ভারতে সবচেয়ে অকেজো বিষয়টি বোধহয় ইতিহাস। যার যখন যেরকম মনে হয়েছে, ইতিহাসের নামে গল্প লিখে গেছেন এবং ইতিহাসের নামে এই গল্প লেখার ধারা এগিয়ে নিয়ে চলেছেন বাংলা ও ভারতের কিছু সাংবাদিক

ভারতে সবচেয়ে অকেজো বিষয়টি বোধহয় ইতিহাস। যার যখন যেরকম মনে হয়েছে, ইতিহাসের নামে গল্প লিখে গেছেন এবং ইতিহাসের নামে এই গল্প লেখার ধারা এগিয়ে নিয়ে চলেছেন বাংলা ও ভারতের কিছু সাংবাদিক। এঁরা তো জ্ঞানে রমেশবাবু, যদুনাথবাবুর চেয়েও এগিয়ে। যাই হোক, এঁরা গল্প এখনও লিখছেন নিজের মতো এবং সেটাকেই ইতিহাস বলে দাবি করছেন। একটা সময় তাও সত্যের সন্ধান পাওয়ার সুযোগ ছিল। পোর্টাল, ব্লগ, ফেসবুক এসে সত্য নামক বস্তুটিকে গঙ্গায় ভাসিয়েছে। যাই হোক, এটা আমার আলোচনার বিষয় নয়। আমি বরং অন্য একটা ঘটনা বলি।

১৯০৬ সালে একটি বছর ২৩ এর ছেলে লন্ডনে আইন পড়তে এল। তখন যে সব ভারতীয়রা লন্ডনে পড়তে যেত তাদের সঙ্গে ব্রিটিশ রেস্তোরাঁ থেকে কলেজ সব জায়গাতে জঘন্য ব্যবহার করা হত। লন্ডনে থাকা ভারতীয়দের মধ্যে অনেকে বিট্রিশদের এই প্রভুসুলভ ব্যবহারের বিরোধিতা করত তবে আলাদা আলাদা ভাবে। ব্যক্তির সঙ্গে ব্যক্তির লড়াই। ১৯০৬ সালে ভারত থেকে যাওয়া ছেলেটি দেখল, না এইভাবে সম্ভব হবে না। আলাদা আলাদা ভাবে সম্ভব নয়। একত্রিত হয়ে লড়াই করতে হবে “ব্রিটিশ” নামক প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে। লন্ডনে পড়তে আসা ভারতীয়দের নিয়ে একটি গোপন বৈঠকে ছেলেটি বলল,

“অমুক ব্রিটিশ বা তমুক অফিসারের নামে, এই আইন বা ঐ কানুনের বিরুদ্ধে অভিযোগ অনুযোগ জানিয়ে কোনও লাভ হবে না। আমাদের আন্দোলন কোনও বিশেষ ব্যক্তি বা আইনের বিরুদ্ধে নয়, বরং নিজেদের আইন নিজেরাই বানাবার অধিকার অর্জনের পক্ষে। সহজ করে বলতে গেলে আমরা চাই সম্পূর্ণ স্বরাজ, স্বায়ত্বশাসন।”

লন্ডনে থাকা ভারতীয়দের একত্রিত করার জন্য ২৩ বছরের ছেলেটি ততদিনে একটা সংগঠনও বানিয়ে ফেলেছে, ফ্রি ইন্ডিয়া সোসাইটি। সঙ্গে মাদাম কামা, শ্যামজী কৃষ্ণ বর্মা। অবশ্য এর আগেই ভারতে
“অভিনব ভারত” বলে তার একটি জাতীয়তাবাদী বৈপ্লবিক সংগঠন রয়েছে।

ফ্রি ইন্ডিয়া সোসাইটির মাধ্যমেই ছেলেটি মদনলাল ধিংড়া, ডব্লিউ বি ফারকে, সুখসাগর দত্ত, হরনাম, পান্ডুরাম পাপট, নিরঞ্জন পাল, আসিফ আলির মতো ভারতমাতার সন্তানদের এক ছাতার তলায় আনতে শুরু করলেন।

১৯০৯ সালে এই মদনলাল ধিংড়া ইংরেজ অফিসার কার্জন উইলিকে গুলি করে হত্যা করেন। এই ঘটনায় নাম জড়ায় ছেলেটি। ওই সময় ব্রিটিশরা কার্জন হত্যায় ধিংড়ার পাশাপাশি মূল অভিযুক্ত করেছিল ওই ছেলেটিকে। তবে এখানেই শেষ নয়, এরপরও আর এক ইংরেজ অফিসার জ্যাকসন হত্যার ষড়যন্ত্রেও অভিযুক হয় ১৯০৬ সালে লন্ডন আসা ছেলেটি।

১৯০৬ সালে লন্ডনে ওকালতি পড়তে আসা ছেলেটি মোটামুটিভাবে,
কার্জন উইলি হত্যা,
জ্যাকসন হত্যা ষড়যন্ত্র
এবং ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে ভয়ঙ্করতম থ্রেট হওয়ার কারণে ১৯০৯ সালে তৎকালীন সরকার বাহাদুর এঁকে ৫০ বছরের জন্য আন্দামানের সেলুলার জেলে পাঠান। ১০ বছর জেল খাটার পর ব্রিটিশ সরকারের কাছে ক্ষমাপ্রার্থনা করে সেলুলার জেল থেকে বেরোতে পারেন। কিন্তু তাঁকে রন্তাগিরি জেলে রাখা হয় এবং ১৯২৪ সালে তিনি জেল থেকে ছাড়া পান।

ছেলেটির নাম বিনায়ক দামোদর সাভারকর। আজ ২৮ মে তাঁর জন্মদিন। সাভারকর ঘোষিত নাস্তিক জাতীয়তাবাদী চরমপন্থী স্বাধীনতা সংগ্রামী ছিলেন। এত সবের পরও তাকে নিয়ে নোংরামো হয়। তাঁকে ব্রিটিশদের দালাল বলা হয়। কারণ? শেষজীবনে তিনি হিন্দুদের হয়ে কথা বলতেন। হিন্দুত্বের কথা বলতেন।

আচ্ছা মুচলেকা দিয়ে ছাড়া পাওয়া কি এই প্রথম ছিল? না। সাভারকরের আগেই মারাঠাভূমের এক ভারতীয়ও কিন্তু মোঘলদের হাত থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য সন্ধি করেছিলেন আওরঙ্গজেবের সেনাপতি জয় সিংহের সঙ্গে। পালিয়েছিলেন আওরঙ্গজেবের কারাগার থেকে। কিন্তু সময় বুঝে কৌশলে আবার মোঘলদের থেকে মারাঠাদের রক্ষাও করেন। এই ভদ্রলোকের নাম শিবাজী।

স্বাধীনতা আন্দোলন কী, কতটা তার ব্যাপ্তি ছিল এটা বই পড়ে বোঝা মুশকিল। ওই সময় অনেকেই নিজেদের মতো কৌশল অবলম্বন করেছিলেন ভারতকে ইংরেজদের হাত থেকে মুক্ত করার জন্য।

(সাভারকর ও নেতাজী)

নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু সাভারকরের “হিন্দুত্ববাদের” রাজনীতির সঙ্গে সহমত ছিলেন না। দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামকে হিন্দু মুসলিমে ভাগ করার ঘোর বিরোধী ছিলেন নেতাজী। তবে তিনি না চাইলেও যেমন “মুসলিম লিগ” ছিল, তেমনই ছিল “হিন্দু মহাসভা”। ওটা সময়ের দাবি ছিল। যেমন কংগ্রেস ছেড়ে নেতাজীর ফরওয়ার্ড ব্লক গঠনটাও ছিল সময়ের দাবি।

এখানে নেতাজী আর সাভারকরের সম্পর্ক কেমন ছিল এ প্রশ্ন উঠে আসে। স্বাধীনতার পর জহরবাবুর সভা-ঐতিহাসিক (সভাকবি টাইপ)রা ইতিহাস লিখেছেন এবং দায়িত্ব নিয়ে তথ্য বিকৃত করে প্রমাণ লোপাট করেছেন। নাহলে বিশ্বের ইতিহাসে এরকমটা কখনও হয়েছে যে নেতাজীর মতো একজন ব্যক্তির অর্ন্তধান রহস্য আজও আমাদের সামনে এল না। শুধু এটুকু দিয়েই বিচার করে বলে দেওয়া যায় যে আমাদের প্রথম প্রধানমন্ত্রী কতটা প্রভাবশালী ছিলেন। স্কুল পাঠ্য ইতিহাস বই তো ছেড়েই দিন (সেখানে ওয়াহাবি আন্দোলনের নেতা তিতুমীর স্বাধীনতা সংগ্রামী। খিলাফৎ আন্দোলন ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন) বাজারে নামী দামী ইতিহাস লেখকের বইয়েও সাভারকর থেকে ক্ষুদিরামকে নিয়ে যথেষ্ট তথ্য অমিল। তাও যেটুকু পাওয়া যায় সেখান থেকে বলি,

১৯৪০ সালের ২১ জুন মুম্বাই-এর দাদার নামক স্থানে সাভারকরের বাড়িতে সুভাষচন্দ্র বসু ও সাভারকরের সাক্ষাৎ হয়। ফরওয়ার্ড ব্লক ও হিন্দু মহাসভার পারস্পরিক সহযোগিতাই ছিল ওই বৈঠকের মুখ্য উদ্দেশ্য।

১৯৪৪ সালের ২৫ জুন নেতাজী আজাদ হিন্দ রেডিওতে স্পীচ দেওয়ার সময় সাভারকরের প্রভূত প্রশংসা করেন:
“দূরদর্শিতার অভাবে কংগ্রেস এর প্রায় সমস্ত নেতা যখন ইন্ডিয়ান আর্মিদের ভাড়াটে বা বেতনভোগী বলে অপমান করছিলেন, বীর সাভারকর তখন নির্ভীকভাবে ভারতবর্ষের যুবক সম্প্রদায়কে সৈন্যবাহিনীতে যোগ দেবার পরামর্শ দেন। এই যুবকরাই ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মির জন্য প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সৈন্যের যোগান দেন।”

যদিও বামপন্থী ঐহিহাসিক এবং বর্তমানে বামপন্থী সাংবাদিকরা এই সব তথ্যকে বিকৃত করে সাভারকর বনাম নেতাজী তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ লিখে রেখে গেছেন। কিন্তু এর বাস্তব প্রমাণ চেয়ে দেখুন আপনি, পাবেন না।

(গান্ধী হত্যা ও সাভারকর)

১৯৪৮ সালে মহাত্মা গান্ধীকে গুলি করে হত্যা করে নাথুরাম গডসে। এই হত্যায় নাম জড়ায় সাভারকরের। অবশ্য এর যথেষ্ট কারণও রয়েছে। নাথুরাম এবং তার দাদা সাভারকরের ঘনিষ্ঠ ছিলেন এবং সাভারকরের হিন্দুত্বের ফলোয়ার ছিলেন। কয়েকজন বামপন্থী সাংবাদিক দেখেছেন (নিজের চোখে কিনা জানি না। তবে তারা লিখে রেখে গেছেন) গান্ধী হত্যার কয়েকদিন আগেও সাভারকরের বাড়িতে এসেছিলেন গডসে।
স্বাভাবিকভাবেই গান্ধী হত্যার দায় চাপে তারও কাঁধে। তার উপর ইনকোয়ারিও বসে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সাভারকরের বিরুদ্ধে কোনও রকম অভিযোগ প্রমাণিত হয় নি। এরপর এখানে আপনি বলতেই পারেন প্রমাণ হয়নি বলেই কি ও দোষী নয়? অবশ্যই এ প্রশ্ন আপনি করতে পারেন। তাহলে আপনাকে আরও কয়েকটা ঘটনা বলি।

১) ভারতের একটা বড় অংশের মানুষ মনে করেন নেতাজী ১৮ই আগস্ট ১৯৪৫ এর প্লেন দুর্ঘটনায় মারা যাননি। ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু তাঁকে দেশে ফিরতে দেননি। তিনি নেতাজীকে ইংরেজদের হাতে তুলে দেওয়ার অঙ্গীকার করেছিলেন। আজাদহিন্দ ফৌজকে আটকাতে তিনি বলেছিলেন আমি তলোয়ার নিয়ে সুভাষের পথ আটকে দাঁড়াবো।

২) শ্যামাপ্রসাদকে কাশ্মীরের জেলে বিষ প্রয়োগ করে হত্যাও আসলে নেহরু এবং আবদুল্লা পরিবারের কীর্তি বলে অনেকে মানেন।

৩) ২৩ মার্চ ১৯৩১, ভগৎ সিং-কে তড়িঘড়ি করে ফাঁসি দেয় ইংরেজরা। ২৬-৩১, ১৯৩১ করাচিতে কংগ্রেসের সম্মেলনে, গো ব্যাক গান্ধী, ডাউন ডাউন গান্ধি স্লোগান উঠে। এমনকি এই সময় গান্ধীজীর ভূমিকার খোলাখুলি সমালোচনা করেছিলেন নেতাজী। কারণ? এই সময় গান্ধী ও কংগ্রেসকে ইংরেজদের দরকার ছিল। দ্বিতীয় গোলটেবিল বৈঠকের আগে এবং ভগৎ সিংয়ের ফাঁসির আগে ৫ই মার্চ ১৯৩১ সালে গান্ধী-আরউইন প্যাক্ট। নেতাজী সহ কংগ্রেসের অনেক বড় নেতাই চেয়েছিলেন ভগৎ সিংয়ের ফাঁসি আটকানো এই প্যাক্টের শর্ত হোক৷ সবচেয়ে বড় কথা সারা ভারত এটা চাইছিল। মনে করা হয়, চরমপন্থী আদর্শের জন্যই গান্ধী ভগৎ সিংকে ফাঁসিতে চড়তে দিয়েছিলেন। একবারও তার ফাঁসি আটকানোর ব্যবস্থা করেননি। এটা রাজনৈতিক খুন নয়? এখানে প্রশ্ন উঠতেই পারে ভগৎ সিংয়ের জনপ্রিয়তা ও গ্রহণযোগ্যতাকে ভয় পেয়ে এই রাজনৈতিক হত্যায় মদত দিয়েছিলেন গান্ধী! কিন্তু এটারও কোনও প্রমাণ নেই যেমন নেই আগেরগুলোর। তাই এই অশংগুলো ইতিহাসের বিতর্কিত অধ্যায় হয়েই থাকবে। এটা নিয়ে গল্প হতে পারে, তর্ক নয়।

শে খ র ভা র তী য়।।

তথ্যসূত্র-
Inside the enemy camp- সাভারকর
সাভাকর এবং হিন্দুত্ব- এ জি নূরানী
ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম – বিপিন চন্দ্র
A histroy of Modern India- ইশিতা ব্যানার্জি দুবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.