তালিবানের কাবুল দখলের পর স্বাভাবিক ভাবেই নারী স্বাধীনতার গোরস্থানে পরিণত হয়েছে ওই দেশ। যেখানে সেখানে মেয়েদের বোরখা ও হিজাব পড়া না দেখলেই গুলি করে মারছে জঙ্গিরা। জঙ্গিদের ভয়ে ত্রস্ত এবার বিদেশী মহিলা সাংবাদিকরাও।
ইসলামিক স্টেটের অথবা আল-কায়েদার মতো তালিবানের নিজস্ব কোনো প্রভাবশালী প্রচার মাধ্যম না থাকলেও, জঙ্গিরা তাদের পাবলিসিটির জন্য আমেরিকান চ্যানেল সি এন এন, ব্রিটিশ চ্যানেল বিবিসির উপর নির্ভরশীল।
CNN চ্যানেলের প্রধান বিদেশী সংবাদদাতা ক্লেরিসা ওয়ার্ডকেও পড়তে হলো কালো হিজাব। এই অভুতপুর্ব দৃশ্যের সাক্ষী থাকলো সভ্য দুনিয়া। এক লাইভ শোতে ক্লেরিসাকে দেখা গেলো কালো কাপড়ে সারা শরীর ঢেকে হিজাব পরিহিত অবস্থায় আফগানিস্তানে মহিলা সাংবাদিকের অবস্থা বর্ণনা করতে।
“এই অবস্থা হবে এমনটা সত্যি বলতে কখনো ভাবতে পারি নি আমি,” ক্লেরিসা বলেন। ওই দেশের স্থানীয় মহিলা সাংবাদিকদের দুর্দশা সম্বন্ধে মন্তব্য করতে গিয়ে তিনি বলেন প্রকাশ্যে মহিলা সাংবাদিকরা মুখ দেখাতে ভয় পাচ্ছেন।
উলেখ্য, তালিবান ক্ষমতায় আসার সম্ভাবনা তৈরী হওয়ার সময় থেকেই মহিলাদের মধ্যে আতঙ্ক শুরু হয়ে যায়। যেখানে সেখানে মেয়ে ও মহিলা দেখলেই তুলে নিয়ে যাচ্ছে জঙ্গিরা ও যৌন ক্রীতদাসী বানাচ্ছে অথবা জোর করে বিয়ে করছে তারা।
এদিকে আফগানিস্তানে তালিবান ক্ষমতায় আসার পর ভারতে কট্টর ইসলামের সমর্থকদের মধ্যে উল্লাসের শেষ নেই এবং এর বহিঃপ্রকাশ ঘটছে বিভিন্নভাবে। সমাজবাদী পার্টির সাংসদ শফিকুর রহমান বার্ক এবার তালিবানের উত্থানকে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের সাথে তুলনা করে ফেললো।
এহেন মন্তব্যের ফল ও পেলো হাতে নাতে, দেশদ্রোহীতার মামলা আনা হলো তার বিরুদ্ধে।
এই নিয়ে বিতর্কের সৃষ্টি হয় ও বিজেপি নেতা রাজেশ সিংঘল মঙ্গলবার রাতে তার বিরুদ্ধে পুলিশের কাছে অভিযোগ করেন।
ওই সাংসদের বিরুদ্ধে দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে বিদ্বেষ ছড়ানোর অভিযোগ দায়ের করা হয়।
“যখন ভারত ইংরেজদের অধীনে ছিল তখন ভারতীয়রা স্বাধীনতা অর্জনের জন্য সংগ্রাম করে। এখন তালিবান তাদের দেশকে পরাধীনতা মুক্ত করে। তালিবানরা ক্ষমতাশালী, রাশিয়া এবং আমেরিকা ও তাদের কিছু হারাতে পারে নি,” ওই সংসদ বলে।
এই প্রসঙ্গে উত্তর প্রদেশের উপ মুখ্যমন্ত্রী কেশব মৌর্য বার্কের সমালোচনা করেন ও বলেন সমাজবাদী নেতার সাথে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের কোনো পার্থক্য নেই।
এর আগে, পিস পার্টি মুখপাত্র শাদাব চৌহান তালিবানকে শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতায় আসীন হওয়ার জন্য ধন্যবাদ জানিয়েছেন।
তালিবানের উত্থানে উপমহাদেশজুড়ে জোর পেলো ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা। চিরাচরিত ওয়াহাবি ভাবধারার সাথে সামঞ্জ্যস্য রেখে পাকিস্তান ও বাংলাদেশ জুড়ে চলছে মূর্তি ভাঙার প্রতিযোগিতা। বাংলাদেশে ও কয়েকমাস আগে প্রকাশ্যে ভাঙা হলো বহু মূর্তি। শুধু তাই নয় পালা করে চলছে নিত্যদিন মূর্তি ভাঙার উৎসব।
গতকাল মহারাজা রঞ্জিত সিং-এর মূর্তি আবারো ভাঙা হলো পাকিস্তানে (Pakistan) , এই নিয়ে তিন বার গত দুই বছরে। সম্প্রতি দক্ষিণ ভারতের অসংখ্য মন্দিরে ও রীতিমতো পালা করে ভাঙা হচ্ছে মূর্তি। এই সব ঘটনার যুগসূত্র একটাই ধর্মীয় মৌলবাদ।
দুই বছর আগে ১৯ এর ২৭ জুন মাসে লাহোর কেল্লার শিখ গ্যালারিতে (Sikh Gallery of Lahore Fort) উন্মোচন করা হয় মহারাজা রঞ্জিত সিং-এর মূর্তিটি। টার্গেট করা হয়েছিল মহারাজা রঞ্জিত সিং-এর ১৮০ তম মৃত্যু বার্ষিকী (180th Death Anniversary)।
মূর্তিটি নয় ফুট লম্বা (9 feet) ও ফাইবার কোল্ড ব্রোঞ্জ (Fibre cold bronze) দিয়ে তৈরী।
উদ্বোধনের এক মাসের মধ্যেই ভাঙা হয় সেটি। এর পর আবার আগের বছর ডিসেম্বর মাসে আরেকবার ভাঙা হয় মূর্তিটি, এর পর আবার গতকাল। সব মিলিয়ে তৃতীয় বারের জন্য ভাঙা হলো মহারাজা রঞ্জিত সিংহের মূর্তিটি।
এই ঘটনায় জড়িয়ে থাকবার অভিযোগে পাকিস্তানের তেহরিকে লাব্বাইক পার্টির (Tehrike Labbaik Party) কিছু সদস্য কে গ্রেফতার করেছে পুলিশ।
এই বিষয় নিয়ে ক্ষোভ ছড়িয়েছে সোশ্যাল মিডিয়ায়। এই ভিডিও ভাইরাল হতেই উঠে এলো ভারতে কৃষক আন্দোলনে উস্কানি দেয়া নামাজিদের বিরিয়ানি খাওয়াবার প্রসঙ্গ। পাকিস্তানী সাংবাদিক নায়লা ইনায়তের পোস্ট করা টুইটারে একজন প্রশ্ন করলো দেশদ্রোহীদের বিরিয়ানি খাওয়ানো লোকেরা এখন কোথায়? এই প্রসঙ্গে আই এস আইয়ের তাকে ভারত-বিরোধী খালিস্তানিদের তুলোধুনো করছে লোকেরা সামাজিক মাধ্যমে।
উলেখ্য আফগানিস্তানে তালিবানের উত্থানের উপর পলায়নরত শিখদের দুর্দশা দেখে খালিস্তানপন্থী শিখরা এবার কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রাউডেওকে কাতর অনুরোধ জানায় শরণার্থী শিখদের আশ্রয় দেয়ার জন্য।
৫ কুখ্যাত জঙ্গি যারা ছিল ফিদায়ীন আক্রমণের মাস্টার মাইন্ড, নারী অধিকার লুন্ঠনকারী ও গণহত্যাকারী তারাই চালাবে সরকার।
হাইবাতুল্লা আখুন্দজাদা, আব্দুল গনি বরাদর, মোহম্মদ ইয়াকুব, সিরাজুদ্দীন হাক্কানি ও আব্দুল হাকিম — যারা মাসখানেকের সামান্য বেশি সময়ে ছিল আমেরিকান আর্মির হিটলিস্টে– তারাই এখন চালাবে ইসলামিক আমিরাত অফ আফগানিস্তানের সরকার।
আফগানিস্তানের প্রেসিডেন্ট আশরাফ গনি তাঁর পদ থেকে অপসারিত হওয়ার পর তালিবানরা কাবুলের নিয়ন্ত্রণ সম্পূর্ণ রূপে নিয়ে নেয়। শুধু নিয়ন্ত্রণ নিয়েই ক্ষান্ত নন তালিবানরা, আফগানিস্তানে তালিবান-রাজ প্রতিষ্ঠা হওয়ার পরই দেশের নাম পর্যন্ত পরিবর্তন করে দেওয়া হয়েছে। আফগানিস্তানের নতুন নামকরণ হয়েছে রাতারাতি।
মৌলভী হাইবাতুল্লা আখুন্দজাদা ওই দেশের আমির-আল-মোমিনীন অর্থাৎ সর্বেসর্বা ঘোষিত হয়েছে। এদের মধ্যে কেউ ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত তালিবানের সরকারের বিভিন্ন উচ্চ পদে আসীন ছিল কেউ বা আমেরিকার বিরুদ্ধে ২০ বছরের যুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিল ।
আরবি ভাষায় হাইবাতুল্লা শব্দের অর্থ হলো ‘খুদার তৌফা’ অর্থাৎ আল্লার দেয়া উপহার। সুতরাং নিজের নামের প্রতি সুবিচার করে আখুন্দজাদা কথায় কথায় লোকের গলা কাটতো, গলা কাটার হুকুম দিতো এবং শরীয়তের নিয়ম অনুযায়ী যারা চুরি করতো তাদের হাত ও পা কেটে দিতো।
আখুন্দজাদা ১৯৬১ সালের কাছাকাছি সময়ে কান্দাহারের কাছে পাঞ্জবই জেলায় জন্মায়। সে ছিল নূরবাই সম্প্রদায়ের এক ইমামের ছেলে।
১৯৯৬ সালে তালিবান কান্দাহার দখল করার পর তাকে ফারাহ প্রান্তের এক মাদ্রাসার মৌলভীর দায়িত্ব নিতে বলা হয়। এক লক্ষ ছাত্রের প্রশিক্ষণ দেয়া হতো ওই মাদ্রাসায় যেটি চালাতো কুখ্যাত জঙ্গি ও তালিবানের জন্মদাতা মোল্লা মোহাম্মদ ওমর। সে আবার আফগানিস্তানের শরীয়ত আদালতের প্রধান বিচারপতি ছিল। ২০১৬ সালে মোল্লা মনসুরের মৃত্যুর পর সে তালিবানের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব নেয়।
মোল্লা আব্দুল গনি বরাদর তালিবানের জনক মোল্লা মোহাম্মদ ওমরের সবচাইতে বিস্বস্ত সহযোগী ছিল। ২০০১ সালে আমেরিকার আফগানিস্তান আক্রমণের সময় সে তালিবান সরকারের রক্ষামন্ত্রী ছিল। বরাদর বরাবরই আমেরিকার সাথে আলোচনার পক্ষপাতী ছিল।
মোল্লা মোহম্মদ ওমরের ছেলে মোল্লা মোহাম্মদ ইয়াকুব অনেকদিন পর আবার সামনে এলো। সে আবার মিলিটারি উইংয়ের কমান্ডার।
এই পাঁচ জনের অন্যতম হলো সিরাজুদ্দীন হাক্কানি যে হলো ফিদায়ীন আক্রমণের রূপকার ও তার বাবা জালালুদ্দিন হাক্কানির জঙ্গি নেটওয়ার্ক চালায়। আখুন্দজাদার প্রিয়ভাজন মোল্লা আব্দুল হাকিম পূর্ববর্তী তালিবান সরকারের প্রধান বিচারপতি ছিল।
জোর করে হিংসার মাধ্যমে কাবুল দখল করলেও আন্তর্জাতিক ভাবে তালিবান ব্রাত্য। ভারত, আমেরিকা, জার্মানি, ব্রিটেন ও চীন মিলিয়ে ১২ টি দেশ আগেই তালিবানি শাসনকে স্বীকৃতি দেয় নি।
দেড়শোটির উপর মুসলিম দেশের মধ্যে মাত্র চারটির সমর্থন পেয়েছে তালিবান। শুধুমাত্র পাকিস্তান, সৌদি আরব, ইউনাইটেড আরব এমিরেটস ও তুর্কমেনিস্তান ছাড়া অন্য কোনো মুসলিম দেশের স্বীকৃতি মেলেনি তাদের।
ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন তালিবানের কাবুল দখলের একদিন আগে অর্থাৎ রবিবারেই আফগানিস্তানকে স্বীকৃতি দিতে অস্বীকার করেন।
এর আগে জার্মানি গত বৃহস্পতিবারে জানিয়েছে যে আফগানিস্তানকে ওই পশ্চিমি দেশ কোনোমতেই স্বীকৃতি দেবে না যদি তালিবান ক্ষমতায় আসে।
বিদেশ মন্ত্রী হেইকো মাস বলেন তালিবান আন্তর্জাতিক সাহায্যও ছাড়া বেশিদিন টিকতে পারবে না এবং তারা এই কথা ভালো করেই জানে।
“আমরা এক পয়সাও দেব না আফগানিস্তানকে যদি তালিবান ক্ষমতায় আসে, শরীয়ত আইন নিয়ে আসে ও খিলাফত প্রতিষ্ঠা করে,” মাস বলেন।
জার্মানি আফগানিস্তানকে প্রতি বছর ৪৩০ মিলিয়ন ইউরো দেয়। ন্যাটো সামরিক বাহিনীর হয়ে জার্মানির সন্যরা ২০ বছর আফগানিস্তানে কাটাবার পর গত জুন দেশে প্রত্যাবর্তন করে।
এদিকে বরিস জনসন ও সুর ছড়িয়েছেন তালিবানের বিরুদ্ধে। “আমরা চাই কোনো দেশ তালিবানকে স্বীকৃতি না দিক। আমরা চাই সমমনস্ক সব দেশ তালিবানের উপর চাপ সৃষ্টি করুক,” জনসন বলেন।
দুই দশকের উপর পর্বত কন্দরে কোনোমতে মুখ লুকিয়ে থাকা ১৯৯০ এর দশকের শেষের দিকের তালিবান ন্যাটো সৈন্য প্রত্যাহারের পর নিজেদের স্বমহিমায় ফিরে পেয়েছে।
তাহলে তালেবানদের মূল্য কত, এবং তাদের অর্থ কোথা থেকে আসে?
২০১৬ সালে, ফোর্বস তালিবানকে ১০ টি ‘সন্ত্রাসী’ সংগঠনের মধ্যে পঞ্চম ধনী হিসেবে তালিকাভুক্ত করেছিল। আইএসআইএস -এর তখন টার্নওভার ছিল ২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।
তালেবানদের ডলার উপার্জনের উত্স বহু ।
খনি: $ ৪৬৪ মিলিয়ন
ওষুধ: $ ৪১৬ মিলিয়ন
বিদেশী অনুদান: $ ২৪০ মিলিয়ন
রপ্তানি: $ ২৪০ মিলিয়ন
কর: $ ১৬০ মিলিয়ন (সুরক্ষা/চাঁদাবাজির টাকা?)
রিয়েল এস্টেট: $ ৮০ মিলিয়ন
বহু বছর ধরে সংস্থাটি বিদেশী অনুদান এবং অবদানের উপর নির্ভরশীলতা হ্রাস করছে। ২০১৭-১৮ সালে এটি আনুমানিক ৫০০ মিলিয়ন ডলার বা তার মোট তহবিলের প্রায় অর্ধেক বিদেশী উত্স থেকে পেয়েছিল। ২০২০ সালের মধ্যে এটি তাদের মোট রাজস্বের প্রায় ১৫ শতাংশে নেমে এসেছে।
একই অর্থবছরে আফগানিস্তান সরকারের আনুষ্ঠানিক বাজেট ছিল ৫.৫ বিলিয়ন ডলার, এর মধ্যে মাত্র ২ শতাংশেরও কম ছিল প্রতিরক্ষার জন্য।
আমেরিকা তালিবানদের সাথে সরাসরি যুদ্ধ করতে অথবা আফগান বাহিনীকে তালিবানের বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রশিক্ষণ দিতে ১৯ বছরেরও বেশি সময় ধরে প্রায় এক ট্রিলিয়ন ডলার সামরিক ব্যয়ে ব্যয় করেছে।
আপাতত অর্থভাণ্ডার পুষ্ট হলেও, অনুর্বর আফগানিস্তান তালিবান কতদিন চালাতে পারে সেটাই দেখার। ইতিহাস দেখিয়েছে আফগানিস্তান সবসময় ছিল পশ্চিমি দেশগুলোর, ছোট ছোট অংশে বিভক্ত স্থানীয় উপজাতি ও ইসলামীয় জঙ্গি বাহিনী গুলোর রণক্ষেত্র। গৃহ যুদ্ধে বিদ্ধস্ত থেকেছে ওই দেশ দীর্ঘ দশক ধরে। আন্তর্জাতিকভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে কিভাবে এবং কতদিন তালিবান দেশ চালায় সেটাই দেখার?