উপেক্ষিত বীরযোদ্ধা ” চুরকামুর্মু ” আত্ম বলিদান দিবসে শ্রদ্ধার্ঘ্য
(জন্ম -২ রা জুলাই ১৯৫১ , আত্ম বলিদান -১৮ই আগস্ট ১৯৭১ )
“কোটি শহিদের রক্তে রাঙানো
একটি আমর ধাম
সেইযে আমার দেশ ভারত বর্ষ নাম।”
চুরকামূর্মু
অবিভক্ত দিনাজপুর জেলার জেলাসদর বালুরঘাট,পশ্চিম বঙ্গের পিছিয়ে পড়া জেলা গুলির মধ্যে উন্নতম জেলা এই পশ্চিম দিনাজপুর । বর্তমানে দক্ষিণ দিনাজপুর জেলা । জেলা সদর বালুরঘাট, স্বাধীনতা আন্দোলনের পৃষ্ঠভূমি হিসাবে সুবিদিত ছিল পরাধীন ভারতের সময় থেকে। ১৯২৮ সালে নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু এই বালুরঘাটে এসেছিলেন এবং একদিন অবস্থান করেছিলেন। বিশিষ্ট স্বাধীনতা সংগ্রামী সরোজরঞ্জন চট্টোপাধ্যায়ের বাড়িতে রাত কাটিয়েছিলেন । স্মৃতি বিজড়িত সেই বাড়ির অর্ধেক অংশ আজ প্রমোটারদের দখলে। ১৯৪২ এর “ভারত ছাড়ো আন্দোলন” চরম রূপ পেয়েছিল এই বালুরঘাট শহরে।এই শহর ১৯৪৭ সালে ১৫ ই আগস্ট স্বাধীনতা পায়নি, বালুরঘাট ১৮ই আগস্ট স্বাধীনতা পায় এবং অবিভক্ত দিনাজপুর জেলা খণ্ডিত হয়ে পশ্চিম দিনাজপুর ভারতের অন্তর্ভুক্ত হয়।দেশ ভাগের সঙ্গে সঙ্গে এই জেলার পূর্ব অংশ পশ্চিম পাকিস্থানে চলে যায় যা বর্তমানে বাংলা দেশের অংশ। দেশ বিভাজনের সঙ্গে সঙ্গে জেলা বিভাজন এক বিভিশিকাময় পরিস্থিতি থেকে ধীরে ধীরে নিজেকে উত্তরণ ঘটিয়ে সাহিত্য,সংস্কৃতি, নাট্য চর্চার উৎকর্ষ শহর আজ জেলা সদর এই বালুরঘাট। প্রতি বছর ১৮ই আগস্ট তাই আজও জাতীয় পতাকা উত্তোলন করে জেলার ভারত ভুক্তির স্মরণ ও স্বাধীনতা দিবস উৎসাহ উদ্দীপনার মধ্যদিয়ে পালিত হয়।
এই সীমান্ত শহর বালুরঘাটের পূর্ব দিকে সীমান্তবর্তী গ্রাম চকরামপ্রসাদ।এই গ্রামেই ১৯৫১ সালে ২রা জুলাই এক দরিদ্র সাঁওতাল পরিবারে জন্ম চুরকামূর্মুর।তাঁর পিতা ছিলেন খেলা মুর্মু ও মা সুমি হাঁসদা।দারিদ্রতার মধ্যেও অত্যন্ত কষ্টের মধ্যে চুরকাকে তারা পড়াশুনা শিখিয়ে ছিলেন । গ্রামের পাঠশালায় পড়াশুনা শেষ করে বালুরঘাটে JLP বিদ্যাচক্র বিদ্যালয়ে পঞ্চম শ্রেণীতে ভর্তি হোন। এখানে পড়াশুনার সময় সংঘের শাখায় আসা শুরু ও সংঘের সঙ্গে পরিচয়। এই বিদ্যালয়ে দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশোনা।তাঁর শান্ত ও বিনয়ী স্বভাবের জন্য বিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা অত্যন্ত স্নেহ করতেন । চকরামপ্রসাদ গ্রামে সংঘের শাখা চুরকা মুর্মুর হাত ধরেই শুরু হয়।শাখার মুখ্য শিক্ষক ছিলেন চুরকা নিজে।উৎসাহী চুরকা ছাত্র অবস্থা থেকে বিভিন্ন জনকল্যাণমূলক কাজের সঙ্গে যুক্ত ছিল।একবার প্রশাসনিক সহযোগিতায় গ্রামে একটি কূপ খননও করেছিলেন।
রাষ্ট্র সর্বোপরি সাবলম্বী,স্বাভিমান, আত্মবিশ্বাস, জ্ঞানী, সুবুদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে দেশভক্ত যুব সমাজ তৈরী করার কাজ নিত্য শাখার মাধ্যমে করে চলেছে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ, শাখায় খেলাধুলার সঙ্গে সঙ্গে দেশ ভক্তির পাঠ নিয়মিত দেওয়া হয়।দেশের গৌরবময় ইতিহাস স্বয়ংসেবকদের সামনে নিয়মিত বলা হয় । ঠিক যেমন চুরকার শাখায় ১৯৬২ সালে ভারত চীন যুদ্ধের কথা।সেই যুদ্ধে দূর্গম অঞ্চলে ভারতীয় সৈন্যদের জন্য যুদ্ধ বিমান নামার জন্য স্বয়ংসেবকরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রানওয়ে তৈরী করা, সেনাদের জন্য রসদ পৌঁছে দেওয়া,আহত সেনাদের চিকিৎসা করা, রক্ত দান করার কাহিনী বা ১৯৬৫ সালে ভারত পাকিস্তান যুদ্ধের সময় ভারত সরকারের অনুরোধে টানা ২২ দিন দিল্লির ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ করেছে স্বয়ংসেবকরা । এই সব গল্প শুনতে শুনতে চুরকার মন ধীরে ধীরে তৈরী হয়েছিলো রাষ্ট্র সর্বোপরি এই মানসিকতায়।
১৯৭১ সালে পশ্চিম পাকিস্থানের খান সেনা ও পূর্ব পাকিস্তানের মুক্তি ফৌজের মধ্যে প্রবল লড়াই শুরু হয়।এই লড়াইয়ের ঢেউ আছড়ে পড়ে সীমান্তবর্তী এলাকা চকরামপ্রসাদ গ্রামেও।
১৯৭১ সালে ১৮ই আগস্ট চুরকা প্রতিদিনের অভ্যাস মতো ভোরবেলায় ঘুম থেকে উঠে প্রাতঃক্রিয়ার জন্য গ্রামের বাইরে গিয়েছিলেন, তখনি তার চোখে পড়ে পাকিস্থানের খান সেনারা তাদের পাশের গ্রাম চককালুতে ঢুকে পড়েছে। সেখান থেকে চকরামপ্রসাদ গ্রামের BSF ক্যাম্প লক্ষ্য করে গুলিবর্ষণ শুরু করেছে।চূরকার বুঝতে অসুবিধে হলোনা ,খান সেনাদের উদ্দেশ্য হল তাদের গ্রামের BSF ক্যাম্প দখল নেওয়া। চুরকা কালবিলম্ব না করে ছুটে গেলেন BSF ক্যাম্পে খান সেনাদের আক্রমণের খবর দেওয়ার জন্য।এইদিকে গ্রামের মানুষ প্রাণের ভয়ে বাড়ি ঘর খোলা রেখেই গ্রাম ছেড়ে পালানোর চেষ্টা শুরু করেছিলো।ব্যতিক্রমী চুরকা সে BSF ক্যাম্পে গিয়ে দেখে সেখানে মাত্র ৪/৫ জন ভারতীয় সৈনিক উপস্থিত।তারাও বিভ্রান্ত ছিলেন এই কয়জন ভারতীয় সৈনিক মিলে কিভাবে খান সেনাদের প্রতিহত করবে? এবং সর্বাপেক্ষা জরুরি বিষয় ছিল যে কে গুলির বাক্স বহন করবে?গুলির বাক্স বহনের জন্য যদি একজন ভারতীয় সৈনিককে ব্যবহার করা হয় তাহলে লড়াই করার একজন সৈনিক কমে যাবে।চুরকা BSF জওয়ানদের মনোবল বাড়িয়ে বললো, আমি সাঁওতাল যুবক, ভার বহন করার অভ্যাস আমার আছে।আমিই গুলির বাক্স কাঁধে বহন করে নিয়ে যাচ্ছি।এই কথায় BSF জওয়ানরা তাদের মনোবল ফিরে পেলেন।চুরকা মাথায় গুলির বাক্স নিয়ে BSF জওয়ানদের পথ দেখিয়ে নিয়ে চলল গ্রামের দক্ষিণ প্রান্তের দিকে।গ্রামবাসীরা তাকেও গ্রামের সকলের সঙ্গে গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার জন্য বললো।অদম্য সাহস ও সংঘের শাখায় দেশ ভক্তির পাঠ নেওয়া চুরকা গ্রামবাসীদের সঙ্গে না গিয়ে মাথায় গুলির বাক্স নিয়ে BSF জওয়ানদের পথ দেখিয়ে নিয়ে চললো নিজের গ্রাম তথা দেশমাতৃকার ভূমি রক্ষা করার জন্য।গ্রামের দক্ষিণ প্রান্তে পাট ক্ষেত সংলগ্ন পুকুর ধারে এসে উপস্থিত হলো।BSF জওয়ান যখন গাছের আড়ালে শুয়ে গুলি বিনিময়ের প্রস্তুতি নিলো । বিপুল সংখ্যায় খান সেনারা আগে থেকেই ওখানে ঘাপটিমেরে লুকিয়ে ছিল।প্রথম অবস্থায় BSF জওয়ানদের তা দৃষ্টিতে আসেনি। ফলে খান সেনারা সহজেই আমাদের সেনাদের চারদিক থেকে ঘিরে ফেলে।ফলে BSF দের আত্মসমর্পণ করা ছাড়া আর কোনো উপায় ছিলোনা।BSF জওয়ানেরা আত্মসমর্পণ করলো।এই সময় চুরকা মূর্মুও আত্মসমর্পণ করতে পারতো কিন্তু সেইসময় চুরাকা তা করেনি।সেই কঠিন পরিস্থিতিতে চুরকার নিজের জীবনের কথা মনে পড়েনি,মনে পড়েছে গ্রামবাসীদের কথা।তার সেইসময় মনে হয়েছে এই গুলির বাক্স যদি খান সেনাদের হাতে চলে যায় ,তাহলে এই গুলি দিয়ে আমার গ্রামবাসীদের হত্যা করবে।তাই গুলির বাক্স গুলি পুকুরের জলে অত্যন্ত সন্তর্পনে ডুবিয়ে দিতে হবে।যেমন ভাবনা তেমনি কাজ।গুলির বাক্স গুলি পাট ক্ষেতের ভিতর পথে বুকে ভর দিয়ে ধীরে ধীরে পুকুরের দিকে এগোতে লাগলো । প্রথম দুটি বাক্স জলে ডুবিয়ে দিতে সফল হলেও আগের দিন রাতে বৃষ্টি হওয়ায় পুকুর পাড় পিচ্ছিল থাকায় শেষ বাক্সটি জলে ডুবতে গিয়ে বাক্সের সঙ্গে চুরকাও পা পিছলে সশব্দে পুকুরের জলে পরে যায় । সেই শব্দকে লক্ষ্য করে খান সেনাদের গুলি বর্ষনে চুরকার শরীর ঝাঁজরা হয়ে যায়।পুকুরের জল বীরের রক্তে লাল হয়ে যায।দেশমাতৃকা তথা গ্রামবাসীদের রক্ষা করতে গিয়ে চুরকা নিজের জীবন উৎসর্গ করার কথা বলতে গিয়ে গ্রামবাসী ও তার প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষক আজও হাউ হাউ করে কেঁদে উঠে ।
১৯৭১ সালের পরেই ভারত পাক যুদ্ধ শেষ হয়।বিজয়ী হয় ভারত।জন্ম হয় নতুন বাংলাদেশ, অগণিত ভারতীয় বীর সৈনিকের সঙ্গে শহিদের মৃত্যু বরণ করে চুরকামূর্মু।রেখে গেলেন দেশবাসীর সামনে দেশ ভক্তি ও কর্তব্য পালনের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।বীর তরুণ চুরকা প্রমাণ করে গেল বুকে সাহস ও দেশপ্রেম থাকলে একটি মানুষ কি অসাধ্য সাধন করতে পারে।
সত্যি আজ ভাবতে অবাক লাগে ,৭১ এর যুদ্ধে দেশের সেনাবাহিনীর সর্ব্বোচ সাহসিকতার পুরস্কার ” পরমবীর চক্র”সন্মান পেয়েছিলেন চার জন ভারতীয় বীর সৈনিক । “মহাবীর চক্র ” পেয়েছিলেন কয়েক শো বীর সৈনিক।কিন্তু চকরামপ্রসাদ গ্রামের সাঁওতাল পাড়ার যুবকটির জন্য, সেইদিন দেশের অতন্দ্র প্রহরীর দায়িত্বে থাকা BSF এর আস্ত একটা ক্যাম্প রক্ষা পেয়েছিল।শুধু তাই নয় সাঁওতাল যে যুবকটি খান সেনাদের শক্তি বৃদ্ধি প্রতিরোধে “জীবন মৃত্যু পায়ের ভৃত্য” করে শহিদ হয়েছিলেন, তাকে আজ পর্যন্ত প্রশাসনের পক্ষ থেকে কোনো সন্মান দেওয়া হয় নি ? বাংলাদেশের মুক্তি যুদ্ধে খান সেনাদের বিরুদ্ধে লড়াই করে শহিদ অতিসাধারণ সাঁওতাল তরুণ চুরকামুর্মু আজও তার গ্রামবাসীদের হৃদয়ে ।রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ ছাড়া গ্রামের বাইরে তথাকথিত সুশীল সমাজ বা সাধারন মানুষ তাকে কেউ মনে রাখেনি । সত্যি কথা বলতে কি ,সরকারি ভাবে মনে রাখতে দেওয়া হয়নি।ইতিহাসে পাতায় তাঁর ঠাই হয়নি ।ঠিক যেমনটা হয়েছিলো মুক্তিযোদ্ধা বগুড়া ব্রিগেডের চিফ লক্ষণ সিং লাহেলের ক্ষেত্রে।যুদ্ধে আটক করা পাকিস্থানের স্যাফে ট্যাংকটি যিনি বালুরঘাটকে উপহার দিয়েছিলেন।যা আজও বালুরঘাট ট্যাঙ্ক মোড়ে প্রদর্শিত আছে ।
তবে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের উদ্যোগে গ্রামবাসীদের সহযোগিতায় ১৯৮২ সালে ১৮ই আগস্ট “চুরকামূর্মু স্মৃতি সমিতি” প্রতিষ্ঠা হয়।অসীম সাহসী, আত্মদানের স্মৃতিকে সদা জাগ্রত রেখে আগামী প্রজন্মের সামনে দেশ মাতৃকার প্রতি ভক্তি ও রাষ্ট্রসেবার সংস্কার দেবার স্থায়ী কেন্দ্র গঠনের উদ্যোগী হয়েছে।১৮ই আগস্ট চরকামূর্মু বলিদান দিবসে নত মস্তকে অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে জানায় ভাবপূর্ন শ্রদ্ধাঞ্জলী।
বিমল দাস
তথ্যসূত্র :-
১) উত্তরবঙ্গ সংবাদ (১৮ই আগস্ট ২০১৬ )
২) শিলিগুড়ি বার্তা (২৬ শে মার্চ ২০১৯ )
৩)সংবাদ প্রতিদিন (১লা আগস্ট ২০১৭)
৪) স্বর্গীয় রাধাগোবিন্দ পোদ্দার দার কাছ থেকে শোনা।