তিনি সেইদিন বেঁচেছিলেন কি করে? তিনি অর্থাৎ জ্যোতি বসু, সেইদিন ১৬ই আগস্ট, ১৯৪৬। কমরেড মণিকুন্তলা সেনের সাথে হাজির ছিলেন তাঁর পরম শুভানুধ্যায়ী মুসলিম লীগের সুরাওয়ার্দির ডাকা হিন্দু কোতলের মিটিংয়ে। সুরাওয়ার্দি তাঁকে ডাকতেন জ্যোতি বলে, বাঙাল প্রফুল্ল চন্দ্র ঘোষ ও লোকসেবক সঙ্ঘের সুরেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁকে ডাকতেন যুতি বলে। কিন্তু ধুতি-পাঞ্জাবী পরিহিত তিনি সেইদিন বেঁচে গিয়েছিলেন, সাথে শাড়ি পরিহিতা কমরেড সেনও এবং ফিরে গিয়ে রাজ্য কমিটি অফিসে রিপোর্ট করেছিলেন যে দাঙ্গা শুরু হয়ে গিয়েছে। আর একজন, ধুতি-পাঞ্জাবী পরিহিত যোগেন্দ্রনাথ মন্ডল সেইদিন ছিলেন মুসলিম লীগের মঞ্চে, blue eyed boy হয়ে। কিন্তু ময়দান থেকে সিপিআই-এর ডেকার্স লেনে স্থিত রাজ্য কমিটির অফিসের দূরত্ব বেশ খানিকটা। দাঙ্গা (অর্থাৎ তখনকার মতো চৌরঙ্গী রোড জুড়ে ঐসলামিক মৌলবাদীদের নৃশংস আক্রমণ হিন্দুদের উপরে) শুরু হয়েছে তাঁরা সুরক্ষিত হয়ে ফিরেছিলেন অর্থাৎ আনসার বাহিনী (মুসলিম লীগের মিলিশিয়া) সযত্নে তাঁদের আপন কমরেডদের পৌঁছে দিয়ে গিয়েছিল। এবং সেই শুরু।
কথিত আছে, বিধ্বস্ত সুরাওয়ার্দি একটি মিটিং করতে চেয়েছিলেন শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের সাথে, জ্যোতি বসুকে সঙ্গে নিয়ে। শ্যামাপ্রসাদ জিজ্ঞেস করেছিলেন যে তিনি ও সুরাওয়ার্দি যথাক্রমে হিন্দু ও মুসলমানের প্রতিনিধিত্ব করবেন কিন্তু জ্যোতিবাবু কার প্রতিনিধি। এরপরে মিটিংটি আর হয়নি বিশেষ। সম্ভবত এই কারণের জন্যই ১৯৫৩ সালে শ্রী শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের মরদেহে মাল্যদান করতে জ্যোতিবাবুকে দেখা যায়নি। অবশ্য শ্রেণীশত্রু বা হিন্দু সাম্প্রদায়িকতার প্রশ্ন থাকতে পারে। কিন্তু ১৯৭২ সালে সিপিআই ও একসময়ের অবিভক্ত কম্যুনিস্ট পার্টির নেতা কমঃ ভবানী সেনের মরদেহেও তাঁকে বা তাঁর পার্টির তরফ থেকে কাউকে মাল্যদান করতে দেখা যায়নি। The Statesman তো এই ঘটনার রিপোর্ট করতে গিয়ে লিখেই ফেলেছিল, “All were present at Mr. Sen’s funeral with the conspicuous absence of CPI(M) leadership”… ১৯৭১ সালে একটি সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, “নকশালরা বোমা ছুঁড়লে কি আমরা রসগোল্লা ছুঁড়ে দেব!?” কিন্তু নিউটনের থার্ড ল’ জড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল ২০০২-এর গুজরাট দাঙ্গাকে কেন্দ্র করে শ্রী নরেন্দ্র মোদীর একটি বক্তব্যকে কেন্দ্র করে। আজব কম্যুনিস্ট – মতপার্থক্যের জেরে ex-comrade-এর সাথে মুখ দেখাদেখি বন্ধ বা গলার নলি কাটা চালু – কিন্তু সারা দুনিয়াকে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্রের পাঠ পড়াতে থাকে উৎসাহী।
আজীবন জ্যোতিবাবু centrist – তাই কম্যুনিস্ট পার্টি ভাঙলে তিনি থাকেন মধ্যভাগে CUCI (Communist Unity Centre of India) করে। তাঁর সিপিআইএম-এ ঢোকা ছিল নাকি একপ্রকার নিষিদ্ধ, তিনি সংশোধনবাদের প্রতীক বলে। তাঁর গতি ছিল সিপিআই – কিন্তু সব তাবড় নেতা/communist luminaries – এর গন্তব্য হল সিপিআই (party of the brain) তাই তিনি এলেন সিপিআইএম-এ (party of the brawn) বকের মধ্যে হংস হতে . বিজয় মোদক ও অন্যান্যরা এ নিয়ে চেপে ধরলে তিনি বলেছিলেন, “যাইনি তো! ওঁরা এসেছেন আমার কাছে। আপনারাও আসুন।” মাধ্যাকর্ষণ শক্তির সাথে মধ্যমেধার সংযোগ নাকি অসীম। তাই সিপিআইএম-এ তিনি safest & most prominent থাকতে চাইলেন। এবং তাঁর পার্টিতে যোগদানে যাঁরা বিপদের ছায়া পেলেন, প্রতিবাদও করলেন তাঁরা ১৯৬৭ সালে নকশালবাড়ি সংগ্রামের মধ্য দিয়ে পার্টি থেকে বহিষ্কৃত হলেন।
প্রমোদ দাশগুপ্তের সাথে তাঁর সংগ্রাম এক চিরকালীন চিত্তাকর্ষক বিষয়। ১৯৮২ সালে রাজ্য সরকারী কর্মচারীদের pen down strike নাকি প্রমোদ লবিরই অবদান ছিল তাঁকে harass করার জন্য। অবশ্য তিনিও কম নন, “কাকে কাজ করতে বলব? ফাঁকা চেয়ারকে?” বলে সেই হরতাল এক ফুঁয়ে নিভিয়ে দিয়েছিলেন। যেমন করেছিলেন হরতালদা অর্থাৎ যতীন চক্রবর্তীকে ১৯৮৮-এর বেঙ্গল ল্যাম্প কেলেঙ্কারিতে নিজের ছেলে চন্দনকে বাঁচাতে। পাতে মাছের মুড়ো, সর দেওয়া দুধ আজীবন খেতে তার পায়ে ঝাঁপালো আরএসপি জ্যাকিদা ও বামপন্থাকে চপেটাঘাত করে। লোডশেডিংয়ের স্বর্ণযুগে পরিত্রাণ পেতে তিনিই নিয়ে এসেছিলেন শঙ্কর সেন (৩৪ বছরের বামফ্রন্টের সম্ভবত একমাত্র মন্ত্রী যাঁর ঐকান্তিক প্রচেষ্টা ও সাফল্য দুইই রয়েছে) কে। অবশ্য বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদন হলে বৈজ্ঞানিক মার্কসবাদের অবৈজ্ঞানিক ছাত্রের মতো বলেছিলেন, “এত বিদ্যুৎে কি হবে? আমরা কি বিদ্যুৎ খাবো?” অথচ শঙ্করবাবুর মেয়ে নাকি যখন kidnapped হয়েছিল ঠিকাদারদের দ্বারা তিনি রইলেন নীরব। বিদ্যুৎ সংস্থা বাঙ্গালীর হস্তমুক্ত হল।
সর্বশক্তিমান বৈজ্ঞানিক মার্কসবাদের অবৈজ্ঞানিক ছাত্ররূপে তিনি নেতৃত্ব দিলেন কম্পিউটার বর্জনে। সেকি তর্জন-গর্জন। অথচ dialectics-এর মূল কথা thesis, anti-thesis ও synthesis… তিনি বিজ্ঞানকে কানে নিয়েছিলেন ব্রেনে নেননি। ১৯৯০ সালে তাঁর বিদায় নাকি একপ্রকার নিশ্চিত হওয়াতে, কমরেড বিমান বসুর উন্নয়নও পার্টির মধ্যে নিশ্চিত হওয়াতে খাঁটি opportunist-এর মতো ঠিক সময়ে এনে ফেললেন কমরেড হরকিষেণ সিংহ সুরজিৎের চিঠি, আজীবন নীরব কর্মের জন্য শৈলেন দাশগুপ্তের পদমর্যাদার প্রাপ্তির আকাঙ্ক্ষায়। বিমান out, শৈলেন in, জ্যোতি stays..
তাহলে জ্যোতিবাবুর গুণ নেই!? সেকি!! তাঁর মতো opportunist & negotiator across party lines আর নেই, দ্বিতীয় হবে কিনা সন্দেহ। তামাম বাম থেকে দক্ষিণ তাঁর ব্যক্তিগত বন্ধুবৃত্তের মধ্যে পড়ে। প্রমাণ? ১৯৭৮এ মরিচঝাঁপি গণহত্যার সময়ে কেন্দ্রে অবস্থিত জনতা সরকার টুঁ শব্দ করেনি, যেমন করেনি ইন্দিরা গান্ধী সরকার ১৯৮২তে আনন্দমার্গী গণহত্যায়। ‘বিরোধী হত্যায় এ রাজ্য বেনজির” বলে পাশ কাটিয়েছিলেন ইন্দিরা। ১৯৮০ সালে প্রত্যাবর্তন করা ইন্দিরা গান্ধী একলহমায় ৮টি বিরোধী সরকার ফেললেও বামফ্রন্ট রইল তাঁর ক্রোধ প্রকাশের আওতার বাইরে। কেন? জানা নেই উত্তর তবে নিন্দুকেরা বলে এটি গান্ধী – বসুর ব্যক্তিগত কেমিস্ট্রির ফল। নইলে ৬০-এর দশকে মন্ত্রের মতো বিপ্লব শব্দটি উচ্চারণ করা পিডিজি (প্রমোদ দাশগুপ্ত) ও মিইয়ে গেলেন আর শেষে, ‘৮২তে বামফ্রন্টের ক্লাস ওয়ান থেকে ইংরেজি তুলে দেওয়ার বিরুদ্ধে প্রতিবাদরত এস ইউ সি আই-এর নেতৃত্বে গণ আন্দোলনে ও বিশাল মিছিলে অংশগ্রহণকারী ডঃ সুকুমার সেন, প্রেমেন্দ্র মিত্র, আশাপূর্ণা দেবী, মৈত্রেয়ী দেবী প্রমুখকে সাম্রাজ্যবাদের দালাল বলে বসলেন!!?
কেমিস্ট্রিই সব। ব্যক্তি ও পার্টিজীবনে চূড়ান্ত snob (শোনা যায়, কমরেড বিলাসীবালা সহিসকে চায়ের দোকানওয়ালি বলে ভুল করেছিলেন) অথচ পুঁজিপতিদের ভিড়ে ক্যালকাটা ক্লাবে মহার্ঘ হুইস্কির পাত্রে চুমুক দিতে সদা অভ্যস্ত সহাস্য জ্যোতিবাবু জীবনে একবারই মাত খেয়েছিলেন ইএমএস নাম্বুদ্রিপাদের একদা স্টেনোগ্রাফার হাঁটুর বয়সী প্রকাশ কারাতের কাছে – প্রধানমন্ত্রীত্ব আর বলবৎ হয়নি জীবনে। কম্যুনিস্টরা শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে পৃথিবীর বহু স্থানে উন্নত করেছেন কিন্তু জ্যোতিবাবু পশ্চিমবঙ্গে তা করেননি বা করতে চাননি। সরকার না চাইলে দাঙ্গা হয়না, সরকার না চাইলে উন্নয়নও হয়না। যেমন চাননি জ্যোতিবাবু। ১৯৬৯-৭৪-এর ঝঞ্ঝা সামলেও যে পশ্চিমবঙ্গের জাতীয় উৎপাদনে হার ছিল ১০%-এর আশেপাশে তা বামফ্রন্ট আমলে সেই যে ৪%এ নেমে এসেছিল আর বাড়েনি। দিকে দিকে মনা মাস্টারকে বাড়তে দিয়েছেন যাদের কাজ একমাত্র ছিল শিল্পতালুকে তালা ঝোলানো। এখন অবশ্য সিপিআইএম রত্নাকর থেকে বাল্মীকি হওয়ার ভান করতে ব্যস্ত।
আজীবন সাম্যের কথা বলে party bureaucracy রেখে দিয়েছেন সেই তথাকথিত বর্ণ হিন্দু যথা বামুন-কায়েত-বদ্যিদের হাতে, যদিও তাঁর কথানুযায়ী অসভ্য বর্বরের দল বিজেপি তথা সঙ্ঘ পরিবারে দলিত হিন্দুদের সংখ্যা ও প্রভাব প্রশ্নাতীত। আজীবন ধুতি-পাঞ্জাবী পরিহিত জ্যোতি বসু পিঠে ছুরি বসিয়েছেন তাঁদের যাঁদের জাতীয় পোশাক এটি – অর্থাৎ বাঙ্গালী হিন্দুর।
এই আমাদের জ্যোতিবাবু ওরফে জ্যোতি বোস…. বাঙ্গালীর পতনের অন্যতম দুর্জন।
© Animitra Chakraborty