স্টকহোম সিনড্রোম, রিফিউজি, তালিবান আর দ্যাশ

আপনার চারপাশে দেখবেন অনেকে স্টকহোম সিনড্রোমে ভুগছে কিন্তু ভাবছে সে হেব্বি লিবারেল। মানে তেড়ে দেশকে খিস্তি করলেই আপনি বিশ্বনাগরিক। আর তালিবানকে জল্লাদ বললেই আপনি সাম্প্রদায়িক!

জানিয়ে রাখি স্টকহোম সিনড্রোম মানে ওই আলিয়া ভট্টর ‘হাইওয়ে’তে যেমন ছিল। কিডন্যাপারের সাথে প্রেম প্রেম টাইপ! সেটি এক অদ্ভুত মানসিক সমস্যা। যে নিপীড়ক তার প্রতি নিপীড়িতের অদ্ভুত এক সমবেদনা ও ভালোবাসা জন্মানো। যাকে আশেপাশের সবাই ভিলেন ভাবছে তাকে ভালোবেসে ফেলা। যে আপনাকে রোজ উঠতে বসতে চর থাপ্পড়ে রাখছে, হিসু মাখানো প্লেটে রুটি ছুড়ে দিচ্ছে একবেলা তার প্রতিই মাখোমাখো প্রেম জন্মাচ্ছে। যে ঠোঁট মেরে ফাটিয়ে দিয়েছে সেই ঠোঁটই চুম্বন চায়!

স্টকহোম সিনড্রোমে ভোগা মানুষ দেখলেই চিনতে পারবেন। বিশেষ বিশেষ উদ্দেশ্যে লিবারেল প্রমাণ করার তাগিদে তালিবানের সব কিছু অমৃতসমান ভেবে ফেলে এরা। জাহিরও করে সিংহ সেজে। এদিকে তালিবান ২০ঘন্টা আটকে রেখে আফগান জালেপি শোনালেও এদের পেন্টুতে হিশু হয় আর ভ্যাঁ করে বাড়ি যাবো কান্না পায়। বাড়ি ফিরেই তালিবানের সাথে অবসর যাপনের ক্রিকেট কিসসা শোনাতে হয়। বাবুসোনা তখন নিজের পাড়ার বীর আর তালিবানেরা সন্ত! বাড়ির খেয়ে, নিজের কোলবালিশ চেপে ত্রাসই নস্টালজিয়ায় বদলে যায়। তখন চুপচুপে ধর্মীয় মৌলবাদ-প্রীতি। তখন কট্টর মৌলবাদীদেরও মনে হয় সুফিবাদী। ধর্মীয় গোঁড়ামিকেও মনে হয় মানবতার দর্শন। হাবভাব এমন, আহা রে! তালিবানই তো, সিন্ধুঘটক বা ইয়েতি তো না। এসব সময় প্রশ্ন করবেন না, তালিবান বিরোধী আমরুল্লা সালেহ, মোহাম্মদি বা মাহসুদ নিয়ে। বাবুসোনা আন্তজার্তিক সম্পর্কে কাঁচা! বাবুসোনাকে জিজ্ঞেস করুন তালিবান আসার পরে চিকেন রোলে ডবল মাংস দিচ্ছে কেন তার গল্প! ৪৬, ৪৭, ৪৮’ এও তো ত্রাস নস্টালজিয়ায় বদলে গেছিল। স্টকহোম সিনড্রোম? কাশ্মীরেও তো পন্ডিতদের নস্টালজিয়া ছিল, জেহাদ না।স্টকহোম সিনড্রোম?

ছিঃ ছিঃ! নিজভূম থেকে ঘাড় ধাক্কা দিয়েছে বলে জ্বলে উঠবো? যে ছোটবেলা থেকে গোল্লাছুটের মাঠে একসাথে খেলতো সে একদিন হঠাৎ মৌলবাদী হয়ে যখন মাইক থেকে আমাদের উদ্দেশ্যে বলা শুরু করলো, হয় ধর্মান্তরিত হও বা একরাতের নোটিশে এখান থেকে পালাও বা মৃত্যুবরণ করো, তখন রেগে যাবো? এটা তো আমাদের শিক্ষা নয়। সংস্কৃতি নয়। তারচেয়ে কী কী ছেড়ে এলাম তার গল্প শোনাই নাতি নাতনিকে। ওপারের ওই লোকগুলোর গল্প শোনাই যারা একসময় ভালো ছিল! স্টকহোম সিনড্রোম?

আগেও বলেছি। আমার দাদুরও একখান দ্যাশ ছিল। পরে সেই দ্যাশটি হারিয়ে যায় যখন, দাদু আর কোন মিসিং ডায়েরি করেনি। করবেই বা কোন থানায়? রিফিউজি ক্যাম্প থানা, কলোনি থানা, নতুন বাড়ি বানালো যে দক্ষিণ কলকাতা এলাকায় সেই থানা না ভিটেমাটি ছিল যেখানে সেই থানা। দাদুর একখান দ্যাশ ছিল। সেই দ্যাশে সুপুরি গাছ, নারকোল গাছ ছিল। খাল ছিল, বিল ছিল, নয়ামাটি, সাতক্ষীরা, বান্দরবান নামে সব মিষ্টি এলাকা ছিল। গোল্লাছুটের মাঠ ছিল, সন্ধেবেলার শাঁখ ছিল। আমন ধানের গন্ধ ছিল। স্টকহোম সিনড্রোম ব্যামো ছিল কী? আলবাত! সারাজীবনের জন্য একটা নস্টালজিয়া ব্যামো পেল। “আমার একখ্যান দ্যাশ ছিল।”

কিন্তু কী হবে দ্যাশ নিয়ে হাহুতাশ করে? স্টকহোম সিনড্রোম তো ক্যানসারের মতো ছড়িয়ে গেছে ততক্ষণে। যাক যা গেছে তা যাক! তারচেয়ে পদ্মার ইলিশ নিয়ে কথা বলি, ইলিশের বিরিয়ানি নিয়ে হাহুতাশ করি, পাঁচ রকমের মাছের ভর্তা নিয়ে আলাপ করি। এসব সেফ! আপনাকে সাম্প্রদায়িক দাগিয়ে দেবে না!

পৃথিবীর যে কোন প্রান্তে ভিটেমাটিচাটি হওয়ার অভিমান আর একরাতে চলে আসার দীর্ঘশ্বাস মিশে গেলে যদি কোন শব্দ তৈরি হয়, তাকে রিফিউজিরা দ্যাশ বলে। একরাতের নোটিশে কোন জায়গা ছেড়ে চলে আসতে বাধ্য হলেও যারা বিতারিত করলো তাদের সাথে ক্রিকেট কিসসা আর রোলে ক’পিস মাংস বেশি দিলো তারা, সেই নিয়ে শুধু কথা হলে তাকে স্টকহোম সিনড্রোম বলে!

©—- ময়ূখ রঞ্জন ঘোষ

MayukhRanjanGhosh

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.