দুশ্চিন্তা আর আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন কলকাতার কাবুলিওয়ালারা

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গল্পে বাঙালি পাঠকের ঘরে ১২৯ বছর আগেই ঢুকে পড়েছিলেন কাবুলিওয়ালা। কলকাতার মিনির জন্য কাবুলিওয়ালার চোখে জল। কাবুল পতনের পর ১৮৯২ সালের সেই লেখনি আজ কতটা বাস্তব? আমি যখন গোলগাল, হাসিখুশি মিনির জন্য বাদাম, আখরোট, কিশমিশ নিয়ে আসি, সেটা আসলে মিনির জন্য আনি না। নিয়ে আসি সেই মেয়েটার জন্য, যাকে ফেলে এসেছি ওই পাহাড়ের কোলে। কে জানে, কেমন আছে আমার মেয়েটা!

সিনেমার পর্দায় কাবুলিওয়ালা এই প্রজন্মের অনেকেই দেখেননি। কিন্তু গল্পটা কমবেশি শুনেছেন। বঙ্গজীবনের অঙ্গ হয়ে উঠেছে কাবুলিওয়ালারা। সংখ্যায় কমলেও আজও কলকাতায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছেন এরকম অনেক কাবুলিওয়ালা। কাবুলের রাস্তায় নির্বাচিত সরকারের প্রশাসনের বদলে যখন অস্ত্র হাতে দাপাদাপি শুরু করেছে তালিবানরা, তখন দেশের ৪০০-র বেশি জেলার বেশিরভাগই তালিবানিদের দখলে চলে গিয়েছে।

কাবুল থেকে দূরে কলকাতায় মন ভাল নেই তাঁদের।

দু’টো সম্পূর্ণ আলাদা ভাষা। কিন্তু কলকাতার মঞ্চে বছর পাঁচ আগে রবীন্দ্রনাথের ‘কাবুলিওয়ালা’ নাটক করেন কাবুল বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়ারা, তখন প্রায় ২৩০০ কিলোমিটার দূরত্বের সেই ব্যবধান মনে ছিল না। সেই পরিবেশনার মাস ছয় আগে কলকাতা থেকে একটি আমন্ত্রণ যায় কাবুল বিশ্ববিদ্যালয়ের থিয়েটার বিভাগের শিক্ষক আহমেদ শামিম ফরহামান্দের কাছে, কলকাতায় এসে রবীন্দ্রনাটক করুন। ‘টেগোর’ শামিমের কাছে পরিচিত নাম, অনুবাদে কিছু কবিতাও পড়েছেন। কিন্তু কোন নাটক করা যেতে পারে, তা চট করে মাথায় আসছিল না শামিমের। কথা হয় বিভাগীয় প্রধান হুসেন জাদার সঙ্গে। আলোচনায় উঠে আসে ‘কাবুলিওয়ালা’র নাম। ‘‘গল্পটার কথা শুনেছিলাম, কিন্তু পড়া ছিল না’’— নাটকের পরে বলেন শামিম।

‘‘কোথায় পাওয়া যায়, যখন আকাশপাতাল ভাবছি, এক বাঙালি বন্ধুর কথা মনে পড়ে গেল। কর্মসূত্রে কাবুলেই থাকে ছেলেটা। বলা মাত্র বাড়ি থেকে তিন পাতার একটা গল্প এনে দিল আমায়।’’ শামিম জানান, বাঙালি বন্ধুটিই ইংরেজিতে অনুবাদ করে দেন গল্পটা। যেটা আবার নিজেরা অনুবাদ করে নেন দারিতে (আফগানিস্তানের দু’টি মূল ভাষার অন্যতম। অন্যটি পুশতু)। এই দারি ভাষাতেইয়এক রবি-সন্ধ্যায় আইসিসিআরে মঞ্চস্থ হয় ‘কাবুলিওয়ালা’। আয়োজনে কলকাতার সংস্থা ‘হ্যাপেনিংস’। কলকাতার দর্শকদের জন্য ইংরেজিতে ‘সাবটাইটেল’ পড়ে পিছনের স্ক্রিনে। ঘটনাটার গুরুত্ব এখানেই, অনেকের জানা নেই আফগানিস্তান মানেই গুলি-বন্দুক নয়। আফগানিস্তান মানে সংস্কৃতিও। তবে আমরা অনেকে আফগানিস্তান বলতে বুঝি কেবল কাবুলিওয়ালা।

গত রবিবার কাবুল পতনের পর থেকে ওঁদের মন ভাল নেই। আফগানিস্তান থেকে আমেরিকা ও ন্যাটোর বাহিনী সরতেই মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে ২০১৮ সালের ‘ফোর্বস’ পত্রিকার বিচারে বিশ্বের দ্বিতীয় ধনীতম জঙ্গিগোষ্ঠী তালিবান। শুরু হয় খুন, দখল, মহিলাদের উপর অত্যাচার। তার পর কাবুল-পতন। কাবুলিওয়ালা’রা ঠিক কবে কলকাতায় এসেছেন বলা মুশকিল। বর্তমানে রাজ্যের বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছেন। তেমনই মধ্য কলকাতার সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউয়ের আশপাশে বৌবাজার, চাঁদনি চক এলাকায় থাকেন অনেকে। এঁদের পূর্ব পুরুষরা আফগানিস্তান থেকে এসেছেন। শিকড় ওই দেশে হলেও নতুন প্রজন্মরা ভারতীয়। কলকাতার চাঁদনি চকে থাকেন কাশেম খান। জন্ম কাবুলে। এখনও সেখানে আত্মীয়রা রয়েছেন। বাবার সঙ্গে কাবুল থেকে এসেছিলেন। পেশায় কাপড়ের ব্যবসায়ী কাশেম বললেন,‘‘খবর পেয়েছি ওখানে আত্মীয়রা এখনও ঠিক আছেন।’’ চিন্তা হচ্ছে? তাঁর কথায়, ‘‘চিন্তা তো হবেই। দেশটা গড়ে উঠছিল। জানি না, নতুন যারা এসেছে তারা কী করবে এ বার! কাবুলের অবস্থাই বা কী হবে!’’

তবুও গত কয়েক দিনে কাবুল-সহ আফগানিস্তানের পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করতে রাজি নন অধিকাংশই। ধর্মতলার মসজিদের আশপাশে কাবুলিওয়ালাদের দেখা পাবেন। নামী ইংরেজি কাগজের অফিসের গেটের সামনে ফুটপাথের ওপর বাইক তুলে রাখছিলেন জোব্বা পরা আস্ত এক কাবুলিওয়ালা। পোশাক আর লালচে গালই তাঁর পরিচয় বলে দেয়। কাছে গিয়ে ভাব জমাতে তিনি পালাই পালাই ভাব শুরু করলেন। নিজের নাম বলা দূরে থাক, তার একটাই কথা, “৩১ বছর আগে আমি বাবা-মার হাত ধরে কলকাতায় এসেছি। তারপর থেকে আফগানিস্তানের সঙ্গে কোনও যোগাযোগই আমার নেই।“ দেশের জন্য আপনার উদ্বেগ হয় না? অপ্রস্তুত হয়ে বললেন, ‘’না, না। টিভিতে খবর দেখেছি। কিন্তু আমার তো এখন কলকাতাই সব। আমি এখানকার নাগরিক। কাবুলের সঙ্গে আমার কীসের লেনাদেনা বলুন?’’ বলেই লম্বা লম্বা পায়ে মসজিদের পিছনের রেস্তোরাঁগুলির দিকে হনহনিয়ে হাঁটা দিলেন তিনি।

মসজিদের আশপাশের এলাকায় যেসব ছোটখাটো রেস্তোরাঁয় কাবুলিওয়ালারা খাওয়াদাওয়া সারেন, সেখানেও ইদানীং বেশিক্ষণ থাকছেন না তাঁরা। ওই রেস্তোরাঁগুলির কর্মচারীরাই জানালেন, কাবুল নিয়ে কোনওভাবেই কারও কাছেই মুখ খুলছেন না তাঁরা। তবে নিজেদের ভাষায় কথা বলার সময় তাঁদের চোখেমুখে ফুটে উঠছে উদ্বেগ আর উত্‍কণ্ঠা।চাঁদনি মার্কেটের বিখ্যাত মোগলাই রেস্তোরাঁটির অদূরে এক কাবুলি পরিবারের বাস। কাঠের দরজা খোলা, সংলগ্ন কোলাপসিবলে বন্ধ। ডাকাডাকি করতে এক দীর্ঘদেহী ব্যক্তি ভ্রু কুঁচকে সন্দেহের চোখে তাকালেন। কোনওকিছুই বলতে নারাজ তিনি। পাঁচ মিনিট ধরে অনেক ভাব জমানোর চেষ্টাতেও মন গলানো গেল না। তাঁর একটাই কথা, ‘আমি এখানে বহুদিন আগেই পরিবার নিয়ে এসেছি। আমি এখানকার নাগরিক।“ প্রশ্নের উত্তরে বললেন, “কাবুল নিয়ে আমার কোনও মাথাব্যথা নেই। পালটা প্রশ্ন, ‘সেকি আপনার আত্মীয়স্বজনও নেই?” এরপর তাঁর নিরুপায় জবাব, “আমি কিছু বলতে পারব না। বাড়িতে কেউ নেই।’ নাছোড়বান্দা প্রশ্ন, আপনার পরিবার কোথায় তাহলে? এবার তিনি বিরক্ত। বললেন, ‘‘আমার কাছ থেকে কোনও জবাব পাবেন না। আমি ভালো হিন্দি বলতে পারি না।’’ ভাঙা হিন্দিতে তিনি বুঝিয়ে দিলেন, রহমতের সময়ে তালিবানরা ছিল না। তাই দেশে ফেলে আসা খোঁকি’র জন্য তাঁর মন কেমন করলেও পরিবারের জন্য আতঙ্কে কাটাতে হয়নি তাঁকে। 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.