প্রথমে জানাব অবন ঠাকুরের ‘বাপ্পাদিত্য’ গল্প থেকে ঝুলন আনন্দের কথা- “সেই বনের একধারে আজ ঝুলন-পূর্ণিমায় আনন্দের দিনে, শোলাঙ্কিবংশের রাজার মেয়ে সখীদের নিয়ে খেলে বেড়াচ্ছিলেন।” রাজকুমারী বললেন- “শুনেছিস ভাই, বনের ভিতর রাখাল-রাজা বাঁশি বাজাচ্ছে!” সখীরা বললে- “আয় ভাই, সকলে মিলে চাঁপা গাছে দোলা খাটিয়ে ঝুলনো-খেলা খেলি আয়!” কিন্তু দোলা খাটাবার দড়ি নেই যে। সেই বৃন্দাবনের মতো গহন বন, সেই বাদলা দিনের গুরু গর্জন, সেই দূর বনে রাখালরাজের মধুর বাঁশি, সেই সখীদের মাঝে শ্রীরাধার সমান রূপবতী রাজনন্দিনী, সবই আজ সেই যুগযুগান্তরের আগেকার বৃন্দাবনে কৃষ্ণ-রাধার প্রথম ঝুলনের মতো। এমন দিন কি ঝুলনা বাঁধার একগাছি দড়ির অভাবে বৃথা যাবে? রাজনন্দিনী গালে হাত দিয়ে ভাবতে লাগলেন। আবার বাঁশি, পাখির গানের মতো, বনের এপার থেকে ওপার আনন্দের স্রোতে ভাসিয়ে দিয়ে বেজে উঠল। রাজকুমারী তখন হীরে জড়ানো হাতের বালা সখীর হাতে দিয়ে বললেন- “যা ভাই, এই বালার বদলে ঐ রাখালের কাছ থেকে একগাছা দড়ি নিয়ে আয়।”
রাজকুমারীর সখী সেই বালা হাতে বাপ্পার কাছে এসে বললে- “এই বালার বদলে রাজকুমারীকে একগাছা দড়ি দিতে পার?” হাসতে-হাসতে বাপ্পা বললেন- “পারি, যদি রাজকুমারী আমায় বিয়ে করে।”
সেই দিন সেই নির্জন বনে, রাজকুমারীর হাতে সেই হীরের বালা পরিয়ে দিয়ে রাজকুমার বাপ্পা চাঁপাগাছে ঝুলনা বেঁধে নিয়ে রাজকন্যার হাত ধরে বসলেন। চারিদিকে যত সখী দোলার উপর বর-কনেকে ঘিরে-ঘিরে ঝুলনের গান গেয়ে ফিরতে লাগল- “আজ কি আনন্দ! আজ কি আনন্দ!” খেলা শেষ হল, সন্ধ্যা হল; রাজকুমারী বনের রাখালকে বিয়ে করে রাজবাড়িতে ফিরে গেলেন; আর বাপ্পা ফুলে-ফুলে প্রফুল্ল চাঁপার তলায় বসে ঝুলন-পূর্ণিমার প্রকাণ্ড চাঁদের দিকে চেয়ে ভাবতে লাগলেন- আজ কি আনন্দ! আজ কি আনন্দ!
কৃষ্ণ দেবালয়ে এক অপূর্ব উত্সাহের বাতাবরণ ঝুলনযাত্রার কয়টি দিন। বর্ষাকাল। দাদুরী-ঘন কোলাহলে মুখর পল্লিপ্রকৃতি। কিশোর তরুণের খেলার আয়োজনে যেন জল ঢেলে দিয়েছে। প্রকৃতি এখন নিজেই খেলতে চায়- বিরাটের সঙ্গে, এক ঐশী ক্রীড়নক হয়ে। ‘বিরাট শিশু আনমনে খেলিছে’ বিশ্ব প্রকৃতিকে নিয়ে।
তখন আকাশে কজ্জল মেঘ, “স্নিগ্ধ সজল মেঘ কজ্জল দিবসে।” ঊর্ণা মেঘ, হাঁড়িয়া মেঘ, কুড়িয়া মেঘ, হিঙুলে মেঘ। যেন নানান মেঘের নবতর খেলা, নব মেঘের মগ্ন-বৈচিত্র্য। বাংলার মাঠ-ঘাট জলে থৈ-থৈ। বর্ষা ধারায় রসসিক্ত পত্রিকা, তখনই আসে ঝুলনের পরব। ঘরের মধ্যে তাই আয়োজন করা হয়েছে প্রকৃতির ছবি। বিশ্বপ্রকৃতির বর্ষা-ঘন-ল্যান্ডস্কেপ। এরই মাঝে ঝুলনায় ঝুলবেন রাই কিশোরী রাধা। আসবেন পুরুষোত্তম শ্রীকৃষ্ণ। তাই মাটি, বালি, ক্ষুদ্র-প্রস্তরখণ্ড দিয়ে, শেওলা, ঘাস-পাতা, পঞ্চগুঁড়ি দিয়ে খেলনা-প্রকৃতি রচনা করেছে পল্লিবাসী কিশোর, যেন আপন-বিলাসে শিল্প-বিদগ্ধতার এক অপরূপ রূপমাধুরী! মিনিয়েচার নেচার।
সব আয়োজন সম্পন্ন করে চিরশিশু সাজিয়ে দিয়েছে শ্রীরাধাকৃষ্ণের যুগলমূর্তি। আসে চন্দ্রালোকিত রাত্রি; জ্বলছে ঘিয়ের প্রদীপ, তার আলো-আঁধারিতে চিরকিশোর অবলোকন করছে আপন হাতে গড়া ঝুলনসজ্জা। যেমন আজকের বৃদ্ধ-শিশুরা পুরাতনী ভাবনায় স্মৃতির আলো-আঁধারিতে অবগাহন করে, তেমনই। সবুজের সমারোহে বিশ্বপ্রকৃতির সঙ্গে খেলা করতে আসেন পুরুষোত্তম শ্রীকৃষ্ণ, আর তাঁর হ্লাদিনী-শক্তি শ্রীরাধিকা। ভক্তের মনে প্রকৃতি-প্রেম, ঈশ্বর-প্রেম একাকার হয়ে যায়। ঈশ্বর নেমে আসেন তাঁর নিজের হাতে গড়া কাব্যে; অরণ্যে, সবুজ-শ্যামলিমায়। তমাল, চাঁপা, কদমের তলে কামিনী-কুসুমের ফুল্লরার দোলনায়; যূথীকা, মালতি, মাধবীলতার পুষ্পরেণুতে। সে এক চির পরিচিত অপরূপ পৃথিবী। পাহাড় বনান্তের ডাকে দেবতা প্রেম লীলায় আসেন; আসেন রাধামাধব। “ঝুলত ঝুলনে শ্যামর চন্দ”।https://www.youtube.com/embed/h6WoR7IDxlg?playsinline=1&modestbranding=1&fs=0&autoplay=1&loop=1&mute=1&enablejsapi=1&origin=https%3A%2F%2Fm.dailyhunt.in&widgetid=1
বাঙালির বারোমাসে তেরো পার্বণ। ঝুলনযাত্রা তার অন্যতম। এক অনবদ্য কৃষ্ণ-উত্সব। উত্সব কাকে বলে? যে আয়োজন উত্সাহ তৈরি করে, তাকে বলে উত্সব। যে কার্যক্রমের অনুশীলনে উদ্দীপনার সঞ্চার হয়, তা হল উত্সব। যে আনন্দ-যজ্ঞের পরতে পরতে উত্সাহের পরম ব্যঞ্জনা- তাকে উত্সব বলে।
শ্রাবণের একাদশী থেকে পূর্ণিমা পর্যন্ত পাঁচদিনের এক অপূর্ব উত্সাহ ও উদ্দীপনার আনন্দযাত্রা হল ঝুলন। ঝুলনযাত্রা দ্বাদশ-যাত্রার অন্যতম পরিক্রমা। দোলযাত্রা, স্নানযাত্রা, রথযাত্রা, রাসযাত্রার মতোই ঝুলনযাত্রা। এই সংস্কৃতির মধ্যে মাধব, মানস আর মেদিনী একাকার!
● লেখক বিধানচন্দ্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের হর্টিকালচার ফ্যাকাল্টির বিশিষ্ট অধ্যাপক। তাঁর বিশেষ খ্যাতি বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় ফোকলোর এবং ফল-ফুল-উদ্যান বিষয়ক লেখালেখির জন্য।