হার নেহি মানুঙ্গা, রার নেহি ঠানুঙ্গা, কাল কে কপাল পর লিখতা মিটাতা হুঁ। গীত নয়া গাতা হুঁ।

অটলবিহারী বাজপেয়ী। নামটা শুনলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে সেই ছন্দময় বাগ্মীতা। স্বাধীন ভারতের দশম প্রধানমন্ত্রী। বিজেপির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। পদ্ম শিবিরের ‘বিকাশ পুরুষ’। সবমিলিয়ে গেরুয়া বৃক্ষের ছায়াতলের বাইরেও তিনি নিজেই একটি প্রতিষ্ঠান। রাজনীতির অলিন্দের বাইরে কবিতার খাতাতেও সমান সাবলীল তাঁর কলম। বৃহস্পতিবার বিকাল ৫টা ৫মিনিটে দিল্লির এইমস-এ তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করার সঙ্গে সঙ্গেই ভারতীয় রাজনীতিতে শেষ হল এক অবিস্মরণীয় অধ্যায়। আর এ জন্যই ব্যক্তি অটল বিহারী বাজপেয়ী বিরোধীদের শ্রদ্ধা ও প্রশংসাও আদায় করে নিয়েছেন।

রাজনীতিকে নিজের রক্তে মিশিয়ে নিতে পেরেছিলেন অটলবিহারী বাজপেয়ী। গোয়ালিয়ের আর পাঁচটা সাধারণ পরিবারের ছেলের মতোই বড় হয়ে উঠেছিলেন তিনি। বাবা স্কুল শিক্ষক কৃষ্ণবিহারীও কবি হিসেবে পরিচিত ছিলেন। তাঁর কাছ থেকেই ছন্দের অনুরাগ পেয়েছিলেন হিন্দি সাহিত্যের ছাত্রটি। তরুণ অটলের রাজনৈতিক জীবন শুরু হয় আর্য সমাজের হাত ধরে। সংগঠনের যুব শাখা আর্য কুমার সভায় যোগ দেন তিনি। ১৯৪৪ সালে সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক হন। এর পাশাপাশি রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘের সঙ্গেও ঘনিষ্ঠতা বাড়ছিল তাঁর। বাবাসাহেব আপ্তের হাত ধরে ১৯৩৯-এ স্বয়ং সেবক হিসেবে যোগ দেন আরএসএস-এ। ১৯৪০-৪৪ সঙ্ঘের প্রশিক্ষণ শিবিরে ছিলেন তরুণ অটলবিহারী। ১৯৪৭ সালে পূর্ণসময়ের কর্মী হিসেবে যোগ দেন আরএসএসে। এরমধ্যেই রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর হন অটলবিহারী বাজপেয়ী। তখনকার দিনে প্রথম শ্রেণিতে স্নাতকোত্তর হওয়াই তাঁর মেধার পরিচয়বাহী। বিস্তারক হিসেবে তাঁকে উত্তর প্রদেশে পাঠায় আরএসএস। দীনদয়াল উপাধ্যায়ের রাষ্ট্রধর্ম পত্রিকায় কাজ শুরু করেন। একই সঙ্গে লেখালিখি চলতে থাকে পাঞ্চজন্য-সহ অন্য পত্রিকাগুলিতেও।

৩০ জানুয়ারি ১৯৪৮। নাথুরাম গডসের হাতে গান্ধীর হত্যার পর দেশ জুড়ে নিষিদ্ধ করা হয় আরএসএস-কে। শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের জনসঙ্ঘে যোগ দেন বাজপেয়ী। ১৯৫৪ সালে কাশ্মীরে শ্যামাপ্রসাদের কাশ্মীর যাত্রার আগে তাঁর সঙ্গে ছিলেন দুই তরুণ অটলবিহারী বাজপেয়ী ও লালকৃষ্ণ আডবাণী। লালকৃষ্ণ আডবাণী একবার লিখেছিলেন, ‘তাঁরাও কাশ্মীরে যেতে চেয়েছিলেন। তবে শ্যামাপ্রসাদবাবু আটকে দেন। দুই তরুণের মধ্যে ভবিষ্যতের নেতাকে দেখতে পেয়েছিলেন শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়।’ কাশ্মীর থেকে ফিরেছিল শ্যামাপ্রসাদের নিথর দেহ। ১৯৫৭ সালে দ্বিতীয় লোকসভা ভোটে বলরামপুরে জয়ী হন বাজপেয়ী। ভারতীয় রাজনীতিতে উদয় হয় এক নতুন নক্ষত্রের।

দীনদয়াল উপাধ্যায়ের মৃত্যুর পর জনসঙ্ঘের দায়িত্ব নেন অটলবিহারী বাজপেয়ী। সঙ্গে ছিলেন বন্ধু লালকৃষ্ণ আডবাণী। ১৯৭৫-এ জরুরি অবস্থার সময়ে অন্য বিরোধী নেতাদের সঙ্গে গ্রেফতার হন বাজপেয়ী। জয়প্রকাশ নারায়ণের ডাকে সাড়া দিয়ে কংগ্রেস বিরোধী জনতা দলে যোগ দেয় জনসঙ্ঘও। ৭৭-এর ভোটে ক্ষমতায় আসে জনতা দল। মোরারজি দেশাইয়ের মন্ত্রিসভায় বিদেশমন্ত্রী হন বাজপেয়ী। সেই সরকার বেশিদিন চলেনি। এরপর জনসঙ্ঘ থেকে তৈরি হল নতুন দল ভারতীয় জনতা পার্টি। তবে সাফল্য তাড়াতাড়ি আসেনি। প্রথমবার মাত্র দুটি আসন জেতে বিজেপি। তবে অযোধ্যায় রাম মন্দির নির্মাণ আন্দোলনে ভর করেই ভিত শক্ত হতে শুরু হয়। বাজপেয়ীকে মুখ করে ১৯৯৬-এর ভোট লড়ে পদ্ম শিবির। ১৯৯৬ সালে প্রথমবার প্রধানমন্ত্রী হন অটলবিহারী বাজপেয়ী। তবে আস্থা ভোটে হেরে ১৩ দিনেই ইতি পড়ে সেই সরকারের। এরপর ইউনাটেড ফ্রন্ট সরকারও বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। ১৯৯৮ সালে বেশ কিছু আঞ্চলিক দল নিয়ে এনডিএ জোট তৈরি করে বিজেপি। তারপর ১৯৯৮ সালের মে মাসে পোখরানে পারমাণবিক বোমা পরীক্ষা করে ভারত।

পাকিস্তানের সঙ্গে মৈত্রী বাড়াতে দিল্লি লাহোর বাসযাত্রাও শুরু করেন বাজপেয়ী। তবে এসবের মাঝেই ঘরে-বাইরে দানা বাঁধছিল ‘বিদ্রোহ’। ১৯৯৯-এর মে মাসে হঠাত্ই জোট ছেড়ে দেন জয়ললিতা। ১৩ মাসের মাথায় সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারায় বাজপেয়ী সরকার। অন্যদিকে কাশ্মীর সীমান্তে অনুপ্রবেশ। শুরু হয়ে যায় কার্গিলের যুদ্ধ। সেই যুদ্ধ জয়ের পর বিপুল ভোটে জিতে ক্ষমতায় আসে এনডিএ।

পাঁচবছরের শাসনকালে একাধিক আর্থিক সংস্কার করেন প্রধানমন্ত্রী। চালু হয় প্রধানমন্ত্রী গ্রাম সড়ক যোজনা, সর্ব শিক্ষা মিশনের মতো প্রকল্প। সোনালি চতুর্ভুজ প্রকল্পে গোটা দেশকে একসূত্রে বাঁধার কৃতিত্ব বাজপেয়ীর। তবে শুধু পদ্মের পাপড়িই নয় কাঁটাও ছিল এই পাঁচ বছরে। তেহলকা দুর্নীতি, গুজরাট হিংসার মতো ঘটনাও ঘটেছে। ২০০৪ সালে বাজপেয়ীর ‘শাইনিং ইন্ডিয়া’কে হারিয়ে ক্ষমতায় আসে ইউপিএ সরকার। শেষ হয় অটলযুগের। আর ফেরেননি বাজপেয়ী। ২০০৫ সালে রাজনীতি থেকে অবসর নেন। ২০০৯ সালে অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি। তারপর কার্যত গৃহবন্দি। মোদী জমানায় তিনি পেয়েছেন ভারতরত্ন সম্মান। তাঁর জন্মদিনকে সুশাসন দিবস হিসেবে ঘোষণা করেছেন নরেন্দ্র মোদী।

বাজপেয়ী বলতেন তাঁর কবিতা যুদ্ধের মতো। সেখানে হেরে যাওয়ার কথা নেই। আছে এক যোদ্ধার জয়ের আখ্যান। নিজের জীবনেও সেই কবিতার কথাই বলে গিয়েছেন তিনি। আটের দশকে তাঁর দুই সাংসদের দল আজ একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে দিল্লির মসনদে। গোটা ভারতের ২১টি রাজ্যের ক্ষমতায় বিজেপি। এমন দিনের ভবিষ্যৎবাণী সেই কবে করে গিয়েছেন বাজপেয়ী। বলেছিলেন, ‘অন্ধেরা ছাটেগা, কমল খিলেগা।’

আজ তাঁরই শিষ্যের হাত ধরে গোটা দেশে বিকশিত হয়েছে ‘কমল’। সেদিন টালমাটাল গুজরাটের দায়িত্ব তুলে দিয়েছিলেন আনকোরা নরেন্দ্রভাইয়ের হাতে। নেতা চিনতে ভুল হয়নি অটলের। আজ সেই গ্যাম্বলই বিজেপিকে রেকর্ড উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছে। তবে দেখে যেতে পারলেন না অটলবিহারী বাজপেয়ী। দীর্ঘদিন আগেই স্মৃতি সঙ্গ ছেড়েছে। কবির মৃত্যু হয় না। তিনি বেঁচে থাকেন পাঠকের মননে। অটল ‘অটল’ হয়ে থাকবেন তাঁর হার না মানা লেখনীতে – হার নেহি মানুঙ্গা, রার নেহি ঠানুঙ্গা, কাল কে কপাল পর লিখতা মিটাতা হুঁ। গীত নয়া গাতা হুঁ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.