স্বাধীনােত্তর ভারতে কতিপয় সর্বজনসম্মানিত দুর্লভ মানবিকগুণ সম্পন্ন নেতাদের অন্যতম ছিলেন এই মানুষটি। —“আমরা মােটেই নিজ স্বার্থের জন্য পৃথিবীতে আসিনি কেবলমাত্র নিপীড়িত ও অবহেলিতদের জন্যই আমাদের জীবন ধারণ।” বাক্যটি নানাজীর ও তার সমগ্র জীবনটিই ছিল এই উদ্দেশ্যে উৎসর্গীকৃত। প্রজাতন্ত্র দিবসের প্রাক্কালে, তার মৃত্যুর আট বছর পর বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকার তাকে সর্বোচ্চ ‘ভারতরত্ন’ সম্মানে ভূষিত করেছে। অন্ত্যোদয় অর্থে সমাজের অন্তিম পঙক্তিতে থাকা মানুষটিকে সর্বার্থে মূলস্রোতে ফিরিয়ে আনার পন্থা হিসেবে তিনি ‘গ্রামােন্নয়ন’কেই বেছে নিয়েছিলেন। তিনি একই সঙ্গে ছিলেন একজন নিপুণ সংগঠক, চিন্তাবিদ, বিপ্লবী তথা সমাজ নির্মাণের স্থপতি (সমাজশিল্পী)। তার নিরলস কাজের মাধ্যমে তিনি একাধারে গান্ধীর ‘গ্রাম স্বরাজ’, পণ্ডিত দীনদয়ালের ‘অন্ত্যোদয়’, জয়প্রকাশ নারায়ণের ‘সর্বোদয়’-এর ত্রিধারাকে গ্রামােদয়ের খাতে বইয়ে দিয়েছিলেন।
তার জন্ম হয়েছিল মহারাষ্ট্রে। রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের প্রচারক হিসেবে তার কর্মভূমি ছিল সমগ্র উত্তরপ্রদেশ (অবিভক্ত)। তার কাজের মূল কেন্দ্র ছিল গােরক্ষপুর। এখান থেকে সঙ্ঘের কাজকে তিনি সমগ্র পূর্ব উত্তরপ্রদেশে ছড়িয়ে দেন। সেই সুদুর অতীতে ১৯৫০ সালে তিনি গােরক্ষপুরে শিশু শিক্ষার জন্য প্রথম ‘সরস্বতী শিশু মন্দিরের’ সূচনা করেন। যার শাখা প্রশাখা আজ সারা ভারতব্যাপী ১৮০০০টি স্থানে পরিচালিত হচ্ছে। নানাজী অত্যন্ত ঘনিষ্ঠভাবে দীনদয়ালজীর সঙ্গে কাজ করেছেন। তারা দু’জনে প্রায় সমবয়সী হলেও নানাজী সর্বদাই তাঁকে জ্যেষ্ঠের সম্মান দিতেন। সঙ্ঘ মুখপাত্র ‘পাঞ্চজন্য’ ও ‘রাষ্ট্রধর্মের’ যখন প্রথম লক্ষ্ণৌ থেকে প্রকাশ শুরু হলাে, তখন নানাজী ছিলেন সংগঠন সম্পাদক ও অটলবিহারী বাজপেয়ী ছিলেন সম্পাদক। এরই মধ্যে ১৯৫১ সালে শ্রদ্ধেয় শ্যামাপ্রসাদ মুখােপাধ্যায়ের নেতৃত্বে নতুন ভারতীয় জনসঙ্ঘের জন্ম হলাে।
আর এস এস-এর তরফ থেকে শ্যামাপ্রসাদকে সাহায্য করতে কিছু তরুণকে নিয়ােগ করা হয়। পণ্ডিত দীনদয়ালের নেতৃত্বে এই দলে ছিলেন অনুজ্ঞাবদ্ধ স্বয়ংসেবক নানাজী। তার ওপর সমগ্র উত্তরপ্রদেশে ভারতীয় জনসঙ্ঘের প্রসার ঘটনানাের দায়িত্ব দেওয়া হয়। পরবর্তী ২৫ বছর কায়মনােবাক্যে কাজ করে তিনি ভা. জ. সঙ্ঘকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যান। তিনি এখানকার প্রতিটি মহকুমা, জেলা ও রাজ্যস্তরে দলের প্রসারণের পুরােধা ছিলেন। উত্তরপ্রদেশে দলের চমকপ্রদ বৃদ্ধির কারিগরের গৌরব যেমন নানাজীর প্রাপ্য, তাকে সহায়তা করতে অটলবিহারী বাজপেয়ীর প্রবাদপ্রতিম বাগ্মীতা ছিল দোসর। এরই সঙ্গে সমগ্র কর্মকাণ্ডকে সঠিক দিশা নির্দেশের কাণ্ডারী ছিলেন দীনদয়াল উপাধ্যায়। কাজের ফাঁকে নানাজী কিন্তু ভিন্ন ভাবধারার নেতা চরণ সিংহ ও রামমনােহর লােহিয়ার সঙ্গেও হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তােলেন। বস্তুত, তিনি লােহিয়াকে জনসঙ্ঘের মধ্যে নিয়ে এসেছিলেন, যার ফলে লােহিয়া সাংগঠনিক কাজকর্ম রপ্ত করার প্রাথমিক সুযােগ পান। হঠাৎ পণ্ডিত দীনদয়ালজীর রহস্যময় মৃত্যুর পর অটলবিহারী বাজপেয়ীর ওপর দলের সামগ্রিক দায়িত্ব পড়ে। বাজপেয়ীর কোর কমিটিতে লালকৃষ্ণ আদবানীর সঙ্গে নানাজী ও আরও কয়েকজন অন্তর্ভুক্ত হন।
এরই মধ্যে ৭০-এর দশকে ইন্দিরা গান্ধীর জমানায় দেশ দুর্নীতি ও অরাজকতার কবলে পড়ে। তরুণ-তরুণী, ছাত্রদল দেশের নানান প্রান্তে বিক্ষোভ প্রদর্শন শুরু করে। এমন একটা পরিস্থিতিতে জয়প্রকাশ নারায়ণকে বিক্ষোভ আন্দোলনের নেতৃত্ব দেওয়ার অনুরােধ করা হয়। জয়প্রকাশজীকে এই বিষয়ে রাজি করাতে নানাজী অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিলেন। তিনি জয়প্রকাশের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ ছিলেন। এই সময়ে আয়ােজিত একটি সভায় জয়প্রকাশের উপস্থিতিতে নানাজী সেই ইতিহাস প্রসিদ্ধ উক্তিটি করেন— “যাট বছর বয়স হয়ে গেলেই রাজনীতিবিদদের রাজনীতি ছেড়ে সমাজ সেবায় আত্মনিয়ােগ করা উচিত।” পরবর্তীকালে নানাজী তার জীবনে এই নিজ ঘােষিত নীতি অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছিলেন।
১৯৭৭ সালের লােকসভা নির্বাচনে তিনি বলরামপুর কেন্দ্র থেকে জয়ী হয়েছিলেন এবং তদানীন্তন সরকারে অনায়াসে একজন মন্ত্রী অবশ্যই হয়ে যেতে পারতেন। কিন্তু অবলীলায় তিনি রাজনীতির ক্ষেত্র ছেড়ে চলে যান। প্রয়াত দীনদয়ালজীর ‘অন্ত্যোদয়’ ও ‘একান্ত মানবতাবাদের’ দর্শনকে বাস্তবায়িত করতে ১৯৬৮ সালে তিনি পণ্ডিত দীনদয়াল গবেষণা কেন্দ্র স্থাপন করেন। তাকে একাজে অকুণ্ঠ সহযােগিতা করেছিলেন আর এস এস-এর দ্বিতীয় সরসঘচালক গুরু গােলওয়ালকার।
নানাজী এবার ফিরে চললেন প্রত্যন্ত গ্রামের দিকে। গ্রামীণ ভারতে একটি বিকল্প উন্নয়নের ধাঁচা তৈরি করতে পরীক্ষামূলকভাবে গােন্ডা জেলায় ‘জয়প্রভা গ্রাম’ নাম দিয়ে দুর্ভিক্ষপীড়িত গ্রামবাসীদের বাঁশের তৈরি পাইপের টিউবওয়েল বসানাের ব্যবস্থা করলেন। এই জয়প্রভা নামের প্রথমটি জয়প্রকাশের জয় ও প্রভা হলাে জয়প্রকাশের স্ত্রী যিনি দীর্ঘদিন মহাত্মা গান্ধীর সহযােগী ছিলেন। মহারাষ্ট্রের বিড ও নাগপুর অঞ্চলেও প্রকল্পের কাজ শুরু হলাে। দুর্ভিক্ষ তাড়িত বিড অঞ্চলে নানাজী প্রচুর সংখ্যায় Check Dam তৈরি করালেন। এর পরই তিনি কর্মভূমি পরিবর্তন করে মধ্যপ্রদেশ ও উত্তরপ্রদেশের মধ্যে বিস্তৃত যে দীর্ঘ নিদারুণ দারিদ্র্য জর্জর ও পশ্চাদপদ চিত্রকূট অঞ্চল সেখানে এলেন। চিত্রকূটে মন্দাকিনী নদীর তীরে তিনি নির্মাণ করলেন ‘সিয়ারাম কুটির’। ৫০ কিলােমিটার অঞ্চল ধরে ৫ শতাধিক গ্রামের তরুণ দম্পতিকে তিনি সমাজ শিল্পী হিসেবে গ্রামােদয়ের কাজে যােগ দিতে উদ্বুদ্ধ করেন। শয়ে শয়ে মানুষ তার সহযােগী হন।
একদিকে তিনি যেমন স্থানীয় গ্রামবাসীদের তার পাশে পেয়েছিলেন, তেমনি তৎকালীন বড়াে বড়াে শিল্পপতি—টাটা, মাহিন্দ্রা, গােয়েঙ্কা থাপারদেরও এ বিষয়ে উৎসাহী করে তােলেন। তারা অকাতরে সাহায্যের হাত উন্মুক্ত করে দেন। নানাজীর ব্যক্তিগত অনুরােধে এইসব শিল্পপ্রধানরা প্রায়ই প্রকল্প স্থলগুলি পরিদর্শনে আসতেন।
প্রয়াত রাষ্ট্রপতি আবুল কালাম প্রায়শই পিইউআরএ নামে প্রকল্পটির কথা বলতেন— (Providing urban utilities to rural areas)
এই প্রকল্পের সার্থক রূপায়ণে দুটো সুবিধে পাওয়া যায়। গ্রাম থেকে শহরে নিষ্ক্রমণ বন্ধ হয় একই সঙ্গে গ্রামের উন্নয়নও হয়। কালাম বলেছিলেন এই প্রকল্পের কথা নানাজীর চিত্ৰকূটে সফর করাকালীন তার মাথায় আসে। চিত্রকূটে গ্রামে বসবাসকারীদের সব রকমের শহুরে সুবিধের অধিকারী করা হয়। এই কাজ সফল করতে কিছু কিছু গ্রামকে সঙ্ঘবদ্ধ করে কাজ করার নানাজীর প্রচেষ্টা তাকে মুগ্ধ করেছিল। এই প্রসঙ্গে নানাজীর উৎসাহে গ্রামােদয় প্রকল্পে অংশগ্রহণকারীরা একটি সুন্দর গান বেঁধেছিল ‘হর হাত কো দেঙ্গে কাম, হর ক্ষেত কো পানি, ফির সে ধরতী সাজেগী য্যায়সে দুলিহন রানি’। অনুবাদ নিষ্প্রয়ােজন।
নানাজীর দৃঢ় বিশ্বাস ছিল গ্রামীণ পরিকাঠামাের উন্নতি ঘটাতে পারলেই গ্রামবাসীদের অবস্থার উন্নতি হবে। তারা আত্মনির্ভর হয়ে উঠবে। গ্রাম ও গ্রামবাসীদের এই যুগ্ম পরিবর্তনের ফলে গ্রামীণ প্রশাসন ও রাজনৈতিক পরিমণ্ডলেও পরিবর্তন আসবে। এই ভাবনা থেকেই তিনি মানুষকে স্বনির্ভর হয়ে সরকারের ওপর ন্যূনতম নির্ভরতার কথা বলতেন। তিনি প্রত্যেকটি গ্রামকে স্বনির্ভর হয়ে ওঠার ওপর জোর দিতেন। সে কারণে কৃষি, জল সম্পদ, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, রােজগারের সঙ্গে সঙ্গে নৈতিক চরিত্র গঠনের গুরুত্বও ছিল তার কাছে অপরিসীম। কেবল স্থানীয় মানুষেরা একটি উন্নয়ন প্রণালী অনায়াসে গড়ে নিতে পারবে এটাই ছিল তার দৃঢ় বিশ্বাস।
এই সুত্রে কৃষিকে লাভজনক করে তুলতে নানাজী প্রথমেই জল সংরক্ষণ করতে পূর্বোল্লিখিত চেক ড্যাম নির্মাণ করান। স্থাপন করেন কৃষি বিজ্ঞান কেন্দ্র, যেখানে উপযুক্ত ও কার্যকরী গবেষণার মাধ্যমে অলাভজনক কৃষি ক্ষেত্রগুলিকেও লাভজনকে পরিবর্তন করা যায়।
দেখার বিষয়, একদিকে তিনি গ্রামীণ শিশুদের শিক্ষা নিয়ে শুরু করলেন। ‘নানাজী দুনিয়া’ (শিশুর পৃথিবী), একই সঙ্গে গ্রামে গড়ে উঠল ‘মহাত্মা গান্ধী গ্রামােদয় বিশ্ববিদ্যালয়’ যেখানে থাকবে উচ্চশিক্ষায় সবরকম ব্যবস্থা। এই বিশ্ববিদ্যালয়টিই ছিল শুধু মাত্র গ্রাম উন্নয়ন বিষয়ক শিক্ষাকে মূল বিষয়সূচি করে দেশের মধ্যে প্রথম বিশ্ববিদ্যালয়। গ্রামে স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উন্নতিকল্পে তিনি চালু করেন ‘আরােগ্য ধাম’। এই ধরনের স্বাস্থ্যকেন্দ্রে মিলত আন্তর্জাতিকমানের চিকিৎসা ব্যবস্থা। একই সঙ্গে এখানে প্রাচীন আয়ুর্বেদ পদ্ধতি, যােগ ও প্রাকৃতিক চিকিৎসা বিদ্যারও বিভাগ ছিল। নানাজী যেহেতু স্বনির্ভর হয়ে ওঠার ওপর বাড়তি গুরুত্ব আরােপ করতেন সেই কারণে চালু করেছিলেন ‘উদয়মিতা বিদ্যাপীঠ’,এগুলির কাজ ছিল স্বনির্ভর প্রকল্প তৈরির প্রশিক্ষণ দেওয়া। এর বিশেষত্ব ছিল এমন সব বিকল্প উদ্যোগ চিহ্নিত করা যেখানে খুব অল্প পুঁজি বিনিয়ােগ করে পর্যাপ্ত লাভ হওয়া সম্ভব। তার এই নিরবচ্ছিন্ন সমাজসেবা কাজের কতজ্ঞতা স্বরূপ সরকার তাকে রাজ্যসভার জন্য মনােনীত করে। গ্রামীণ উন্নয়ন ও স্বনির্ভরতা সৃষ্টির ক্ষেত্রে তার সফল পরীক্ষামূলক কাজগুলির স্বীকৃতি হিসেবে ১৯৯৯ সালে সরকার তাঁকে পদ্মবিভূণ সম্মানেও ভূষিত করেছিল।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মােদী ভারতরত্নের জন্য তার মনােনয়ন ঘােষণা করার পর বলেন— “গ্রামীণ উন্নয়নের ক্ষেত্রে তাঁর অসামান্য অবদানের মধ্যে দিয়ে তিনি প্রমাণ করে গেছেন কীভাবে দেশের গ্রামে বসবাসকারী মানুষদের যথার্থ ক্ষমতায়ন করা যায়। নিম্নবর্গীয় মানুষদের অবস্থার পরিবর্তনে তিনি বিনয়, সহমর্মিতা ও সেবার এক মূর্ত প্রতীক ছিলেন। তিনি সর্বার্থেই একজন ভারতরত্ন।” গ্রামােদয়ের কাজে তার গান্ধী, দীনদয়াল ও জয়প্রকাশের দর্শনকে সার্থকভাবে মানুষের কাজে প্রয়ােগের সম্মান হিসেবে ২০১৭ সালে তার শতবর্ষে সরকার একটি ডাক টিকিটও প্রকাশ করেছিল।
ড. স্বদেশ সিংহ
(অনুবাদ : সুব্রত বন্দ্যোপাধ্যায়। সৌজন্য : অর্গানাইজার)