এই বাংলার বুকে প্রায় ২০০ বছর আগে শারিয়াহ আইন চালু করেছিল একজন, বামপন্থী বুদ্ধিজীবীদের কল্যাণে তাকে আমরা মহান স্বাধীনতা সংগ্রামী বলে জেনে এসেছি

আফগানিস্তানে সম্প্রতি শারিয়াহ আইন চালু হয়েছে বলে সংবাদ মাধ্যমগুলো হাহাকার করছে। কিন্তু এই বাংলার বুকে প্রায় ২০০ বছর আগে শারিয়াহ আইন চালু করেছিল একজন, বামপন্থী বুদ্ধিজীবীদের কল্যাণে তাকে আমরা মহান স্বাধীনতা সংগ্রামী বলে জেনে এসেছি।
১৮৩১ সালের ভাইফোঁটার দিনটা ছিল ৬ ই নভেম্বর। অধুনা উত্তর ২৪ পরগনা জেলার বাদুড়িয়ার পুঁড়োর বাজারে ৫০০ জেহাদী নিয়ে তিতুমীরের প্রধান সেনাপতি গোলাম মাসুম এলাকার সম্ভ্রান্ত বাসিন্দা মহেশ চন্দ্র ঘোষের একটা গরু ছিনিয়ে নিয়ে মন্দিরের সামনে কেটে বিগ্রহে গো-রক্ত মাখায়। গরুটিকে চার টুকরো করে পুঁড়োর বাজারের চার কোণে টাঙ্গিয়ে দেয়।

দীপাবলি-ভাইফোঁটায় মেতে থাকা বাঙালির এই ধরণের আক্রমণের অভিজ্ঞতা সেই অঞ্চলে আগে ছিল না। কিন্তু আরও অভিজ্ঞতা সঞ্চয় বাকি ছিল। আরবে শিক্ষাপ্রাপ্ত তিতুমীর বাঙালির সংস্কৃতিকে শেষ করতে ছিল বদ্ধপরিকর।

পরের দিন ইচ্ছামতীর অপর পারে পৌঁছায় জেহাদীরা। দুটি ষাঁড় মেরে ভোজ হয়। তারপর তাদের আক্রমণে লাউঘাট্টি বাজারে নিহত হন জমিদার তনয় দেবনাথ রায়। ফকির মিস্কিন শাহ এই জয়কে আল্লাহর জয় বলে ঘোষণা করে। তিতুমীর ঘোষণা করে, সে দার-উল-ইসলামের ঈমাম, তাকেই খাজনা দিতে হবে। জোর করে তোলা আদায় শুরু হয়।

তিতুমীরের উদ্ভাসের আগে ঊনিশ শতকের প্রারম্ভে বাংলাদেশে একটি মিশ্র সামাজিক এবং ধর্মীয় সংস্কৃতি বিরাজ করত। হিন্দু-মুসলমানের জীবনযাত্রার মধ্যে কিছু কিছু বৈসাদৃশ্য থাকলেও তার উগ্রতা অপেক্ষাকৃত কম ছিল বহু ক্ষেত্রে। গ্রামীণ মুসলমানদের মধ্যে জেহাদি তত্ত্ব তখনো প্রবলভাবে প্রবেশ করেনি। ফলে তাদের আচার-আচরণ ছিল সম্পূর্ণ মানবিক। বঙ্গদেশের মুসলমানরা চেহারায় ও বেশভূষায় হিন্দুদের থেকে পৃথক ছিল না। খাটো ধুতি, কাঁধে গামছা এই ছিল গ্রামের সাধারণ মুসলমানদের পোষাক। দাড়ি রাখা বা না রাখার বাছবিচার ছিল না। নামও ছিল তাদের হিন্দুঘেঁষা। যেমন পুরুষদের নাম দায়েম, কায়েম, সাজন, দানেশ, শেহেজান, শিহান, মধু এবং মেয়েদের নাম বাতাসী, কুড়ানী, শারী, শোভানী ইত্যাদি। এই মুসলমানরা নামাজ পড়ত ঠিকই, তবে একটিও আরবি শব্দের অর্থ না জেনেই। 

তিতুমীর তার এলাকায় ওয়াহাবিদের নিয়ে দল গঠন করে স্থানীয় মুসলমানদের বাধ্য করে নাম পরিবর্তন করতে, আরবিয়দের মতো জোব্বা পরতে, দাড়ি রাখতে। ধুতির বদলে 'তাহ্‌বান্দ' নামে এক ধরনের বস্ত্র পরিধান শুরু করে। স্থানীয় মুসলমানরা মহরমের দিনে স্থানীয় দরগাতে ‘নজর’ দিত। তিতুমীরের অনুসারীরা এসবের বিরোধিতা করত। তারাগুনিয়া গ্রামে একবার তিতুমীরের অনুসারীরা মহরম অনুষ্ঠানে বাধা দেয় এবং দরগায় লাথি মারে। এ ঘটনায় স্থানীয় মুসলমানরা নালিশ করল জমিদারের কাছে। এই শুরু হলো জমিদারের সঙ্গে তিতুমীরের বিবাদ, শুরু হলো রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের সূত্রপাত। সংঘর্ষ থামাতে হস্তক্ষেপ করতে বাধ্য হলো ইংরেজ সরকার। মামলা হলো তিতুমীর ও তার দলবলের বিরুদ্ধে। ফলে হিন্দুদের মতো ইংরেজ সরকারও তিতুমীরের বিরোধী পক্ষ হয়ে গেল। তিতুমীরের শত্রু ছিল পুঁড়োর জমিদার কৃষ্ণদেব রায়, গোবরডাঙার কালীপ্রসন্ন মুখোপাধ্যায়, তারাগোনিয়ার রাজনারায়ণ, নাগপুরের গৌরীপ্রসাদ চৌধুরী এবং গোবরা-গোবিন্দপুরের দেবনাথ রায়।       

১) সেপ্টেম্বর মাস, ১৮৩১ সাল: বারাসাত জেলার বাদুড়িয়ার অন্তর্গত নারকেলবেড়িয়া গ্রাম। পঞ্চাশ বিঘা নিস্কর জমির মালিক মৈজুদ্দিন বিশ্বাসের জমিতে অজস্র বাঁশ দিয়ে বুরুজ তৈরী হল।

২) ২৩/১০/১৮৩১: এক বিরাট ওয়াজে জিহাদ ঘোষণা হল। প্রাথমিক লক্ষ্য বৃটিশ শাসন ও হিন্দু জমিদারদের উচ্ছেদ, কারণ শরিয়ৎ বিপন্ন। ২৩/১০/১৮৩১ থেকে ০৬/১১/১৮৩১ পর্যন্ত মৌলবীরা কেল্লাতেই আটকে থেকে পরিকল্পনা চূড়ান্ত করল।

৩) ২৮/১০/১৮৩১: বসিরহাটের দারোগা বারাসতের জয়েন্ট ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে জানালেন জমিদার কৃষ্ণদেবের ওখানে তিতুমীরের অনুগামীরা গোহত্যা করতে চলেছে।

৪) ০৬/১১/১৮৩১: পুঁড়োর বাজারে ৫০০ জন জেহাদী তিতুমীরের প্রধান সেনাপতি গোলাম মাসুমের নেতৃত্বে মহেশ চন্দ্র ঘোষের একটা গরু ছিনিয়ে নিয়ে মন্দিরের সামনে কেটে বিগ্রহে গো-রক্ত মাখায়। গরুটিকে চার টুকরো করে পুঁড়োর বাজারের চার কোণে টাঙ্গিয়ে দিল।

৫) ০৭/১১/১৮৩১: ইচ্ছামতীর অপর পারে পৌঁছাল জেহাদীরা। দুটি ষাঁড় মেরে ভোজ হল। তারপর তাদের আক্রমণে লাউঘাট্টি বাজারে নিহত হলেন জমিদার তনয় দেবনাথ রায়। ফকির মিস্কিন শাহ এই জয়কে ‘আল্লাহর জয়’ বলে ঘোষণা করল। তিতুমীর ঘোষণা করল সে দার-উল-ইসলামের ঈমাম, তাকেই খাজনা দিতে হবে। জোর করে তোলা আদায় শুরু হল।

৬) ১৪/১১/১৮৩১: শেরপুর গ্রামে ইয়ার মহম্মদের বাড়ি আক্রমণ করল তিতু বাহিনী। ইয়ার মহম্মদের বিধবা কন্যা মুক্তবকে জোর করে নিকাহ করল তিতুর অনুগামী মহীবুল্লা। কনিষ্ঠা কন্যা কুমারী খুরমাকে অপহরণ ও নিকাহ করল কালু মিঞা।

৭) ১৬/১১/১৮৩১: ইন্ডিয়া গেজেট লিখল, রামচন্দ্রপুর গ্রামে হিন্দুদের মুখে জোর করে গোমাংস গুঁজে দেওয়া হচ্ছে।

এবার আলেকজান্ডার সাহেব তিতুর বিরুদ্ধে যাত্রা করলেন। বসিরহাট থানার দারোগা রামরাম চক্রবর্তীকে অপহরণ করল গোলাম মাসুম। বাঁশের কেল্লার মধ্যে হত্যা করা হল তাকে ইসলাম গ্রহণে অনিচ্ছুক হওয়ায়।
প্রথম দফার যুদ্ধে আলেকজান্ডার পরাজিত হয়ে পালালেন। 

৮) ১৯/১১/১৮৩১: আলেকজান্ডার, সাদারল্যান্ড ও ম্যাকডোনাল্ডের নেতৃত্বে বাঁশের কেল্লা আক্রমণ করল ইংরেজ সৈন্য। এক ইংরেজ সৈন্য মেক্কানকে হত্যা করে তার দেহ বল্লমে গেঁথে সামনে রেখে গোলাম মাসুমের নেতৃত্বে প্রতিরোধ করল তিতু বাহিনী।

  যুদ্ধ ..... যুদ্ধ ..... যুদ্ধ ......  

  তিতু সমেত জনা পঞ্চাশ জেহাদী নিহত, আহত জনা ত্রিশ, ২৫০ জন প্রায় ইংরেজদের হাতে বন্দী। ইংরেজ পক্ষে হতাহত ১৭। 

  জেহাদীদের বিচারের পর গোলাম মাসুমের মৃত্যুদন্ড হল, একুশ জনের যাবজ্জীবন কারাবাস, নয় জনের সাত বছরের, নয় জনের ছয় বছরের, ষোল জনের পাঁচ বছরের, চৌত্রিশ জনের তিন বছরের, বাইশ জনের দুই বছরের কারাদন্ড। বাকিদের নির্দোষ বলে ছেড়ে দেওয়া হল। ফটিক নামক এক হিন্দুকেও কেল্লা থেকে ধরা হয়েছিল, মানসিক ভারসাম্যহীন বলে সে মুক্তি পেল।

  গোলাম মাসুমকে জনসমক্ষে বাঁশের কেল্লার সামনে ফাঁসি দেওয়া হল।

  এই ভাবে বাংলার বুকে শরিয়ত চালু করার চক্রান্ত নির্মূল করা হল। 

তথ্যসূত্র: নবরূপে তিতুমীর, রুদ্র প্রতাপ চট্টোপাধ্যায়

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.