কাবুলের পতনের পর সেখানকার মহিলাদের নিয়ে চিন্তা শুরু হয়েছে গোটা বিশ্বে। এর সূত্রেই চর্চার কেন্দ্রে ফিরে এসেছে একটি বই ‘কাবুলিওয়ালার বাঙালি বউ’। বইয়ের লেখিকা সুস্মিতা বন্দ্যোপাধ্যায় (বিবাহ পরবর্তী নাম সৈয়েদা কমলা) এক আফগানকে বিয়ে করেন। তালিবান শাসনে আফগানিস্তানে বসবাসের অভিজ্ঞতা থেকে তিনি ১৯৯৭ খ্রিষ্টাব্দে স্মৃতিধর্মী বই লেখেন। ২০০৩ খ্রিষ্টাব্দের ৪ঠা সেপ্টেম্বর আফগানিস্তানের পাক্তিকা প্রদেশে ৪৯ বছর বয়সে তালিবান জঙ্গীদের গুলিতে তাঁর মৃত্যু হয়।
সুস্মিতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্ম ১৯৬৪ খ্রিষ্টাব্দে কলকাতায়। ১৯৮৮ খ্রিষ্টাব্দের ২ জুলাই তিনি কলকাতায় জানবাজ খান নামে এক আফগানকে গোপনে বিয়ে করেন।
তাঁর বাবা-মা বিয়ের খবর জানতে পেরে তাঁকে বিচ্ছেদের জন্য বললে তিনি জানবাজের সাথে আফগানিস্তান চলে যান। কিন্তু সেখানে গিয়ে তিনি আবিষ্কার করেন যে তাঁর স্বামীর আগেই গুলগুটি নামক এক মহিলার সাথে বিয়ে হয়ে গেছিল। তা সত্ত্বেও তিনি খানের পাতিয়া গ্রামে পারিবারিক বাড়িতে থেকে যান।ধাত্রীবিদ্যায় প্রশিক্ষিত সেবিকা হওয়ায় তিনি সেই গ্রামের মহিলাদের জন্য এক স্বাস্থ্যকেন্দ্র খোলেন।
আফগানিস্তানে তালিবান শাসন শুরু হলে, সুস্মিতা সেই দেশে মৌলবাদী শক্তির বিকাশ লক্ষ্য করেন।তালিবান শাসনে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলি বন্ধ করার আদেশ জারির পর ১৯৯৫ সালের মে মাসে তালিবানরা তাঁর বানানো স্বাস্থ্যকেন্দ্রটি আবিষ্কার করে তাঁকে প্রচন্ড মারধোর করে। এর পর তিনি দু’বার পালানোর চেষ্টা করে ধরা পড়েন। তাঁকে গ্রামে ঘরবন্দী করে রাখা হয়। তাঁর বিরুদ্ধে এক ফতোয়ায় ১৯৯৫ খ্রিষ্টাব্দের শে জুলাই তার মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। কিন্তু গ্রামের প্রধানের সহায়তায় তিনি তিনজন তালিবানকে একে-৪৭ রাইফেলের সাহায্যে গুলি করে গ্রাম থেকে পালাতে সফল হন। তিনি সেখান থেকে কাবুল পৌঁছে ১২ আগষ্ট বিমানে কলকাতা চলে আসেন। ২০০৩ খ্রিষ্টাব্দ অবধি তিনি ভারতে বাস করেন ও বহু বই লেখেন। তার পর তিনি আফগানিস্তান ফিরে যান এবং পাক্তিকা প্রদেশে স্বাস্থ্যকর্মী হিসেবে কাজ করেন। সেখানকার মহিলাদের জীবনযাত্রা নিয়ে তিনি একটি চলচ্চিত্র বানানো শুরু করেন।
সন্দেহভাজন তালিবান জঙ্গীরা ২০০৩ খ্রিষ্টাব্দের ৪ঠা সেপ্টেম্বর পাক্তিকা প্রদেশে তাঁর বাড়িতে জোর করে ঢুকে তাঁর স্বামীকে বেঁধে তাঁকে তালিবানরা অপহরণ করে নিয়ে যায়। আফগান পুলিশের মতে, পরের দিন সকালে প্রাদেশিক রাজধানী শারানা শহরের এক প্রান্তে এক মাদ্রাসার পাশে তাঁর মৃতদেহ পাওয়া যায়। তাঁর দেহে ২০টি গুলির ছিদ্র পাওয়া যায়। আফগান পুলিশের মতে তাঁকে সামাজিক কাজকর্ম ও তার লিখিত বইয়ের জন্য অথবা শুধুমাত্র ভারতীয় হওয়ার জন্য খুন করা হয়। যদিও তালিবানরা দাবি করে, তারা এই আক্রমণ করেননি।
পরবর্তীকালে আফগানিস্তানের ইসলামি আন্দোলনের আত্মঘাতী দল নামক একটি তালিবানপন্থী জঙ্গীদল এই ঘটনার দায়িত্ব স্বীকার করে নেয়। মোল্লা নাজিবুল্লাহর নেতৃত্বাধীন এই দলটির পক্ষ থেকে এক প্রতিনিধি জানান যে, তাঁরা সুস্মিতাকে ভারতীয় চর বলে সন্দেহ করতেন বলে হত্যা করেছেন। যদিও সুস্মিতার প্রতিবেশীদের মতে তার মৃত্যুর জন্য বাড়ির বাইরে বোরখা না পরাও কারণ হতে পারে।সুস্মিতা বন্দ্যোপাধ্যায় ১৯৯৫ খ্রিষ্টাব্দে ‘কাবুলিওয়ালার বাঙালি বউ’ নামে বইটি লেখেন। এই বইয়ে তার আফগান ব্যবসায়ী জানবাজ খানের সাথে প্রেম ও বিবাহ, ১৯৮৯ খ্রিষ্টাব্দে আফগানিস্তানে চলে যাওয়া, তালিবান শাসনে মুখোমুখি হওয়া প্রতিকূলতা ও সেখান থেকে ভারতে পলায়ন, এই কাহিনী বর্ণিত আছে। ২০০৩ খ্রিষ্টাব্দে তাঁর বইকে ভিত্তি করে বলিউড থেকে ‘এস্কেপ ফ্রম তালিবান’ নাম এক চলচ্চিত্র তৈরী হয়। এছাড়াও তিনি ২০০০ খ্রিষ্টাব্দে ‘তালিবানি অত্যাচার – দেশে ও বিদেশে’ ও ‘মুল্লাহ ওমর’, ‘তালিবান ও আমি’ এবং ২০০১ খ্রিষ্টাব্দে ‘এক বর্ণ মিথ্যে নয়’ ও ‘সভ্যতার শেষ পুণ্যবাণী’ লেখেন।