আজ ভাবতেও কি পারেন পাকিস্তানের করাচীতে ছিল রামকৃষ্ণ মিশনের বিশাল মঠ, বিশাল কর্মকান্ড ! এভাবে চললে ভবিষ্যতে হয়তো এখানকারটাও ভাবতে পারবেন না। এখন বললে যেটা আবার আপনার অবিশ্বাস্য বলেই মনে হবে, তখনকার তাঁরাও ঠিক এভাবেই কোনদিন ভাবতেও পারেন নি তা!!
পড়ুন, রূপকথা বলেই মনে হবে। ভাবুন এই উদারতা, একতরফা সম্প্রীতি, একতরফা সর্ব ধর্ম সমন্বয়ের বৃথা চেষ্টা – আমাদের এগিয়ে নিয়ে গেছে, নাকি অতল খাদের দিকে।
“দেশবিভাগের পর ১৯৪৭ সালে সেপ্টেম্বরের প্রথমদিকে আমার অভ্যাসমত স্কুল থেকে ফিরে এসে বিকালে ঢাকা রামকৃষ্ণ মিশনে যাওয়ার পর মঠাধ্যক্ষ স্বামী জ্ঞানাত্মানন্দ মহারাজ আমাকে বললেন “রবি তুই এক্ষুণি গিয়ে শ্রীশকে ডেকে নিয়ে আয়,করাচী থেকে মহারাজ এসেছেন দুটো পাঞ্জাবী সেলাই করতে হবে। ”আমি সাইকেলে গিয়ে শ্রীশবাবুকে সামনে বসিয়ে মঠে ফিরলাম, শ্রীশবাবু মিশনের ভক্ত ও মহারাজদের পাঞ্জাবী সেলাই করতেন। তিনি মাপ নিয়ে চলে গেলেন রাতভর পরিশ্রম করে দুটো পাঞ্জাবী তৈরী করে সকালে মঠে পৌঁছে দিয়ে গেলেন। পাঞ্জাবীগুলি সাদাকাপড়ের ছিল,পরদিন আমি মঠে গেলে স্বামী জ্ঞানাত্মানন্দের আদেশ অনুসারে আমাদের পাড়ার ‘রঞ্জক সাবান’ কোম্পানীর বাড়ী থেকে দুটো গেরুয়া রং করার সাবান এনে তাদের নির্দেশ অনুসারে পাঞ্জাবী দুটোকে গেরুয়া রং করে দিলাম।কার জন্য এই পাঞ্জাবী রং করা হোল জানেন? তিনি করাচী রামকৃষ্ণ মিশনের সভাপতি রঙ্গনাথানন্দজী মহারাজ, পরবর্তীকালে তিনি রামকৃষ্ণমিশনের প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার হওয়ার একদিন আগে থেকেই অর্থাৎ ১৩ই আগষ্ট ১৯৪৭ থেকেই করাচীতে হিন্দু ও শিখদের উপর মুসলমানদের অত্যাচার আরম্ভ হয়। মুসলমানরা করাচী রামকৃষ্ণ মিশনের মঠে আগুন ধরিয়ে দেয়। ঐ সময় করাচী দিল্লী বিমান চলাচল বন্ধ, ঢাকা করাচী বিমান চলতো তাই রঙ্গনাথানন্দজী এক কাপড়ে বিমান যোগে ঢাকা এসে রামকৃষ্ণ মিশনে উঠেছেন। এরপর প্রায় তিনমাস তিনি ঢাকা মঠে ছিলেন। প্রায়ই কোন না কোন ভক্তের বাড়ীতে বৈকালে তার ধর্মালোচনা হতো, আমার কাজ ছিল ওনাকে রিক্সা করে নিয়ে যাওয়া এবং সভা শেষে মঠে পৌঁছে দেওয়া। যেদিন যাঁর বাড়িতে সভা হতো, তাঁরাই যাতায়াতের রিক্সাভাড়া দিয়ে দিতেন। শ্রীজুনারকর নামে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক অধ্যাপকের বাড়ীতেই অধিকাংশ দিন সভা হতো।আমার সৌভাগ্য এহেন মহান ব্যক্তিত্বের সঙ্গে প্রায় তিন মাস একই রিক্সায় যাতায়াত করার সুযোগ পেয়েছি।এখনো রঙ্গনাথানন্দজীর লেখাপত্র আমার সংগ্রহশালায় আছে, করাচী মঠে থাকাকালে লালকৃষ্ণ আদবানী এমনকি পাকিস্থানের জনক মুহাম্মদ আলি জিন্না অবধি তার বক্তৃতা শুনেছেন। কথিত আছে স্বামী বিবেকানন্দ ছাড়া রামকৃষ্ণ মিশনে অতবড় বক্তা আর কেউ ছিলেন না।পরবর্তীকালে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে গিয়ে বেদান্ত প্রচারে অভুতপূর্ব সাড়া জাগিয়েছেন। ঢাকা থাকাকালীন আমি জানতে পারি স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে হিন্দু নিধনের সময় করাচী মঠের গ্রন্থাগারের প্রায় ৬০,০০০ দুঃষ্প্রাপ্য বই পুড়িয়ে দেয় জেহাদী মুসলমান দুষ্কৃতিরা। তার মধ্যে বিভিন্ন ব্যক্তির সংগ্রহে থাকা সিন্ধুসভ্যতার অনেক নিদর্শন ছিল যা তারা রক্ষাকল্পে মিশনে জমা দিয়েছিলেন। এরপর করাচী মঠ বিক্রি করে যে টাকা পাওয়া তার সুদ থেকে ভরতুকী দিয়ে মিশন বইপত্রগুলি সস্তাদরে বিক্রি করে, এই লাইব্রেরীটা পোড়ানোর ব্যাপারে স্বামী বিবেকানন্দ একটি লেখা প্রনিধান যোগ্য-
“তাহাদের (মুসলমানদের) মূলমন্ত্র আল্লা এক এবং মহম্মদই একমাত্র পয়গম্বর, যাহা কিছু ইহার বহির্ভূত সে সমস্ত কেবল খারাপই নহে, উপরন্তু সে সমস্তই তৎক্ষনাৎ ধ্বংস করিতে হইবে।যে কোন নারী বা পুরুষ এইমতে সামান্য অবিশ্বাসী তাহাকেই নিমেষে হত্যা করিয়া ফেলিতে হইবে। যাহা কিছু এই উপাসনা পদ্ধতির বহির্ভুত সমস্তই অবিলম্বে ভাঙিয়া ফেলিতে হইবে, যে কোন গ্রন্থে অন্যরূপ মত প্রচার করা হইয়াছে সেগুলিকে দগ্ধ করিতে হইবে।প্রশান্ত মহাসাগর হইতে আটলান্টিক মহাসাগর পর্যন্ত ব্যাপক এলাকায় দীর্ঘ পাঁচশত বৎসর ধরিয়া রক্তের বন্যা বহিয়া গিয়াছে 1ইহাই মুসলমান ধর্ম।”
- স্বামী বিবেকানন্দ, Practical Vedanta.
এবার আসা যাক কেন রঙ্গনাথানন্দজী বিতারিত হলেন এবং করাচী মঠ পোড়ানো হলো। তিনি ছিলেন দক্ষিন ভারতের কেরালা প্রদেশের নামবুদ্রী ব্রাহ্মন পরিবারভুক্ত। করাচী শহর এবং পাকিস্তানে সব শহরগুলিতে ছিল খাটা পায়খানা, যার মল পরিষ্কার করে হিন্দু মেথররা বাইরে ফেলে দিত। এরা ছিল মাদ্রাজী তথা দক্ষিন ভারতীয়। ঐসময় হিন্দুহত্যা আরম্ভ হলে ঐ মেথররা টাকা তুলে দুটো জাহাজ ভাড়া করে করাচী থেকে মাদ্রাজ যাবার জন্য প্রস্তুত হয়।পাক সরকার দেখলো স্বপরিবারে সব মেথর চলে গেলে মল ফেলবে কে?তখন বলপূর্বক জাহাজ দুটো পাক সরকার আটকে রাখে এবং তাদের মাদ্রাজ যাত্রা বন্ধ করে দেয় এবং রটিয়ে দেয়া হয় স্বামী রঙ্গনাথানন্দজীর পরামর্শে এই মেথররা পাকিস্তান ত্যাগ করছে। ফল স্বরূপ মঠ ধ্বংস এবং অগ্নিসংযোগ, ঐ সময় করাচী থেকে প্রচুর সিন্ধিরা বিমানযোগে ঢাকা এসে ঘোড়ার গাড়ী ভাড়া করে মিশনে উঠতো, তাছাড়া রাত্রে মঠে মহিলাদের থাকা নিষিদ্ধ বলে, অনেক সিন্ধি পরিবারকে আমি ঢাকার মিশনের ভক্তদের বাড়ীতে থাকার ব্যবস্থা করে দিই। ২/৩ দিন থাকার পর তারা ট্রেনযোগে ঢাকা থেকে কলকাতা হয়ে ভারতে ঢুকেছে। এদের মধ্যে অধিকাংশ বিগত যৌবনা ও প্রৌঢ়। অর্থাৎ যুবতীরা অপহৃত হয়েছে এবং যুবকরা নিহত হয়েছে।
এই সব ইতিহাস হিন্দুরা কোথাও লিপিবদ্ধ করেনি বরং ইতিহাস বিকৃত করেছে অথবা মিথ্যা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির নামে ইতিহাস ধ্বংস করেছে।অন্নদাশঙ্কররায় তার বই “যুক্তবঙ্গের স্মৃতি” পৃ ১১২তে লিখেছেন -“একদিন কুমিল্লার প্রসিদ্ধ উকীল ও নেতা কামিনীকুমার দত্ত ময়মনসিং এসে আমার সাথে দেখা করেন, তাকে জিজ্ঞাসা করলে তিনি হেসে বলেন, যা পড়ছো বা শুনছো সব অতিরঞ্জিত।নোয়াখালীতে খুন হয়েছে শ আড়াই(২৫০), ধর্ষনের কেস খুবই কম, জোর করে যাদের মুসলিম করা হয়েছিল একদিন কি দুদিন বাদে প্রায়শ্চিত্ত করে আবার হিন্দু হয়েছে মোল্লাদের কাছে এটা নতূন অভিজ্ঞতা।”
নোয়াখালিতে হিন্দুনিধনের অনুসন্ধান কমিটির সভাপতি বিচারপতি এডওয়ার্ড স্কিপার সিমসন(ICS)লিখেছেন।এক অঞ্চলে ৩০০রও বেশি এবং অন্য এক অঞ্চলে ৪০০রও বেশী নিরীহ মহিলাকে ধর্ষন করা হয়েছে।
এই মিথ্যাবাদীর উকিলবাবু বলেছে, “একদিন কি দুদিন বাদে প্রায়শ্চিত্ত করে আবার হিন্দু হয়েছে।” আমার প্রশ্ন এই গন্ডোগোলের সময় কি প্রায়শ্চিত্ত করা সম্ভব? একজন ব্রাহ্মণ নোয়াখালি থেকে পত্র লেখেন ‘আমরা সব কলমা পড়ে মুসলমান হয়েছি। অভ্যাসবসত চিঠির প্রথমে তিনি শ্রী শ্রী হরি সহায় লেখেন। পোস্ট অফিসে সেই চিঠি গেলে মুসলমানরা শ্রী শ্রী হরি মুছে দেয় এবং লেখার জন্য প্রচন্ড মারধর করে।
১৯৪৬ এর সালের :ডাইরেক্ট অ্যাকশন ডে’র উপর সরকার যে অনুসন্ধান কমিটি গঠন করে তার রিপোর্টের সমস্ত কপি ডঃ বিধান রায় পুড়িয়ে দেন।১৯৫০ সালের ১৮ই ফেব্রুয়ারী হিন্দু নিধনের শিকার হয়ে কলকাতা আসার পর রোজ বিকালে আমার মামা কেশব ঘোষের সঙ্গে আনন্দবাজার পত্রিকা অফিসে যেতাম। মামা ঐ অফিসের চিফ সাব এডিটার ছিলেন। বিভিন্ন পত্রিকার চিফ সাব এডিটার ছিলেন।বিভিন্ন পত্রিকার সাংবাদিকরা আমাকে ছেঁকে ধরতেন। পূর্বপাকিস্তানের হিন্দুনিধনের সংবাদ জানাতে আমি অনেক বর্বরতার খবর দিয়েছি, তারা নোট করে নিয়েছে কিন্তু কোন সংবাদই ছাপা হয়নি। পরে খোঁজ নিয়ে জানতে পারলাম বিধান রায় আন অফিসিয়েল আদেশ জারি করেছে পূর্ব পাকিস্তানের কোন সংবাদ যাতে ছাপানো না হয়। এই ত আমাদের চরিত্র। সত্য সেলুকাস কি বিচিত্র এই দেশ। সত্য ইতিহাসও এদেশে লেখা চলবেনা।”
লেখক – শ্রী রবীন্দ্রনাথ দত্ত