেন বলেই তাদের সাবান ব্যবহারের প্রয়োজন হত না। দেবতা জ্ঞানে পূজিত এই মাটির বিন্দুমাত্র যাতে অপচয় না হয়, সেই কারণে অনুশীলনের শেষে পালোয়ানদের গায়ের মাটিও টিনের পাত দিয়ে চেঁছে আখড়ার মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়া হত। সব ভেবে চিন্তেই রামচরণ তাঁর পুত্রকে আখড়ার সঙ্গে মিলিয়ে দিতে চেয়েছিলেন গোবর নামকরণের মধ্য দিয়ে।
অমৃতসর থেকে মল্লবীর
মাত্র ন’বছর বয়সে, ১৯০১ সালে গোবর গোহ পিতা রামচরণকে হারান। কিন্তু পরিবার হাল ছাড়েনি। তাঁরা সকলে চেয়েছিলেন এই শিশুর হাত ধরেই রামচরণের স্বপ্ন পূরণ হোক। গোহ-পরিবার কুস্তির ইতিহাসে নক্ষত্রের মতো জ্বলজ্বল করুক। রামচরণের মৃত্যুর পর গোবরের দায়িত্ব নেন কাকা ক্ষেত্রচরণ গোহ, তিনি স্বামী বিবেকানন্দেরও কুস্তির শিক্ষক ছিলেন। সেই কাকার অক্লান্ত প্রচেষ্টায় মাত্র ১৫ বছর বয়সেই এক জন যোগ্য পালোয়ানের সব রকম সম্ভাবনা স্পষ্ট দেখা যায় গোবর গোহর মধ্যে। তাঁর সম্ভাবনাকে আরও উজ্জ্বল, আরও শক্তিশালী করতে কাকার উদ্যোগে অমৃতসর থেকে প্রখ্যাত মল্লবীর খোসলা চৌবে ও রহমানি পালোয়ানকে আনা হয় গোবর গোহর ব্যক্তিগত প্রশিক্ষক হিসেবে। ধীরে ধীরে পেশাদার কুস্তিগির হিসেবে গোবর গোহ যখন চূড়ান্ত প্রস্তুতি নিচ্ছেন, ঠিক তখনই আবার বিপর্যয় নেমে আসে তার জীবনে। কাকা ক্ষেত্রচরণ গোহ হঠাৎই মারা যান ১৯০৯ সালে। গোবরের তখন মাত্র ১৭ বছর বয়স। দেশ ব্রিটিশ শাসনাধীন। একাধারে ইংরেজের অত্যাচার, রাজনৈতিক অস্থিরতা, তারই মধ্যে কাকার মৃত্যু বিচলিত করে তোলে কিশোর গোবর গোহকে। পেশাদার কুস্তিগির হওয়ার জন্য প্রচুর অর্থের প্রয়োজন। সেই সঙ্কটের সময়ে গোহ পরিবারকে আন্তর্জাতিক কুস্তির আঙিনায় স্বমহিমায় ধরে রাখতে ঘুরে দাঁড়ান গোবর গোহ। বুঝতে পেরেছিলেন, নিজের ব্যবস্থা নিজেকেই করে নিতে হবে।
লড়াইয়ের মাটিতেই স্বনির্ভর
১৯১০ সালে বিদ্যাসাগর স্কুল থেকে এনট্রান্স পাশ করার পর তিনি পা রাখেন পেশাদার কুস্তির জগতে। প্রথম পেশাদারি লড়াইটা হয় ত্রিপুরার মহারাজার পালোয়ান নভরং সিং-এর বিরুদ্ধে। যদিও এ লড়াই থেকে তিনি অর্থ উপার্জন করতে পারেননি। এর পর পরই দেশ ও দেশের বাইরের নানা প্রতিষ্ঠিত মল্লবীরদের পরাস্ত ও পর্যুদস্ত করতে শুরু করেন। এ ভাবেই লড়াইয়ের ময়দান থেকেই নিজের উপার্জনের ব্যবস্থা করে নিয়েছিলেন তিনি। মাত্র ১৮ বছর বয়সেই দেশীয় কুস্তির দিক ও মুখ পরিবর্তন করে দেশকে বসিয়েছিলেন আন্তর্জাতিক মানচিত্রে। প্রথাগত ধরনের বাইরে গিয়ে নিজস্ব স্টাইলে ভারতীয় কুস্তিকে দেখিয়েছিলেন নতুন দিশা। কুস্তিতে তিনি নতুন প্রয়োগ পদ্ধতিতে এনেছিলেন টিক্কি, গাধালেট, ঢাঁক, ধোবিয়া পাট এবং খুল্লা। রদ্দা ছিল তাঁর বিশেষ পছন্দের টেকনিক।
আগুন কখনও চাপা থাকে না। হাওয়ায় ছড়িয়ে পড়ে তার আলো আর উত্তাপ। লন্ডনের জন বুল সোসাইটির ব্যবস্থাপনায় বিশ্ব কুস্তি প্রতিযোগিতায় বিশ্বের তাবড় কুস্তিগিরদের সঙ্গে ভারত থেকে গোবর গোহ ও জুনিয়র গামার আমন্ত্রণ আসে। যুবক গোবর গোহর কাছে আন্তর্জাতিক কুস্তির দরজা খুলতে শুরু করে সেই সময় থেকেই।
বাঙালির বিশ্বজয়
১৯১৩-১৯১৫ সালে দ্বিতীয় ইউরোপ সফরে স্কটল্যান্ডের সর্বোচ্চ র্যাঙ্কিংপ্রাপ্ত আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন কুস্তিগির জিমি ক্যাম্পবেল, জিমি এসেনের মতো মল্লবীরদের হারিয়ে পাদপ্রদীপের আলোয় আসেন গোবর গোহ।
তৃতীয় ইউরোপ সফরটাই তাঁর কুস্তি-জীবনের সেরা সময়। এই পর্যায়েই আসে সেই দিন। ১৯২১ সালের ৩০ অগস্ট। এই তারিখে সান ফ্রানসিস্কোয় লাইট হেভিওয়েট ফ্রিস্টাইল বিভাগের বিশ্বচ্যাম্পিয়ন স্যান্টেলকে হারিয়ে তার শিরোপা নিজের দখলে নিয়ে নেন গোবর গোহ। এক ঘণ্টা তিন মিনিটের সে লড়াই মন্ত্রমুগ্ধের মতো প্রত্যক্ষ করেছিল বিশ্ববাসী। সে লড়াই আজও লোকগাথার মতো ভারতীয়দের হৃদয়ে স্থান করে নিয়েছে। শুধু শক্তি নয়, উপস্থিত বুদ্ধি, ক্ষিপ্রতা এবং কৌশল— মল্লযুদ্ধের প্রতিটি বিভাগেই স্যান্টেলকে পরাস্ত করেছিলেন গোবর। এই লড়াইয়ের স্মরণে ভারত সরকার দুই মল্লবীরের ছবি দিয়ে বিশ্ব কুস্তি চ্যাম্পিয়নশিপের প্ল্যাটিনাম জুবিলি উপলক্ষে ১৯৯৬ সালে একটি বিশেষ ডাকটিকিট প্রকাশ করে।
মল্লযোদ্ধা: ১৯৯৬ সালে কলকাতার আজাদ হিন্দ বাগে গোবর গোহর এই মূর্তি প্রতিষ্ঠা করেন তৎকালীন রাজ্যপাল রঘুনাথ রেড্ডি। মূল ছবি, প্রবীণ গোবর গোহ।
বাংলা ও ভারতের কুস্তি-প্রীতি
গোবর গোহর বিশ্বজয় দেশীয় ক্রীড়াঙ্গনে আলোড়ন ফেলে দেয়। আখড়াগুলো বিপুল উৎসাহে জোরদার প্রস্তুতি শুরু করে। গোবর বাঙালি কুস্তিগিরদের সাফল্যের রাস্তা দেখাতে পেরেছিলেন। যার প্রভাবে বহু যুবক, এমনকি যুবতীরাও উৎসাহিত বোধ করে এই বডি কন্ট্যাক্ট গেমে। উজ্জীবিত কুস্তিগিররা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক আসরে অর্জন করেন আশাতিরিক্ত সাফল্য। হকির পর কুস্তিই অলিম্পিক্সে সাফল্যের অন্যতম জায়গা হয়ে দাঁড়ায়। জেলা ও রাজ্য প্রতিযোগিতায় আশাতিরিক্ত ভিড় জমতে শুরু করে। উৎসাহ ও পৃষ্ঠপোষকতার জন্য আসরে নামেন রাজারাজড়া, জমিদাররা। মুর্শিদাবাদের মহারাজা পর্যন্ত কলকাতায় এসে কুস্তি প্রতিযোগিতার আসর বসাতেন। জমিদার খেলাৎ ঘোষ, মন্মথ ঘোষরা প্রায়শই কুস্তির আসর বসাতেন।
গোবরের বিশ্বজয়ের পরবর্তী বহু দশক বজায় ছিল এই উন্মাদনা। বাংলায় এই খেলার জনপ্রিয়তা ও আকর্ষণকে মূলধন করে দারা সিং-কিংকং অথবা দারা সিং-রনধাওয়ার মল্লযুদ্ধের কাহিনি ইতিহাস হয়ে আছে। আজও তাদের লড়াইয়ের বর্ণনা প্রবীণদের মুখে মুখে ফেরে। বড় বড় হোর্ডিং, পোস্টারে ছেয়ে যেত শহর, গ্রামাঞ্চল। বাচ্চাদের খেলনার সামগ্রীতে জায়গা করে নিয়েছিল দারা সিং-কিংকংয়ের ছবি, মূর্তি। নেতাজি ইনডোর স্টেডিয়াম ভাড়া নিয়ে এই মল্লযুদ্ধের আয়োজন করা হত। মোটা অঙ্কের টিকিট কেটে তা দেখতে আসতেন বহু মানুষ। বাণিজ্যিক দৃষ্টিভঙ্গিকে মূলধন করে এই মল্লযুদ্ধকে অবশ্য বাংলার সনাতন কুস্তি সংস্থা বাঁকা চোখেই দেখত। অতি উৎসাহিত হয়ে কুস্তিগির জাভির সিং এক বার ইচ্ছা প্রকাশ করেন দারা সিং-এর প্রতিদ্বন্দ্বী হতে। দারা সিং রাজি হননি। তিনি প্রত্যাখ্যান করেন আর এক মল্লবীর প্রণব পুরকায়স্থর চ্যালেঞ্জও।
স্বাধীনতার পরের বছরই লন্ডন অলিম্পিক্সে অংশ নিয়েছিলেন বাংলার তরুণ কুস্তিগির নির্মল বসু। পরের হেলসিঙ্কি অলিম্পিক্সেই প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন নিরঞ্জন দাস। গোবর গোহর বিশ্বজয় দেশকে উজ্জীবিত করলেও, তাঁর নিজের বাড়ির শতবর্ষপ্রাচীন আখড়া থেকে কিন্তু আর সে ভাবে জাতীয় স্তরে পদকজয়ী কুস্তিগির উঠে আসেননি।
শুধু পেশাদার ক্ষেত্রেই নয়, প্রতিযোগিতামূলক কুস্তিও ভারতীয় ক্রীড়াজগতে উজ্জ্বল ইতিহাসের সাক্ষ্য বহন করে চলেছে। কুস্তিতে আজ অবধি সাতটা পদক এসেছে অলিম্পিক্স থেকে। ১৯৫২ সালে হেলসিঙ্কি থেকে ব্রোঞ্জ পদক পান কে ডি যাদব। এর পর ৫৬ বছর অপেক্ষা করতে হয়। ২০০৮ সালে বেজিং ও ২০১২ লন্ডন অলিম্পিক্সে সুশীল কুমারের হাত ধরে আসে দু’টি পদক। ২০২০ টোকিয়ো অলিম্পিক্সে পি ভি সিন্ধুর আগে পর্যন্ত সুশীল কুমারই ছিলেন একমাত্র ভারতীয় খেলোয়াড়, যিনি দু’টি অলিম্পিক্স থেকে পদক জিতেছেন। ২০১২ লন্ডন অলিম্পিক্সেই কুস্তি থেকে আরও একটি ব্রোঞ্জ পদক আসে যোগেশ্বর দত্তর হাত ধরে। গত রিয়ো অলিম্পিক্সে ভারতীয় কুস্তির মর্যাদা অক্ষুণ্ণ রাখতে মহিলাদের ৫৮ কেজি বিভাগে ফ্রিস্টাইল থেকে ব্রোঞ্জ আনেন সাক্ষী মালিক। সদ্যসমাপ্ত ২০২০ টোকিয়ো অলিম্পিক্সে রবি কুমার দাহিয়ার রুপো ও বজরং পুনিয়ার ব্রোঞ্জ দেশের আখড়াগুলোকে আরও উৎসাহ জোগাবে। সাতটা অলিম্পিক্স পদক-সহ শতাধিক আন্তর্জাতিক মেডেল যে দেশের ঝোলায়, সেখানে গোবর গোহ আজও মহীরুহ।
রোজ আড়াই হাজার ডন-বৈঠক
গোহ-পরিবার শরীরকে মনে করতেন মন্দির। তাঁদের কাছে সেই মন্দিরের ঘণ্টাধ্বনি বাজত কুস্তিতে। তাই বংশ-পরম্পরায় কুস্তিচর্চা নিয়মিত করে যেতেন তাঁরা। শুরু করেন গোবর গোহর প্রপিতামহ অম্বিকাচরণ গোহ। শৈশবে মসজিদবাড়ি স্ট্রিটে তাঁর গড়া আখড়ায় তাঁরই কাছে হাতেখড়ি গোবর গোহর। এই আখড়ায় কুস্তির মহড়া দিতে আসতেন বৈজ্ঞানিক সত্যেন্দ্রনাথ বসু, সঙ্গীতশিল্পী মান্না দে-র মতো গণ্যমান্য ব্যক্তিরা। কুস্তিচর্চার পাশাপাশি আখড়াগুলো সে সময় হয়ে উঠেছিল স্বাধীনতা সংগ্রামীদের গোপন আস্তানাও। ইংরেজদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে শরীরচর্চা করতে আসতেন যুবকরা। ইংরেজদের বিভ্রান্ত করতে অম্বিকাচরণ কুস্তিকে ক্রীড়ায় অন্তর্ভুক্তি ঘটান। দাবি করা হয়, গোহরাই বাংলায় কুস্তির প্রতিষ্ঠাতা।
স্বদেশচেতনার এই প্রেরণাও বংশানুক্রমে পেয়েছিলেন গোবর গোহ। জালিওয়ানালাবাগ হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যখন ‘নাইট’ উপাধি ত্যাগ করেন, তখন তিনি লন্ডনে। সেখানেই প্রকাশ্যে রবীন্দ্রনাথকে সমর্থন জানিয়ে ইংরেজদের বিরুদ্ধে নিজের মত প্রকাশ করেন।
কুস্তির প্রতি মাত্রাতিরিক্ত ভালবাসা থেকেই আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি লাভের জন্য মেহনতকে সাধনার সমতুল্য করে তুলেছিলেন গোবর গোহ। রাত তিনটেয় ঘুম থেকে উঠে পড়তেন। হাতমুখ ধুয়ে আড়াই হাজার বৈঠক দিতেন। সঙ্গে পাঁচশো ডন। ঘণ্টাখানেক শারীরিক কসরত। তার পর আখড়ায় নেমে মল্লবীরদের সঙ্গে কুস্তির মহড়া। মহড়ার শেষে গলায় নাল (নিরেট পাথরের একটা চাকা) ঝুলিয়ে ছোটাছুটি। কিছুটা বিশ্রামের পর দু’মনেরও বেশি এক জোড়া মুগুর ভাঁজা। বিকেল তিনটেয় আবার আখড়ায় গিয়ে ১৮০০ ডন। ডনের পর ডাম্বেল ভাঁজা, তার পর ২৫ সের ওজনের কোদাল দিয়ে মাটি কোপানো।
এত সবের মধ্যেও রীতিমতো সাহিত্য ও সঙ্গীতচর্চা করতেন গোবর গোহ। ভারতীয় রাগসঙ্গীতের তালিম নিতেন তিনি, বাজাতেন সেতারও। তাঁর প্রিয় লেখকদের মধ্যে ছিলেন জর্জ বার্নাড শ এবং অস্কার ওয়াইল্ড।
মল্লযোদ্ধার খাওয়াদাওয়া
দীর্ঘকায়, বলশালী এই মল্লবীরের খাদ্যতালিকা শুনেই এখনকার যে কোনও বাঙালি চৈতন্য হারাতে পারেন। সকালে এক তাল বেনারসি আমলকির মোরব্বা, বাতাসা ও বেদানার গ্লাসভর্তি শরবত। তার পর সের দুই বাদামবাটার শরবত। দুপুরে দু’মুঠো ভাতের সঙ্গে দু’টুকরো মাছ। তার পর আধসের দুধের ক্ষীর। সন্ধে ও রাতের ফাঁকে ফাঁকে তিন সের খাঁটি গোদুগ্ধ। বিদেশিরা গোবর গোহকে চিনত ‘গোল্ডইটার’ নামে। বাস্তবিকই গোবর সোনা খেতেন। সোনা পিষে পাতলা ফিনফিনে পাতের মতো করে তবক বানিয়ে মুখে পুরতেন। এক ভরিতে চলত প্রায় এক মাস। রাত্তিরে শুধু খেতেন আখনি। ঘি, বাদাম, মাংস দিয়ে তৈরি এক ধরনের খাবার। কয়েক সের মুরগি বা খাসির মাংস, দেড় সের বাদামবাটা, এক সের খাঁটি ঘি, কয়েকটা এলাচ এক সঙ্গে মিশিয়ে একটা হাঁড়িতে করে কাঠের উনুনে চাপানো হত সকাল সাড়ে সাতটায়। গুমো আঁচে মাংস গলানো হত বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত। সন্ধে সাড়ে ছ’টায় এই খাবারই ছিল ডিনার। রাত্রি সাড়ে আটটায় শুতে যেতেন। বরাবর এই বিপুল খরচ গোহ পরিবার বহন করত হাসিমুখে। পারিবারিক এই খরচের মর্যাদা দিয়ে গোবর গোহ বিশ্বচ্যাম্পিয়নের শিরোপা এনে দিয়েছিলেন।
শুধু গোবর গোহই নন। এখনকার এক মল্লবীরের সঙ্গে কথা বলে জানলাম, তাঁদের পূর্বপুরুষরা সোনা, রুপো ডাস্ট করে খেতেন। এখনও এ দেশের আন্তর্জাতিক মানের মল্লবীররা দৈনিক আট থেকে দশ কিলো দুধ খান। সঙ্গে ৫০০ গ্রাম থেকে এক কেজি পর্যন্ত ঘি প্রতি দিন। আমার চোখেমুখে অবিশ্বাস দেখে বললেন, “আগেকার যুগের সঙ্গে এখনকার কোনও কিছুই মিলবে না। আমার ঠাকুরদা ১৫ টাকা মাইনের চাকরি করতেন। এক টাকায় মিলত এক গ্যালন তেল। এখন সে সব অবিশ্বাস্য। যেমন মনে হবে গুলাম মহম্মদ বক্স বাট-এর (গামা পালোয়ান) দশ হাজার ডন-বৈঠক দেওয়ার কাহিনি শুনলে।”
চিরস্মরণীয় গোবর
বিশ্বচ্যাম্পিয়নকে চিরস্মরণীয় করে রাখতে ১৯৯৬ সালে হেদুয়ার আজাদ হিন্দ বাগে গোবর গোহর একটি ব্রোঞ্জের মূর্তি উন্মোচন করেন তদানীন্তন রাজ্যপাল রঘুনাথ রেড্ডি। উত্তর কলকাতার গোয়াবাগান স্ট্রিটের নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় গোবর গোহ সরণি। এখানে আজও তাঁর আখড়া গোবর গোহ জিমন্যাসিয়াম হয়ে অস্তিত্ব বজায় রেখেছে। গোবর গোহর বিশ্বজয়ের আগে তো নয়ই, পরেও কোনও ভারতীয় একক ভাবে পেশাদার কুস্তির বিশ্বচ্যাম্পিয়নের শিরোপা-সহ সারা বিশ্বের তাবড় মল্লবীরদের পর্যুদস্ত করার কৃতিত্ব দেখাতে পারেননি। সান ফ্রানসিস্কোয় তাঁকে চ্যাম্পিয়ন হতে দেখে ইউরোপীয়রা বিশ্বাসই করতে পারেননি যে গোবর গোহ এক জন বাঙালি মল্লবীর। বিদেশিরা বিশ্বাস করুন বা না-ই করুন, বাঙালিরা কিন্তু তাঁদের কুস্তির কসরতের পরম্পরায় এটা বিশ্বাস করেন, ক্রীড়াঙ্গনের অন্য সব ক্ষেত্র থেকে ব্যাক্তিগত ইভেন্টে সোনা আসুক বা না আসুক, কুস্তি এক দিন বাজিমাত করবেই। বর্তমান প্রজন্ম তো কুস্তির চেহারাটাই দেখেনি। তাদের বিশ্বাস করানো কঠিন যে, খাস কলকাতায় অন্তত আটটা আখড়ায় কুস্তির রেওয়াজ চলত ঘটা করে। রাজা দিগম্বর মিত্র ও রানি রাসমণির বাড়ি, শোভাবাজার রাজবাড়ি, জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি, সিমলা ব্যায়াম সমিতি, জোড়াবাগান পঞ্চানন ব্যায়াম সমিতি, বেনিয়াটোলায় আহিরীদের এবং উত্তর কলকাতায় গোহদের আখড়ায় নিয়মিত কুস্তিচর্চা চলত। এখন সেই সব অতীত। শোনা যায়, ঠাকুরবাড়ির বিশাল আখড়ায় রবীন্দ্রনাথ-সহ অনেকেই, এমনকি এই পরিবারের মহিলারাও কুস্তির অনুশীলন করতেন।
সিমলা ব্যায়াম সমিতির কুস্তির আখড়ায় নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু যেতেন। এখন সেখানে জিমন্যাস্টিক্স হয়। শোনা যায়, বিবেকানন্দ, শরৎচন্দ্র, রামকৃষ্ণদেবও তাঁর শিষ্যদের নিয়ে কুস্তি লড়তেন। সংস্কৃত কলেজে কুস্তি নিয়ে আলোচনায় যোগ দিতেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরও। বাংলার রাজা-মহারাজারা পালোয়ানদের পৃষ্ঠপোষকতা, আখড়ার রক্ষণাবেক্ষণ করতেন। একের পালোয়ান লড়তেন অন্যের পালোয়ানের বিরুদ্ধে। গোবর গোহ ও তার বন্ধু নন্দলাল সাহার আখড়ার মল্লবীররা পরস্পরের বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নামতেন।
এই সময়ের কুস্তিচর্চা
কলকাতা শহরের ঐতিহ্যশালী আখড়াগুলো আর নেই। ঐতিহ্যপূর্ণ গোবর গোহর আখড়ায় এখন আর জিম ছাড়া কিছু হয় না। অথচ গত জাতীয় ক্রীড়াতেও বাংলা কুস্তিতে অংশ গ্রহণের যোগ্যতা অর্জন করেছে। বর্তমানে সর্বভারতীয় কুস্তি সংস্থার সহ-সভাপতি, রাজ্য কুস্তি সংস্থার সচিব অসিত সাহা জানালেন, “কলকাতার অধিকাংশ আখড়ার অস্তিত্ব বিলীন হয়ে গেলেও এখনও টিকে আছে বড়বাজার তারাসুন্দরী পার্ক, জোড়াবাগান, প্রসন্নকুমার ঘাটের মতো কয়েকটি আখড়া। মুর্শিদাবাদ, জলপাইগুড়ি-সহ উত্তরবঙ্গের কয়েকটি আখড়া বাংলার কুস্তিকে এখনও বাঁচিয়ে রেখেছে। যদিও অনুশীলন ছাড়া এই সব মাটির আখড়ায় প্রতিযোগিতা সংগঠিত করা যায় না। বাংলায় প্রচুর স্টেডিয়াম নির্মাণ হয়েছে, কিন্তু যে খেলা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পদক তুলে আনছে, তার স্থান নেই সেখানে।”
শেষ জীবনে দৃষ্টি হারিয়েছিলেন গোবর গোহ। অসিত সাহা শুরুতে কৃশকায় ছিলেন, তাঁর শরীরে হাত দিয়ে ক্ষুণ্ণ হয়েছিলেন তিনি। শরীরের ওজন বাড়তে বাধা দেওয়া তিনি একেবারেই পছন্দ করতেন না। অলিম্পিয়ান সুশীলচন্দ্র সাহার কাছে কুস্তির বয়স ও ওজনভিত্তিক বিভাগ নিয়ে উষ্মা প্রকাশ করেছিলেন, “চেহারাই যদি না থাকে, সে কিসের মল্লবীর? কুস্তিগিররা চিহ্নিতই হয় চেহারায়।”
এ দেশের কুস্তির পথপ্রদর্শক গোবর গোহ তাঁর শেষ জীবনে হয়তো জানতেই পারেননি সময়ের সঙ্গে বদল ঘটেছে বিশ্ব কুস্তির ধরনে, ব্যাকরণে, নিয়মকানুনেও। বর্তমানে মল্লবীর আর জিমন্যাস্টদের চেহারা খুব আলাদা কিছু নয়। শতাধিক কেজি ওজনের, বিশালকায় ভুঁড়িওয়ালা মল্লবীরদের বদলে ৫০ থেকে ১৩০ কেজি ওজনে বয়সভিত্তিক ১০টি বিভাগে মল্লবীরদের ভাগ করে দেওয়া হয়েছে। অলিম্পিক্সে পুরুষ ও মহিলাদের যথাক্রমে ৬টি ও ৪টি বিভাগে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে হয়। আগেকার সুবিশাল খাবারের থালায় থরে থরে সাজানো প্রচুর খাবারের বদলে এখন নিয়ন্ত্রিত পরিমিত খাবার। তিন ঘণ্টার ম্যারাথন কুস্তির বদলে মাত্র ৬ মিনিটের লড়াই। সময়ের অপচয় ঘটিয়ে এরিনাময় মল্লবীরদের ছুটে বেড়ানোর দিন শেষ। তিন বার সময় অপচয় করলে প্রতিযোগী এখন ছিটকে যাবেন লড়াই থেকে, বিপক্ষের প্রতিযোগী হবেন বিজয়ী। ‘আকাশ দেখলেই আউট’ এই প্রবাদের দিন আর নেই। পয়েন্টের বিচারে এখন জয়-পরাজয়ের নিষ্পত্তি। ফ্রিস্টাইলের সঙ্গে পুরুষ বিভাগে গ্রেকো-রোমান পদ্ধতিরও প্রয়োগ ঘটেছে। এই পদ্ধতিতে বিপক্ষের কোমরের নীচের অংশ স্পর্শ করা নিয়মবিরুদ্ধ।
নিয়মের বাইরের সেই চ্যাম্পিয়ন
১৯৪৪ সালে কুস্তি থেকে অবসর নেওয়ার পর ভারতীয় কুস্তি পরিচালনার দায়িত্ব এসে পড়ে গোবর গোহর ওপর। দৃষ্টিহীনতায় আক্রান্ত হওয়ার আগে পর্যন্ত সে দায়িত্ব তিনি পালন করে গেছেন। ১৯৭২ সালের ২ জানুয়ারি নিজের তৈরি আখড়াতেই চিরনিদ্রায় চলে যান বিশ্বখ্যাত এই বাঙালি মল্লবীর। এ বছর তাঁর মৃত্যুর অর্ধশতকেরও সূচনা।
আমাদের গর্ব, তাঁর মতো বিশ্বজয়ী এক বাঙালিকে আমরা পেয়েছিলাম। একই সঙ্গে আক্ষেপ, তাঁর মতো মল্লবীরের কাছ থেকে অলিম্পিক্সের পদক আমরা পেলাম না। অলিম্পিক্সের গোড়া থেকেই কুস্তির অন্তর্ভুক্তি। সাত-সাতটা পদক জিতে সেখানে ভারতের উজ্জ্বল উপস্থিতি। অথচ সেখানে গোবর গোহর মতো বিশ্বখ্যাত মল্লবীর অনুপস্থিত, এ আজও বিস্ময়কর। হয়তো পেশাদার মল্লবীর গোবর গোহ চাননি প্রতিযোগিতামূলক কুস্তির নিয়মে নিজেকে আবদ্ধ রাখতে। নিজের শর্তেই আজীবন নিজের লড়াই লড়ে গেছেন সিংহবিক্রম এই মল্লবীর।